ইচক দুয়েন্দে : ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেন ইচক দুয়েন্দে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পদ্মা-বিধৌত নগরী রাজশাহীতে। কাজ করেছেন কৃষি খামার পরিচালক, গ্রন্থ সম্পাদক এবং ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে। ইচক দুয়েন্দে’র অন্য বই: We Are Not Lovers (ইংরেজি উপন্যাস) এবং টিয়াদুর (মহাগপ্প)।

১৩.
সকলেই চুপ। তারা আর মনে মনে নিজের সঙ্গেও কথা বলে না। যখন কথা, শব্দ ও কাজ থেমে যায়, তখন সময়ও থেমে যায়। হাজতঘরের পরিবেশ হয়ে ওঠে থমথমে, শ্লথ, স্তব্ধ।
রাতে পাওয়া সেই নীল কম্বলটার ওপর এবং উদোম মেঝেতে তারা বিপ্তি শুয়ে বসে। শুধু শ্যামল চিল ও মিয়ান টিনটুই দাঁড়িয়ে। তারা খুবই অস্থির। ইমুস ক্যাটস্ ও পুঁই চুলভি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে গুটিসুটি শুয়ে। তিয়াস ঠিসটক, চিকচাকরুই ও ফিটিক চ্যাক দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া। রজেট চিনচুই বসে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা কাগজের ঠোঙার ওপরের লেখাগুলো পড়ছে। জিয়াফ ব্যানব্যাট এক ঠ্যাং উঁচু করে আধশোয়া, তার চোখ ঘুরছে ঘরটার সর্বত্র।

ফিজ ফ্যাল পদ্মাসনে বসে আছে নীল কম্বলের ওপরে। তার চোখ বন্ধ। ঠোঁট মৃদু নড়ছে।
শুধু একজন করে সান্ত্রি গরাদ-দরজার সামনে পাহারায় থাকছে। কয়েক ঘণ্টা পরপর সান্ত্রি বদল হচ্ছে। সান্ত্রি এখন গরাদ-দরজা থেকে খানিকটা দূরে।
সাংবাদিক এবং অন্য কোনো দর্শনার্থীও নেই।
সময় দুপুর একটা থেকে দেড়টা।
তাদের চুলগুলো এলেমেলো।
চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে ও উদ্দেশ্যহীন।
জামার সবচেয়ে উপরের বোতাম সব্বারই খোলা।
একটা মোটা টিকটিকি একমাত্র বাল্বটির কাঠের হোল্ডারের ওপর শুয়ে আছে।
শ্যামল চিল ও মিয়ান টিনটুই দাঁড়িয়ে থাকায় ক্ষান্ত দেয়।
শ্যামল চিল, তিয়াস ঠিসটককে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মেঝেতে বসে দেয়ালে আরাম করে হেলান দেয়। মিয়ান টিনটুই কোনোভাবে একটু জায়গা করে নিয়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে বসে।
যেন আর কেউ তাদের সম্পর্কে আগ্রহী নয়। এমনকি তারা নিজেরাও আর তাদের নিজেদের সম্পর্কে আগ্রহী নয়। হতাশা। নৈরাশ্য। অবসাদ। যা ঘটে ঘটুক। যারা শুয়ে তারা ভাব করে ঘুমানোর। যারা বসে আছে তারা বন্ধ করে চোখ। আর ভাবা যায় না।

১৪.
‘আপনাদেরকে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে,’ এক কর্মকর্তা খুবই সাদামাটাভাবে ঘোষণা করে।
‘আমাদেরকে কি তবে আদালতে নেয়া হবে?’ জিজ্ঞেস করে মিয়ান টিনটুই।
কিন্তু তার প্রশ্নটির প্রতি একটুও মনোযোগ না দিয়ে কর্মকর্তাটি চলে যায়।

