ইচক দুয়েন্দে : ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেন ইচক দুয়েন্দে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পদ্মা-বিধৌত নগরী রাজশাহীতে। কাজ করেছেন কৃষি খামার পরিচালক, গ্রন্থ সম্পাদক এবং ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে। ইচক দুয়েন্দে’র অন্য বই: We Are Not Lovers (ইংরেজি উপন্যাস) এবং টিয়াদুর (মহাগপ্প)।

৪.
‘কী অপরাধ আমাদের?’ মিয়ান টিনটুই বলে। ‘আমরা কি খুন করেছি? আমরা কি ছিনতাই করেছি? আমরা কি ডাকাতি করেছি? আমরা কি চুরি করেছি? কেন আমরা হাজতে? কী আমাদের অপরাধ? আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এই নগরীতে এমনকি একটা কাকও বলতে পারবে না, কখনও তাদের একটা ঢিল মেরেছি। কোনোদিনও একটা বেড়ালকে লাত্থি মারি নাই। গরিবকে কোনো দিন ছোট চোখে দেখি নাই। অম ভিখারির জন্য স্কুলে পড়াবস্থায় একবার সঞ্চিত পাঁচ টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। হায় প্রভু, এই তোমার বিচার! আমার সকল মানসম্মান লুণ্ঠন করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী-গাঁজাখোর-মাতালের সঙ্গে এক কাতারে ফেলে আমায় জেলে ঢোকালে?’

‘অজ্ঞতার অভাবে,’ লালু পাঞ্জুমম মৃদু হাসে। ‘অর্থাৎ আমি ইচ্ছা করলে এইখানে এই হাজতঘরে আপনাদের সঙ্গে নাও আসতে পারতাম। এক্কেবারে পরিষ্কার। ওনারা আপনাদের সব্বার হাতে খট্টস হ্যান্ডকাপ হাতকড়া পরালেন। আমার হাতে পরালেন না। আপনাদেরকে গরুভেড়ার মতো তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন ওনারা। আমার জানটা কেমন করে উঠল। বললাম, আমারেও হ্যান্ডকাপ লাগান। ওনারা বললেন, আর হ্যান্ডকাপ নেই। আমি আপনাদের পেছন পেছন গাড়িতে উঠে পড়লাম। এই যাকে বলে অজ্ঞতার অভাবে। আমার কিছু কিছু দোষ আছে। যেমন ধরেন আমি নাক খোটলাই। আমার কয়েকটা মাড়ির দাঁত নেই। এছাড়া কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখি ও মওকামতো বিক্রি করি। তিনিই জানেন, কেন তিনি আমাকে এখানে রেখেছেন। আমার বউ একটু চিন্তা করছে। আমি নাই। আমে রাতে ফিরলাম না। আমি কোথায় গেলাম। আমার চরিত্র ভালো। তিনি বেশি চিন্তা করবেন না।’

‘আমার আর কোনো ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না,’ ফিজ ফ্যাল নিশ্চিতভাবে বলে। ‘আমার বউ বলবে তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছিলে। ভালো মানুষকে হাজতে পুরবে কেন? ছি ছি ছি তুমি মাদকদ্রব্য চোরাচালান করতে! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। তোমার কোনো দোকান নেই, পাট নেই, নেই কোনো ব্যস্ততা। কোত্থেকে তুমি টাকা কামাও? বুঝলাম তুমি চোরাকারবারি। আমার ভাই বলবে, ছি ছি ছি তুই বংশের কলঙ্ক। পাড়ায় আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। লোকে ভাবে আমার অনেক অনেক টাকা। কেন ভাবে তাও আমি জানি। সব সময় আমার মুখে থাকে হাসি। অবলীলায় আমি ফিরিয়ে দিতে পারি বড় বড় চাকরির অফার। লোকে তো ভাববেই আমার অফুরন্ত টাকা। ভোঁ ভোঁ। আমার পকেট একদম ফাঁকা। যদি এরা সত্যিই মামলায় ফেলে দেয়, জানি না কোত্থেকে দেব উকিলের টাকা।’

