ফরিদ আহমেদ : বত্রিশ লক্ষ বছর আগের আদিম পৃথিবী। বহু বহু বছর পরে এই অঞ্চলের নাম হবে আফ্রিকা। সেখানকার সাভানাতে ঘটেছিলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

আজকে যেটাকে আমরা ইথিওপিয়া বলি, সেখানকার তৃণভূমিতে গাছের ডালে বসে ছিলো এক তরুণী এপ। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে নিরাপদে বসে আরাম করছিলো সে। সেই সময়ে অন্য যে সব এপরা ওখানে বসবাস করতো ওই অঞ্চলে, তাদের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম আর অগ্রসর ছিলো তরুণী এপের প্রজাতিরা। তাদের নিতম্ব এবং পা অন্য প্রজাতির এপদের চেয়ে একটু ভিন্ন ছিলো। খাড়া হয়ে চলাফেরা করতো তারা। গাছের উপরে বসবাস করলেও প্রায়শই মাটিতে নেমে আসতো। সাভানা অঞ্চলে দু’পায়ে হেঁটে বেড়াতো তারা। যদিও এখনকার আমাদের মতো ছিলো না সেই দুই পায়ে হাঁটা। আনাড়িপনা ছিলো সেখানে প্রচুর। তবে, সেই আনাড়িপনাই একদিন আমাদের দুই পায়ে মসৃণ হাঁটাকে নিশ্চিত করেছে। উদ্ভটভাবে হাঁটা ওই এপরা তৃণভূমিতে খাদ্য খুঁজে ফিরতো। বিপদ দেখলে, কিংবা বিশ্রাম বা নিদ্রার সময় হলে আশ্রয় নিতো গাছের উপরে। যেমনটা বিশ্রাম নিচ্ছিলো আমাদের সেই তরুণী এপটা।

এই এপদের এখন আমরা একটা নাম দিয়েছি। সেটা হচ্ছে অস্ট্রেলোপিথেকাস। গাছের উপরে বিশ্রাম নেওয়া তরুণী এপ অবশ্য এ’সব কিছু জানতো না। খাওয়া, ঘুম, বিপদ থেকে বাঁচা আর যৌন সঙ্গমের জন্য একজন সক্ষম সঙ্গী কামনা করার বাইরে আর কিছু জানার প্রয়োজন তার ছিলো না। সে যেখানে বসবাস করে, যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে সেই জায়গাটার নাম যে একদিন ইথিওপিয়া হবে, তাদের প্রজাতির নাম যে অস্ট্রেলোপিথেকাস হবে, কিংবা তাকেও যে কেউ একজন একটা নির্দিষ্ট নাম দেবে বত্রিশ লক্ষ বছর পরে, তার প্রজাতির সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাণীতে পরিণত হবে সে একদিন, এগুলোর কোনো কিছু সম্পর্কেই তার কোনো ধারণা ছিলো না। এগুলো নিয়ে ভাবছিলোও না সে। তাহলে কী নিয়ে ভাবছিলো সে তার অলস সময়ে? আমরা আসলে জানি না। কোথায় খাবার পাওয়া যাবে, সেটা নিয়ে হয়তো ভাবছিলো সে, কিংবা সঙ্গী খুঁজে পাবার বাসনা কাজ করছিলো তার, কিংবা এই গাছের বদলে ভিন্ন কোনো গাছে আরও নিরাপদ এবং আরামদায়ক আশ্রয়ের কথা মনে মনে চিন্তা করছিলো। আজ এতদিন পরে এসে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয় সেই তরুণী এপ কী ভাবছিলো।

কী ভাবছিলো, সেটা না জানলেও, আমরা জানি, মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটেছিলো ওই সময়ে। অজ্ঞাত কোনো কারণে গাছ থেকে পড়ে যায় সে। হয়তো ডালটা নরম ছিলো, ফলে ভেঙে গিয়েছে, কিংবা নিজের অসতর্কতায় পতন ঘটেছিলো তার, বা শিকারির হামলার সম্মুখীন হয়তো হয়েছিলো সে, ফলে জান বাঁচাতে গিয়ে লাফ দিয়েছিলো গাছের উপর থেকে। যেটাই হোক না কেনো কারণ, ফলাফল ছিলো গাছ থেকে পতন। আর পতনটা এতোই তীব্র ছিলো যে, সেই আঘাতে মারা যায় তরুণী এপটা।

পতনের ফলে জীবন শেষ হলেও, তার অস্তিত্ব একেবারে বিলীন হয় না। ফসিল হয়ে পড়ে ছিলো তার হাড়গোড়ের কিছু অংশ। তার মৃত্যুর বহু বহু বছর পরে তাদের প্রজাতি থেকে আরও কয়েক ধাপ পরে বিবর্তিত হওয়া আরেক ধরনের এপ হোমো স্যাপিয়েন্সদের একটা অংশ খুঁজে পায় সেই সব ফসিল হওয়া হাড়গোড়।