অলংকরণ : উদাস আব্দুল্লাহ

১৫.
ছোট্ট ঘরটায় সব্বাই একে একে উঠে দাঁড়ায়। তারা কি কলরব করে একে অপরকে অভিনন্দিত করেনা, না, না। ইতোমধ্যে তারা ঐ ঘরটিতে হয়ে উঠেছে অভ্যস্ত। নানাজনের নানা কথায় তাদের ধারণা যে তাদের পরবর্তী গন্তব্য আদালত। যদিও কর্মকর্তাটির ঘোষণা দ্ব্যর্থহীন, ‘ছেড়ে দেয়া হবে।’
তারা পানি খায়।
পোশাক-আশাক ঝাড়ে।
সোয়েটারের কোঁচকানো অংশগুলো টেনে ঠিকঠাক করে। কেউ কেউ তাদের সোয়েটার খুলে ফেলে।
যাদের পরনে ছিল জ্যাকেট, তারা হয় চেন খোলে অথবা চেনটা লাগায়। অথবা জ্যাকেটটা খুলে ঘাড়ে নেয়।
ফিজ ফ্যাল সব শেষে উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে স্মিত হাসি। কেউ খেয়াল করে না।
কিছুক্ষণ আগে ঘরটি ছিল সম্পূর্ণ নিস্তেজ। এখন সেখানে প্রাণের স্পন্দন। মনে হয় তারা একে অপরকে ধাক্কা মেরে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করবে।
এমন একটা ঘোষণার পরও সান্ত্রিরা দূরে দূরে। গরাদ-দরজার তালা খুলবার কোনো উদ্যোগই দেখা যায় না কোত্থাও।
কিছুটা দূরে একদল মানুষ এগিয়ে আসতে চাচ্ছে, তাদেরকে কর্তব্যরত সান্ত্রিরা রূঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দেয়।
ধীরে ধীরে প্রত্যেকে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
হাজতঘরটায় এখন সময় হয়ে ওঠে দীর্ঘ, প্রলম্বিত। একেক সেকেন্ড যেন একেক ঘণ্টা।
অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা।
অসহ্য, অসহ্য, অসহ্য।
কিন্তু যতক্ষণ-না গরাদ-দরজা খোলে, যতক্ষণ-না তারা বের হয় মুক্ত বাতাসে, মুক্ত পৃথিবীতে, তার আগে তারা বিশ^াসই করতে পারবে না, নিষ্কৃতি বা মুক্তি ঘটেছে।
যদি তাদের পাখা থাকত, তবে শোনা যেত তাদের পাখার ব্যর্থ ঝটপট ধ্বনি। তাদের মনটা চঞ্চল। আসন্ন মুক্তির উদগ্র আকাক্সক্ষায় তাদের মন করছে ছটফট। কিন্তু অজানা এক আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তারা আনন্দ প্রকাশে সঙ্কুচিত।

১৬.
‘আপনারা একে একে বেরিয়ে আসবেন, না না এক্ষুনি নয়, সমস্যা আছে,’ একজন কর্মকর্তা, যাকে বেশ দায়িত্বশীল বলে মনে হয়, বলে চলে। ‘ঐ যে ঐদিকে তাকান। ওখানে একটা ঘর আছে। বুঝতে পেরেছেন? আচ্ছা আপনারা একে একে এখান থেকে বেরুবেন। এদিক ওদিক তাকাবেন, যদি সাংবাদিক দেখেন, এবাউট টার্ন, যাওয়ার দরকার নেই। ফিরে আসবেন। থানার সামনেটা সাংবাদিকে গিজগিজ করছে। আপনারা গেলেই ছবি তুলবে। ঢি ঢি রি রি পড়ে যাবে। আমরা তা চাই না। আপনারা ঐ ঘরটায় গিয়ে বসবেন। যাবার সময় এদিক ওদিক হালকা চালে তাকাবেন, মনে হবে যেন আপনারা এখানেই কাজ করেন, নিজস্ব জায়গা। নিজের অফিসের মধ্যে ঘুরছেন।

‘ঐ ঘরটায় গিয়ে বসবেন। একটু অপো করতে হবে সেখানে। তারপর আপনাদেরকে একটা কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হবে। খুব কঠিন কাজ নয়। আমরা পোলের এপারে ওপারে দুটো মই রাখব। তারপর সহজেই টপকাতে পারবেন। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে লোক থাকবে আমাদের। তারা আপনাদেরকে কয়েকটা দলে ভাগ করে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ছেড়ে দেবে। তারপর আপনারা মুক্ত। শুধু অনুগ্রহ করে খেয়াল রাখবেন কোনো অচেনা লোক অর্থাত সাংবাদিক আপনাদেরকে অনুসরণ করছে কিনা। জী, নগরীর বিভিন্ন জায়গায় আপনাদেরকে গাড়িতে নেয়া হবে।