‘ইয়ে বাসুসুমে কিনসু ভি কুয়াকাটা হ্যয়,’ তিয়াস ঠিসটক অত্যন্ত প্রফুল্ল মনে বলে ওঠে। ‘মিস্টার ইমুস ক্যাটস্, কী খবর? আপনার তদবিরে কী ফল ফলল? আমরা কেন এখনও ছাড়া পেলাম না? আমরা কি আদৌ ছাড়া পাব? না কি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের তোলা হবে আসামির কাঠগড়ায়? হুঁ! আচ্ছা! আমার মন বলছে আমাদের উঠতে হবে না কাঠগড়ায়। কচু। কিসসু হবে না। আমি নাই। আমি বাড়িতে নাই। কেউ আমার খোঁজ করবে না। কেউ আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে না। কেউ জানবে না। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।’

‘আমার মনে হয়। বা আমি বিশ্বাস করি। বা আপনারা ধরে নিতে পারেন। আমি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি,’ ইমুস ক্যাটস্ দ্বিধান্বিত চিত্তে বলে।

‘কালকে রাতে দেখলাম আমার নিজের চোখে, এক সারি পিঁপড়া, লাল ছোট ছোট পিঁপড়া, পিল পিল করে পিঠে খাবারের বোঝা নিয়ে চলেছে, এই ঘরের মধ্য দিয়ে। কোনো সান্ত্রি জোর করে তাদের ঢোকায় নি হাজতঘরে। নিজ ইচ্ছায় আপন আনন্দে তারা করে চলেছে শীতের খাবার সঞ্চয়। মনে হল আমরা সব্বাই ঐ পিঁপড়েগুলির চেয়েও অধম। কোনো পিঁপড়ে তার সহজাতি পিঁপড়েদের গ্রেফতার করে হাজতে পোরে না। কিন্তু আমরা পুরি। হে প্রভু, কেন তুমি আমাদের এত নিকৃষ্ট করে সৃষ্টি করেছ?’ ফিটিক চ্যাক হাহাকার করে। ‘আমাদেরকে ভাবতে হবে। তছনছ করে দিতে হবে। আমার রক্ত গরম হয়ে উঠছে। আমি হয়তো বিপ্লবী হয়ে যাব আগামী দিনে।’

অলংকরণ : উদাস আব্দুল্লাহ

‘ননসেন্স,’ অত্যন্ত মৃদু স্বরে শ্যামল চিল বলে। ‘হ্যালুসিনেইশন। বিভ্রম। সুস্পষ্ট বিভ্রম। আপনাদের সব্বারই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রাবিশ। মিস্টার ফিটিক চ্যাক, এটা শীতকাল। এখন পিঁপড়াদের দেখবার কোনো প্রশ্ন উঠছে না। আপনি গত রাতে পিঁপড়া দেখেননি এখানে। প্লিজ আবোল তাবোল বকবেন না। আমি একদম আবোল তাবোল কথা সহ্য করতে পারি না। পৃথিবীতে আপনারাই প্রথম হাজতঘরে ঢুকলেন না। আপনাদের আগেও কোটি কোটি লোক লালঘরে ঢুকেছিল এবং আপনারা মরেটরে ফৌত হবেন, পচে মিশে যাবেন মাটিতে এবং আরো কোটি কোটি লোক ঢুকবে লালঘরে। এই কাহিনী শেষ হবে না। আপনারা এখানে আরামে আছেন। আপনাদের কেউ লাত্থি মারেনি। ধাক্কা মারেনি। বাজে খিস্তিখেউর করেনি। বসতে দিয়েছে। হাতকড়া নিয়েছে খুলে কয়েক মিনিট পরে। আপনাদের জন্য তদবির চলছে। ছাড়াও পাবেন হয়তো কয়েক মিনিট পরে। দয়া করে নাটক ড্রামা যাত্রা করবেন না। শান্ত থাকেন।’

