ফরিদ আহমেদ : নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিলো ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের দুই তারিখে। পুলিশের কাস্টডিতে থাকা একজন আসামী সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। বিচার বহির্ভূত এক হত্যাকাণ্ড ছিলো সেটা। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুক্ত ছিলো সেই হত্যাকাণ্ডে। তারা নিজেরা যে শখ করে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিলো, সেরকম নয়। খুব সম্ভবত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করেছিলো তারা। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ওটাই প্রথম নয়। তবে, ওই হত্যাকাণ্ডটি ছিলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত এক হত্যাকাণ্ড। শুধু সেই সময়েই নয়, এখন পর্যন্ত ওই ঘটনা নিয়ে মানুষয়ের আলাপ, আলোচনা, বিশ্লেষণ এবং কৌতূহলের সীমা-পরিসীমা নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচার বহির্ভূত যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এটা। হত্যাকাণ্ডের যিনি শিকার হয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির প্রধান কমরেড সিরাজ সিকদার। তিনি চীনপন্থি বাম আদর্শের একজন নেতা ছিলেন। চিনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং এর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তিনি।

মাও সে তুং এর চীনের বিপ্লব এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জের এসে পড়েছিলো সুদূর পূর্ব বাংলাতেও। অসংখ্য তরুণ তখন এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পড়ে। সিরাজ সিকদারও তাঁদেরই একজন। শুরুতে মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন তিনি। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। এটাই বছর তিনেক পরে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময়ে পশ্চিম বঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে শুরু হয় সশস্ত্র নকশাল আন্দোলন। কমরেড চারু মজুমদার ছিলেন এর নেতৃত্বে।
নকশালবাড়ির সেই ঝাঁপটা পূর্ব বাংলাতেও এসে লেগেছিলো। কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার একদল তরুণও সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে সেই সশস্ত্র বিপ্লব অবশ্য কাগজের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যদিও তারা দাবি করেছে যে সশস্ত্র গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। একাত্তরের জানুয়ারি মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন (বিএনআর) এবং ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস (ইউসিস) এর অফিসের সামনে বোমা ফাটানোই ছিলো তাদের গেরিলা যোদ্ধাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এই দু’টো অফিস তোপখানা রোডে পাশাপাশি অবস্থিত ছিলো।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি’। সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন। পাকিস্তান বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ, এই তিনটাকেই শত্রু হিসাবে ঘোষণা করেন তিনি। যুদ্ধের কৌশল হিসাবে খুব একটা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত এটা ছিলো না। ত্রিমুখী শত্রুর সাথে লড়তে গিয়ে সর্বহারা পার্টি ব্যাপক লোকবল হারায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বহারা পার্টির সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। সেগুলোতে দুই পক্ষেরই লোকজন মারা যায়।

স্বাধীন হবার পরে বাংলাদেশ এক অস্থির সময় অতিক্রম করেছে। চারিদিকে তখন নানাবিধ নৈরাজ্য। দেশ স্বাধীন হবার পরেও সর্বহারাদের লড়াই থামেনি। সেটা অব্যাহত থাকে বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তে সর্বহারাদের আক্রমণের খবর পত্রিকায় আসতে থাকে। গোলা-গুলি, বোমাবাজি, খুন-খারাবি, ডাকাতি-রাহাজানি, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুঠ, এই সমস্ত কাজ ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিচিত্রার এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘তেহাত্তরের জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৩ দিনে ৫৮টি থানা ও ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা হয়। এর মধ্যে ২৮টি থানা ও ফাঁড়ি লুট হয়। অস্ত্র লুট হয় ৩০০-র বেশি।’ ভয়ংকর রকমের হিংস্র একটা বাহিনী ছিলো এই সর্বহারা পার্টি। বাম আদর্শ বিস্তার কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করাই ছিলো এদের কাজ। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রক্ষীবাহিনীর লিডার ফারুক হোসেন প্রকাশ্য দিবালোকে হাটের মধ্যে মেরে ফেলেছিল এরা। সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারের জন্য এটা ছিলো বাড়তি এক উৎপাত। শান্তি-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়াতে সরকারও কঠোর অবস্থান নিতে থাকে এদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করতো না সর্বহারা পার্টি। বিজয় দিবসকে তারা আখ্যায়িত করেছিলো কালো দিবস হিসাবে। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়।

পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় স¤প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে।’ মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে, সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানীও বিবৃতি দিয়ে এই হঠকারী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন।

১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখে পার্টির সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে এবং দলের একজনের মুখ খোলার সুযোগে চট্টগ্রামে আটক করা হন সিরাজ সিকদারকে। সেইদিনই তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ সকালের পত্রিকা মারফত সবাই জানতে পারে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গিয়েছেন সিরাজ সিকদার। পুলিশ একটা ছকে বাধা বিবৃতিও দেয়। যথারীতি সেই বিবৃতিকে কেউ বিশ্বাস করেনি।

সিরাজ সিকদারের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো সাভারে, রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি। যদিও পুলিশ তাঁকে ধরেছিলো, মৃত্যুর পরে পুলিশই বিবৃতি দিয়েছিলো, তা সত্তে¡ও এই মৃত্যুর জন্য সবাই রক্ষীবাহিনীকেই দায়ী করেছিলো। বিপক্ষ মতকে দমন-পীড়নে এই বাহিনী তখন বেশ ভালো কুখ্যাতি অর্জন করেছিলো। সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসাবে কাজ করতো তারা। ফলে, এদের দিকেই আঙুল তোলাটা স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিলো।
আজ পর্যন্ত সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। কাজেই, নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই কে তাঁকে হত্যা করেছিলো বা কার নির্দেশে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। ঘটনাসমূহ থেকে অনুমান করে নিতে অবশ্য কষ্ট হয় না যে এই হত্যাকাণ্ডের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের যোগসূত্র ছিলো।

সিরাজ সিকদার এবং তাঁর গড়ে তোলা সর্বহারা পার্টির কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করাটা আমাদের দেশে নির্মোহভাবে কিছুটা অসম্ভব। তাঁর নেতৃত্বে একদল তরুণ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে মেতেছিলো, যেতে চেয়েছিলো সমতাভিত্তিক এক সমাজ নির্মাণের পথে। সেই পথ সঠিক, কী ভ্রান্ত, সেই বিবেচনা অনেকেই করতে নারাজ। এর মাঝে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে সিরাজ সিকদারের করুণ মৃত্যুও যুক্ত রয়েছে। এটাও তৈরি করেছে এক ধরনের ক্ষোভ, দ্রোহ আর আবেগ। এদের কাছে সিরাজ সিকদার স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবের এক অগ্নি নেতা। এদের দৃষ্টির বাইরে আরেকদল মানুষ আছে বাংলাদেশে। এরা সর্বহারা পার্টির খুন, খারাবি, লুটতরাজ ডাকাতিতে দেখেছে হঠকারী কর্মকাণ্ড হিসাবে। তাদের কাছে সিরাজ সিকদার কোনো বিপ্লবী নন, একজন নির্ভেজাল সন্ত্রাসী মাত্র। তাঁর দল একটা সন্ত্রাসী দল। এই রকম দ্বিধা-বিভক্ত জায়গা থেকে তাঁকে নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করা কঠিন। একদল তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন অতি আবেগে, আরেকদল তাঁর হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন।

এই জায়গাটাতে মহিউদ্দিন আহমদ ব্যতিক্রম। সিরাজ সিকদার এবং সর্বহারা পার্টিকে নিয়ে নির্মোহ একটা বিশ্লেষণ তিনি করার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার ফলশ্রুতি হচ্ছে তাঁর লিখিত ‘লাল সন্ত্রাসঃ সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’ বইটা। সিরাজ সিকদারকে নিয়ে যে কয়টা বই বের হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, সেগুলো কোনোটাই যেমন পক্ষপাতহীন নয়, একইভাবে সর্বাঙ্গীণও নয়। দলটা যেহেতু গোপন দল ছিলো, তাদের অনেক কাজই রয়ে গিয়েছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। এগুলোকে তুলে আনতে গেলে প্রচুর মেধা, অপার আগ্রহ, অন্তহীন আন্তরিকতা এবং কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। মহিউদ্দিন আহমদের এগুলোর কোনোটাতেই ঘাটতি নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং রাজনৈতিক দল এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে এর মধ্যেই অনেকগুলো বই লিখেছেন তিনি। সেগুলো পাঠক-নন্দিতও হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতাতেই তিনি বাংলাদেশের জন্মের পরপরই যে দলটা আলোড়ন তুলেছিলো, গোপন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলো, সরকারকে অস্থির করে তুলেছিলো, সেই দলের রাজনৈতিক তত্ত¡, রূপকল্প তিনি তুলে এনেছেন তাঁর বইতে। একই সাথে তুলে এনেছেন এক ঝাঁক মেধাবী তরুণের স্বপ্ন যাত্রা এবং স্বপ্নভঙ্গের গল্পকে।