‘আমরা সাংবাদিকদের ইতোমধ্যে বলেছি, আপনাদেরকে আমরা আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ওরা বিশ্বাস করেনি। আমরা ওদেরকে অফিস থেকেও বের করে দিয়েছি। কিন্তু ওরা এখনও সদর দরজার কাছে ভিড় করে আছে।

‘তাহলে, ঠিক আছে। আপনারা সময় হলে একে একে বাদুয়ে দুয়ে বেরুবেন। আমি সান্ত্রিকে আদেশ দেব। সে একটু পর পর এসে দরজা খুলে দেবে। আচ্ছা চলি।’
তার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা চলে যায়।

‘বন্ধুরা, এইটা কী ধরনের মুক্তি আমার মাথায় ঢুকল না। লোকটা আমাদেরকে এমন একটা মতলব দিয়ে গেল, যা ভেবে আমার বুক কেঁপে যাচ্ছে। আপনারা কি বুঝতে পারলেন, সে আমাদেরকে পালানোর বুদ্ধি দিয়ে গেল। এখন, ধরেন, যখন আমরা কাঁটাতারের বেড়া পার হচ্ছি বা টপকাচ্ছি, যদি তখন ওরাগুলি শুরু করে। আমার রক্তাক্ত দেহ সেখানে পড়ে আছে ভেবে আমার রক্ত হিম হয়ে আসছে,’ কথা কয়টি বলে শ্যামল চিল বসে পড়ে।

‘আপনারা তো দেখলেন, আমি কতো সুন্দরভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলাম সাংবাদিক ভাইদের। তাদেরকে চকোলেট চ্যুইংগাম খাবার জন্য কিছু মুদ্রা দিলাম। আমার মনে হয় ওরা কিছু করবে না। তবু এরা কী-কারণে আমাদেরকে এত জটিলভাবে ছাড়তে চাচ্ছে বুঝলাম না। সামনের সদর দরজা দিয়ে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যাব। কে কী বলবে? না, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হল না,’ মিয়ান টিনটুই বলে।

‘আপনারা এত ভীতু,’ বলে রজেট চিনচুই তিরস্কারের স্বরে। ‘আমাদেরকে গুলি করলে এই থানা ঘেরাও হয়ে যাবে। আমরা নামহীন গোত্রহীন নই। আমাদের পরিচিতি আছে। সুপরিচিতি। আমি মনে করি না, এরা কোনো ঝুঁকি নেবে বা এদের কোনো মন্দ উদ্দেশ্য আছে। আপনারা নির্ভয়ে বেরুতে পারেন।’

‘বিশ্বাস করে ঠকবেন না,’ সতর্ক করে দেয় জিয়াফ ব্যানব্যাট। ‘যখন থেকে এই বিপদে পড়েছি, আমার কপালের দুই দিকে চমকাচ্ছে। আমার মন বলছে, খুব খারাপ কিছু ঘটবে, ঘটতে চলেছে। যখন এই অফিসারটা সবিস্তারে আমাদের মুক্তিদানের পরিকল্পনা বলল, ওটাকে আমার মনে হল, একটা গভীর চক্রান্তের অংশ। আমরা পালাতে চেষ্টা করব থানা থেকে। দু’একজন মারা যাবে। দু’একজন গুলি খেয়ে পঙ্গু হবে। আর সবাই জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করার অতিরিক্ত একটা মোকদ্দমায় পড়ে যাব। আমার এভাবে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছে না।’

তারা এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলে চলে, কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে দেবার কোনো উদ্যোগই দেখা যায় না। উদ্যোগ বলতে বোঝায় গরাদ-দরজার তালাটা খোলা ও যেতে বলা, কিন্তু সেটুকুই ঘটে না দীর্ঘক্ষণ।