‘আপনি আমার যুক্তিকে ধুলিসাৎ করে দিলেন। রাবিশ বললেন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আপনারা মানুষরা খুব খুব জঘন্য। আপনাদের সঙ্গে মেশা যায় না। কবুতরদের দেখুন তারা বাক্বাকুম বাক্বাকুম করে। শুধু বন্ধুত্ব। তারা শুধুই বন্ধুত্ব করে। কোনো ঝগড়াঝাঁটি খুন খারাবি নেই। দেখুন আমরা এখানে যারা আছি প্রায় সব্বাই মাস্টার ডিগ্রি হোল্ডার। যিনি আমাদের ধরলেন তিনিও মাস্টার ডিগ্রি হোল্ডার। কিন্তু তবুুও তিনি আমাদের কুকুর বেড়ালের মতো ধরে ফেলবার আদেশ দিলেন। ছি ছি ছি,’ শ্যামল চিলের যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেষ্টা করে ফিটিক চ্যাক।

‘আপনাদিগের সৌভাগ্য,’ শ্যামল চিল সান্ত¡না দেয়। ‘আপনারা প্রত্যেকেই পাপী। বাট্ ছিঁচকে পাপী। আপনারা বড় বড় ডায়ালগ মারতে ওস্তাদ। জানেন, প্রাচীনকালে লালঘর ছিল না, জরিমানা ছিল না। অপরাধী ধরা পড়লে মারা হত চাবুক অথবা কেটে নেয়া হত গর্দান, চড়ানো হত শূল বা ফাঁসি কাষ্ঠে। বাঁইচে গেছেন। আল্সার দল। শুধু বড় বড় বক্তৃতা।’
তাদের হাতে হাতকড়া পরবার পর, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তারা বিশ্বাসই করতে পারে নাই যে তারা আটক। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এ কোনো ভ্রম নয়, নয় কোনো বাস্তব রসিকতা, সত্যিই তারা আটক। যে-সামান্য অজুহাতে তাদের ধরা হয়েছে, তাকে তারা একটা অজুহাত বলে মানতেই পারে না। এই যেমনটা আমরা ভাবি, এক রকমের পাপ করে আরেক রকমের বিচার পেতে হয়, তাদের ভাবনার ধারাটা হয়ে ওঠে অনেকটা এরকম। কীভাবে কত দ্রæত এই আটক অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে, সেটিই তাদের মূল ভাবনা। তার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে তাদের মনে উঁকি দিয়ে যায় তাদের বিগত জীবনের নানা ঘটনা, উপঘটনা, ছোটখাট বা বড় পাপ-পুণ্য। শ্যামল চিলের আকস্মিক আক্রমণে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। ঐ স্বল্পস্থায়ী হাজতবাসে তাদের মন হয়ে গেছে অসাড়। তারা গুনগুন করে অনেক যুক্তি সাজায়, শ্যামল চিলকে উচিত জবাব দেবার জন্য, কিন্তু মুখ ফুটে একটিও শব্দ বের করতে পারে না।

৫.
‘তিথি বরাভয়-এর কথা শুনলে, আজকে আমার এ দশা হয় না,’ ভাবে পুঁই চুলভি। ‘আমার এইসব আঁতলামি ভালো লাগে না। একটা মিশুক নিতাম। দু’জনে মিলে চলে যেতাম নগরীর সব সব কোলাহলের বাইরে। মিশুক গ্রামের মধ্যে এক নির্জন মাঠের মধ্যে থামত। হলুদাভ সবুজ ঘাস। বসতাম সেখানে আমরা। গাছে গাছে ঝরা পাতা। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস। একবারে তরতাজা।