বইটা লেখার বিষয়ে তিনি বলেছেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম, সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক ইতিহাস লিখব। যতই খোঁজখবর করি, দেখি যে রাজনীতি আর খুনোখুনি এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে, একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করা করে দেখা যায় না। শুধু একটি দিক তুলে ধরে অন্যদিক আড়াল করলে ইতিহাসের ওপর সুবিচার হয় না।

দলের লোকেরা দলীয় রাজনীতি করবে, এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর তাবৎ কমিউনিস্ট পার্টির দলিলে এক ধরনের কথা লেখা থাকে – চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজমান, বিপ্লব আসন্ন। কিন্তু বিপ্লব আর ধরা দেয় না। বিপ্লবীরা ভেঙেচুরে খানখান হন। একে অপরকে প্রধান শত্রু মনে করে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চান। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন আন্তঃপার্টি সংগ্রাম। দলের ইতিহাস লিখতে গেলে এসব কথা আসবেই।”

সেসব কথা তিনি এনেছেনও। সর্বহারা পার্টির নিজেদের মধ্যকার রেষারেষি, খুনোখুনি, নেতা হিসাবে সিরাজ সিকদারের মেধা, সাহস, তাঁর একক আধিপত্য, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা বহুগামী যৌনতা, বিভ্রান্তি সবকিছুই তুলে এনেছেন তিনি। একই সাথে সেই সময়ে সর্বহারা পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। তাঁদের ‘আনন্দবেদনা, ঝুঁকি নেওয়া এবং পলাতক জীবনের খানাখন্দ’ তুলে এনেছেন এর মাধ্যমে। ফলে, অনেক অজানা দিকও বের হয়ে এসেছে সেখান থেকে। অনেক সময় দেখা গেছে এক বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। একই ঘটনার বিষয়ে ব্যক্তির বিশ্লেষণ ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়। সেখান থেকে সঠিক তথ্যটা পাঠকদেরই বের করে নিতে হবে।

তাঁর বইয়ের কিছু কিছু তথ্য চমক জাগানিয়াও। একাত্তরের আগে সর্বহারা পার্টির শুরুর দিকে এর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন সামিউল্লাহ আজমী। তিনি অবাঙালি ছিলেন। তাদের পরিবার দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে উত্তর প্রদেশ থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছিলো। সামিউল্লাহ আজমীর ছোট ভাই রাজিউল্লাহ আজমীও সর্বহারা পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একাত্তর সালের অগাস্ট মাসে, যুদ্ধের সময়ে সামিউল্লাহ আজমীকে সাভারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলো আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সামিউল্লাহ আজমী ছিলেন বরিশালে। সেখানেই যুদ্ধ করছিলেন তিনি। পরে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। কাশিমপুর ইউনিয়নের গেসু চেয়ারম্যান আলোচনার জন্য আহবান জানালে তিনি কয়েকজন গেরিলাকে নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যান। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে তাঁদের পুরো দলটাকেই হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান যে পতাকা, সেটার ডিজাইন সামিউল্লাহ আজমী করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন থিসিস উপস্থাপন করা হয়েছিলো। সেই থিসিসে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে উল্লেখ করা হয় এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহবান জানানো হয়। এই বিবেচনায় বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বহারা পার্টি সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলো। সামিউল্লাহ আজমী স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য পতাকার ডিজাইন করেন, যেটা এখনকার বাংলাদেশের পতাকার অনুরূপ। তাঁর স্ত্রী খালেদা বেগম বুলুর ভাষ্যে, ‘সবুজ হলো শ্যামল বাংলার প্রতীক এবং লাল বৃত্ত হলো উদীয়মান সূর্য। আবার লাল হলো কমিউনিজমের প্রতীক।’