ফরাসি ভূতত্ত¡বিদ এবং প্যালিওএন্থ্রোপলজিস্ট মরিস তাইয়েব ১৯৭০ সালে ইথিওপিয়ার আফার এলাকায় হাদার নামের একটা জায়গা খুঁজে পান। তাঁর ধারণা ছিলো মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কিত ফসিল এবং হাতিয়ার এই অঞ্চলে পাওয়া যাবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি ইন্টারন্যাশনাল আফার রিসার্চ এক্সপিডিশন গড়ে তোলেন এবং তিনজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ জানান। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমেরিকান প্যালিওএন্থ্রোপলজিস্ট ডোন্যাল্ড জোহানসন। তিনি এবং তাঁর গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট টম গ্রে হাদার এলাকার একটা সংকীর্ণ খাত থেকে বত্রিশ লক্ষ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে মারা যাওয়া সেই তরুণী এপের হাড়গোড় আবিষ্কার করেন।

এই অসাধারণ আবিষ্কারকে উদযাপন করছিলেন সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা তাঁদের তাবুতে। আনন্দঘন পরিবেশে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিলো। খাসির রোস্ট আর সাথে প্যানফ্রায়েড আলু খেয়ে, বিয়ার হাতে নিয়ে গল্পগুজব করছিলেন তাঁরা। ঠিক সেই সময় একটা সনি টেপ ডেকে বাজছিলো বিটলসের গান ‘লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ড’।
এই গান শুনেই ডোন্যাল্ডের গার্লফ্রেন্ড প্রস্তাব করেন ‘আমরা কেনো একে লুসি নামে ডাকি না?’ প্রেমিকার প্রস্তাব ডোন্যাল্ড খুব একটা পছন্দ না করলেও, ক্যাম্পের বাকি সবাই এই নামেই ফসিলকে ডাকা শুরু করে। বত্রিশ লক্ষ বছর আগের এক বিয়োগান্তক ঘটনায় নিহত অজানা এপ পেয়ে যায় আদুরে এক নাম। বিটলসের গানের মতোই, সেই গান থেকে পাওয়া নামে বিখ্যাত হয়ে পড়ে সে।

লুসি একটা সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি ছিলো। এই প্রজাতির নাম দেওয়া হয় অস্ট্রেলোপিথেকাস আফারেনসিস। মানুষ এবং এপদের মধ্যেকার মিসিং লিংক হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে লুসি। লুসির আবিষ্কার বিমোহিত করে সবাইকে। ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় তার নাম। লুসির হাড়গোড় নিয়ে আসা হয় আমেরিকাতে। ওহাইও-র ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে এর রিকনস্ট্রাকশন করেন ডোন্যাল্ড জোহানসন।

গাছ থেকে পড়ে মারা না গেলে, লুসির হয়তো এভাবে বিখ্যাত হওয়া হতো না। তার প্রজাতির অন্য সবার মতো সে-ও হয়তো হারিয়ে যেতো এই পৃথিবী থেকে নীরবে এবং নিঃশব্দে।

প্রশ্ন হচ্ছে, লুসি যে গাছ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলো, সেট আমরা জানি কীভাবে? বত্রিশ লক্ষ বছর আগেতো আমরা কেউ ছিলাম না। আমাদের প্রজাতিরও জন্ম হয়নি তখন। তাহলে জানি কীভাবে?

ইতিহাস সবসময়ই সংশয়াচ্ছন্নতায় ভরা। অতীতে যা ঘটেছে, তার বেশিরভাগ জিনিসই মানুষ লিখে রেখে যায়নি। আবার যাঁরা লিখেছেন কিছুটা, তাঁরাও যে সেইটুকু সঠিক লিখেছেন, সেটাও হলফ করে বলা যায় না। এদের অনেকেই থাকেন খ্যাপাটে, কেউ কেউ মিথ্যুক আবার কেউ বা খুবই পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যে কারণে, অসংখ্য ইতিহাসবিদ এবং প্রতœতত্ত¡বিদদের কঠোর পরিশ্রমের পরেও আমরা বলতে পারি যে, অজানা অংশের সঙ্গে তুলনা করলে জানা অংশটা খুবই সামান্য হবে আমাদের। ইতিহাসের একটা বড় অংশই হারিয়ে যায়, ক্ষুদ্র একটা অংশ টিকে থাকে। আর সেই ক্ষুদ্র অংশের ভিত্তিতেই অতীতের বিষয়ে আমরা সত্যি কিংবা মিথ্যা সিদ্ধান্ত নেই।