‘আমাদের সন্দেহ অমূলক, সেইসঙ্গে আমাদের সন্দেহের যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। দেখুন সেই কতক্ষণ আগে ওরা ঘোষণা দিল, ছেড়ে দেবে, কিন্তু এখনও কি দিল? কারণও তো ওরা বলে গেল, সাংবাদিকরা গিজগিজ করছে,’ ইমুস ক্যাটস্ হাসিমুখে বলে। ‘পুলিশরাও মানুষ। এই যে এতক্ষণ আমরা ওদের আতিথ্যে আছি, ওরা কি আমাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছে? কী বলছেন? রিমান্ডে নেবার ভয় দেখিয়েছে? এতটা সময় গেল একবারও খেতে দেয়নি। ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমরাও তো ওদের জেনারেলের ভয় দেখিয়েছি। ভদ্রভাবে কথা না বলে, প্রথম থেকেই ওদের ভয় দেখিয়ে এসেছি। আর ওরা কোত্থেকে খেতে দেবে? এ-জন্য সরকার ওদের কোনো তহবিল দেয় না। ওরা কি ওদের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে আমাদের খাইয়ে, নিজের পরিবারবর্গকে অনাহারে রাখবে?’

‘আপনি যতই বক্তৃতা দেন আর ওদের মহত্বের কথা বলেন আমি কোনোদিনও তা বিশ্বাস করব না,’ রজেট চিনচুই, ইমুস ক্যাটস-এর কথার মাঝপথে বাধা দেন। ‘এই যে দেখুন ওরা বলে গেল, ছেড়ে দেবে, কিন্তু দিচ্ছে না, কেন দিচ্ছে না, বলুন তো? ওরা ঘুস চায়। কিন্তু আমাদের কাছে চাইতে পারছে না।’

‘এই যে এতগুলি ঘণ্টা কেটে গেল, একজন পুলিশও প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে, পরোক্ষে বা অপরোক্ষে কি আমাদের কাছে ঘুস চেয়েছে?’ প্রশ্ন রাখলেন ইমুস ক্যাটস্। তারপর নিজে নিজেই উত্তর দেন, ‘না, চায়নি। এখন পুলিশে কাজ করে শিক্ষিত লোকেরা। তারা কমপক্ষে এসএসসি পাশ। এখন পুলিশে ভূরিভূরি বিএ-এমএ পাশ লোক কাজ করে।’

‘দয়া করে, আপনার সত্কল্পনাকে মাছের মতো কুটে বেছে ধুয়ে, কড়াইয়ে তেল দিয়ে ভাজুন ও কুড়মুড় করে চেবান,’ চিকচাকরুই বলে ওঠে। ‘তাদের শিক্ষাদীক্ষার অনন্য সাধারণ নমুনা হল কোনো পরোয়ানা ছাড়া আমাদেরকে আটক করে হাজতে ফেলে রাখা। আর এই যে সাংবাদিক, সাংবাদিকরা ধরে ফেলল, খেয়ে ফেলল। কে ওদেরকে ডাকল? কে ওদেরকে আমাদের পরিচয় বলল? এখন ওদের মামাত ভাই সাংবাদিকদের জন্য আমাদেরকে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হবে?

‘বুঝলেন, জীবাণু। পুলিশ একটা জীবাণু। আপনি একটা মানুষ। একটা ভদ্রলোক। একটা নিরীহ লোক। আপনি যেই পুলিশে ঢুকলেন, আপনার শরীরে পুলিশের জীবাণু ঢুকে গেল। আপনি হুকুম তামিল করতে শুরু করলেন। যা বলা হল, আপনি তাই করতে লাগলেন। আপনার আমার কাছে যা সহজ সাধারণ ঘটনা, ছোটখাট তর্কবিতর্কের ব্যাপার সেটাই পুলিশের হাতে পড়লে কোর্ট কাচারির ব্যাপার। ৭ মিনিটের ব্যাপার পুলিশের হাতে পড়লে ৭ বছর ধরে চলে। এটা আমাদের দেশ, আমরা ভাই ভাই। আমাদের একথা সেকথা কাজিয়া ফ্যাসাদ ঝগড়া বিবাদ হবে। আমরা নিজেরাই মেটাব। কেন আমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক পুলিশ সেজে সারাজীবন আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে থাকবে?’
(চলবে)