সিরাজ সিকদারের বহুগামিতার বিষয়েও এই বইতে বলা হয়েছে। শুরুতে তিনি তাদের গ্রামের বাড়ির কাজের মেয়ে রওশন আরাকে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটা অল্পবয়সী ছিলো। তাঁদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এই সম্পর্ক বেশিদিন টেকে নাই। তিনি পরে জাহানারা হাকিমকে বিয়ে করেন।

সিরাজ সিকদারের নারী দুর্বলতার বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন সামিউল্লাহ আজমীর স্ত্রী খালেদা বেগম বুলু। বুলুর জন্ম কোচবিহারে। ১৯৭০ সালে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয় পড়াশোনার জন্য। এখানে এসেই সামিউল্লাহ আজমীর সাথে তাঁর পরিচয়, প্রেম এবং পরিণতিতে বিয়ে ঘটে। তিনিও পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সামিউল্লাহ আজমীর হত্যাকান্ডের পরেও পার্টির সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলো। ১৯৭৬ সালে তিনি কোচবিহারে ফিরে যান। ফিরে যাবার আগে একটা লিখিত জবানবন্দি দিয়ে গিয়েছিলেন বুলু। সেখানে তিনি সিরাজ সিকদারের চরিত্রের অনেক দুর্বলতার সাথে সাথে নারী সংক্রান্ত দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও সিরাজ সিকদারের লালসার শিকার হয়েছিলেন। তাঁর জবানবন্দিতে তিনি লিখেছেন, “কিছুদিন পর আমাকে আবার সভাপতি তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তরে তাঁর সচিবের শিক্ষানবিশ পদে নিযুক্ত করেন। এ সময় তিনি আমাকে বলেন যে আমাকে তিনি বিয়ে করতে চান। তবে তার আগে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে দৈহিক সম্পর্ক করতে চান। পরিষ্কারভাবে তাঁকে জানাই তাঁর প্রতি আমার কোনো রকম দুর্বলতা নেই এবং আমি তাঁর স্ত্রী হতে রাজি নই। তবে পার্টির স্বার্থে যেকোনো রকম আত্মত্যাগ করতে রাজি আছি। এরপর তাঁর সাথে আমাকে দৈহিক সম্পর্কে যেতে হয়।”

বুলু শুধু তাঁর একার সম্ভ্রমহানির কথা বলেন নাই, দলের আরো কয়েকজন মেয়ের কথাও জবানবন্দিতে বলেছেন। একই সাথে সিরাজ সিকদারের বিলাসী জীবন এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।

শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশ তার জন্মের পর এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। একদিকে যুদ্ধ বিধস্ত একটা দেশ, সেটাকে পুনর্নিমাণে হিমসিম খাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা শুরু করেছে সশস্ত্র বিপ্লব। এটা শুধু সর্বহারা পার্টি একাই করেনি। ওই সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনীতিতে এসেছিলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এই জাসদও এক সময় গণবাহিনী নামে গোপন এক সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের আক্রমণে দিশেহারা অবস্থায় ছিলো বাংলাদেশ সরকার। এদের ঠেকানোর জন্য সরকারও কঠোর হয়েছে। সেই কঠোরতায় অনেক নিয়মকেই অতিক্রম করে গিয়েছে সরকার তখন। অসংখ্য তরুণ প্রাণ ঝরে গেছে অকালে, অকারণে এবং অপ্রয়োজনে হারিয়ে গিয়েছে গভীর অন্ধকারে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই টালমাটাল সময়ের অন্তরঙ্গ বিবরণ তুলে ধরেছেন মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘লাল সন্ত্রাসে’। সিরাজ সিকদার এবং সর্বহারা পার্টির রাজনীতির একটা সামগ্রিক ছবি তিনি সাফল্যের সাথে তুলে ধরেছেন তাঁর এই বইতে। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতি নিয়ে যাঁদের আগ্রহ রয়েছে, তাঁদের জন্য অবশ্য পাঠ্য এই বই।