লুসি যে গাছ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলো, সেটা নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন কিছু বিজ্ঞানী। তাঁদের লেখা একটা প্রবন্ধ ২০১৬ প্রকাশিত হয়েছিলো হয়েছিলো ‘নেচার’ পত্রিকায়। গবেষকরা লুসির হাড়ের সিটি স্ক্যান করেছিলেন। সেটার ভিত্তিতে কম্পিউটারের লুসির হাড়ের ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরি করেন তাঁরা। লুসির হাড়ে যে ধরনের ফ্রাকচার ছিলো, সেটা শুধুমাত্র জীবন্ত হাড়েই ঘটে থাকে। আর এই ফ্রাকচার কখনোই ঠিক হয় না। এর মাধ্যমে তাঁরা বলার চেষ্টা করেন যে, হাড় ভাঙার সময়ে লুসি জীবন্ত ছিলো। কিন্তু, এর পরপরই মারা যায় সে। তাঁরা অসংখ্য অর্থোপেডিক্স সার্জনের সাথে কথা বলেছেন এবং সেই সব সার্জনদের সবার ভাষ্য হচ্ছে, হাড়ে এই ধরনের ভাঙার প্যাটার্নটা শুধুমাত্র উঁচু জায়গা থেকে পড়লেই দেখা যায়। তার বাহু যেভাবে ভেঙেছে সেটা দেখলে বোঝা যায় বাহু দিয়ে সে তার পতনকে ঠেকাতে চেয়েছিলো।

ভূতত্ত¡ গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা জানতেন, লুসি যেখানে বসবাস করতো সেটা ছিলো জলপ্রবাহের পাশের একটা সমতল বনভূমি। ওখানে কোনো পাহাড়, চড়াই, উদ্গত স্তর কিংবা খাড়া পাড় ছিলো না। ছিলো না বলে, ওগুলো থেকে লুসি পড়েনি। একমাত্র সমাধান হচ্ছে, লুসি গাছ থেকে পড়েছে।

আগেই বলেছি, অতীত মানেই সংশয়। ইতিহাস আরও বেশি সংশয়াচ্ছন্ন। গাছ থেকে পড়ে লুসি মারা গেছে, এই গবেষণার বিষয়েও অনেক বিশেষজ্ঞ একমত হতে পারেন নাই। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন স্বয়ং লুসির আবিষ্কারক ডোন্যাল্ড জোহানসন। তাঁর মতে লুসির হাড়ে যে সমস্ত চিড় দেখা গেছে সেটা প্রাথমিক পর্যায়ের মানুষের বা ম্যামলদের ফসিলেও দেখা গিয়েছে। এটা আলাদা কিছু নয়। তিনি বলেন, আমরা জানি না ফসিলিকরণ প্রক্রিয়া কতোটা সময় ধরে চলেছে। কিন্তু, এই প্রক্রিয়ার সময় হাড়ের উপরে পলি পড়ার ফলে বিপুল পরিমাণে চাপ পড়ে হাড়ের উপরে। ফলে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়, কখনো কখনো ভেঙেও যায়।”

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালিওএন্থ্রোপলজিস্ট টিম হোয়াইট বলেছেন, “প্যালিওনটোলজিস্টরা যে সব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভূতাত্তি¡ক শক্তির কারণে বিকৃত হাড়ের ফসিল পাওয়া গিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে যদি একই যুক্তি প্রয়োগ করে তবে বলতে হবে যে গ্যাজেল থেকে শুরু করে হিপো, রাইনো এবং হাতি এরা সকলেই উঁচু গাছ থেকে পড়েছে।”
টিম হোয়াইটের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেন নাই যে লুসির হাড় ভেঙেছে তার মৃত্যুর সময়ে। হাড়ে এই ধরনের ত্রুটি পলির আস্তরণের চাপের প্রাকৃতিক ভূতাত্তি¡ক শক্তি থেকে আসে। লুসির প্রতিটা হাড়েও এই চিড় রয়েছে। গবেষকরা সেই হাড়গুলোকেই চেরি পিক করেছেন, যেগুলো তাদের সেই কল্পনা ‘লুসি গাছ থেকে পড়ে মারা গেছে’ এর পক্ষে যায়। অন্য হাড়গুলোকে তারা বাদ দিয়ে গিয়েছেন সচেতনভাবে। সেগুলোকে পরীক্ষাও করেননি, কোনো ব্যাখ্যাও তারা দেননি ওগুলোর বিষয়ে।

লুসি তাহলে কীভাবে মারা গিয়েছিলো? এর সঠিক উত্তর হচ্ছে, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। হয়তো গাছ থেকে পড়ে মারা গিয়েছে সে, কিংবা সে রকম কিছুই হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার। মৃত্যুর পরে পড়ে থেকেছে খাদে। ধীরের ধীরে তার হাড়গুলো ফসিল হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে পলি মাটির দীর্ঘ আস্তরণ পড়েছে সেগুলোর উপরে। সেই আস্তরণের তীব্র চাপে চিড় ধরেছে হাড়ের গায়ে। বত্রিশ লক্ষ বছরের সময়ের দাগ সহজ হবার কথা নয়।

অতীত মানেই অস্পষ্টতা, অতীত মানেই অনিশ্চয়তা। অবিমিশ্রতা এক মিথ্যে আশা অতীতের কাছে।