‘তিথি তার খরগোসের মতো পিটিপিটি চোখ মেলে ঝিলিমিলি বিস্ময়ে তাকাত। একটা ঘাস তুলে নিয়ে সে মুখে পুরে দিত। সে জিজ্ঞেস করত, ‘বলো তো ঘাস সবুজ কেন?’ আমি বলতে পারতাম না। কারণ আমি তো উত্তরটা জানি না।
‘তিথি তখন হাসত। তিথি বরাভয়ের দাঁতগুলো খুব যে সুন্দর তা বলা যায় না। তবু আমার প্রিয় বান্ধবী তো, আমি বলতাম, ‘তোমার দাঁতগুলো দুর্দান্ত, ইস্, আমারগুলো যা পচা।’
‘না, এখন কী যে বিপদে পড়লাম। আমার মাকে যে কী করে সামলাব? তিথিকে নিয়ে ভয় নাই। একটা বিরাট রোমহর্ষক গল্প ফেঁদে বসব।

‘বলব, ‘তোমার কথা না শুনে খুব ভুল হয়েছিল। তোমার বরদোয়া লেগে গেল।’ না ঠিক এ-ভাবে শুরু করাটা ঠিক হবে না। তিথি আবার মাইন্ড করবে। বলব, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে নাস্তাটাস্তা শেভটেভ গোসলটোসল সেরে রাস্তায় নামলাম। দ্রæত হাঁটছি। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন মিস্ড্ কল পাচ্ছি। যেতে যেতে তোমাকে একটা এসএমএস করলাম।’ হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে এ-ভাবে বললে জমবে। কী-যে মনোযোগ দিয়ে শুনবে আমার ছোট্ট খরগোসটা কানখাড়া করে। তারপর বলব, ‘দোস্ত বুঝলা একটা ঠোলা যাচ্ছিল। আমি একটুও খেয়াল করি নাই। হঠাৎ ওর পায়ের উপর আমার পড়ে গেছে পা।

‘আমি প্রথমেই ‘স্যরি’ বলছি। তারপরেই আমি বলছি, ‘আমি গভীরভাবে দুঃখিত। আপনার কি খুব লাগছে?’ সে খামাকা গালাগালি, চিৎকার চোটপাট শুরু করল। আমি এত শান্ত মানুষ, কিন্তু সামলাতে পারলাম না নিজেকে, ‘বললাম, আমি একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক, আপনার যেমন আছে, আমারও তেমনি রাস্তা দিয়ে চলবার স্বাধীনতা আছে।’ কিন্তু সে বলে, ‘থানায় চলেন।’ লোকজন আমাদেরকে ঘিরে রাখল। আমি জোরে জোরে প্রতিবাদ করলাম। গাড়ি এল। আমাকে গাড়িতে তুলে ফেলল। ‘কর্তব্য পালনে বাধা প্রদানের সময়ে আমাকে গ্রেফতার করা হল।’

‘তিথি বলো এই দেশে কি থাকা যায়? চলো যে-দিকে দু’চোখ যায় চলে যাই। এই দেশে আর আর কোনোদিনও ফিরব না।
‘হয়তো আমার মন কেমন করবে আমার মায়ের জন্য। কিন্তু তাকেও নিয়ে চলে যাব সঙ্গে।
‘বাসায় থাকলে আজ সকালে খেতাম হাতে বানানো পাতলা ফিনফিনে তিনখানা রুটি, পেঁপে দিয়ে রান্না বুটের ডাল, একটু বুটের হালুয়া। শেষে এক কাপ ধূমায়িত দুধ চা। চা খেতে খেতে এসে যেত খবরের কাগজ। দেখতাম হেডলাইনগুলো। কতো খবর। কিন্তু কনোই মনে হত না আমি হয়ে যাব নিজেই খবর।

‘আমি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী হয়ে যাবার কথা ভাবছি। মাছও নয়, মাংসও নয়। শুধু শাকসবজি। কিছু দুধ মুড়ি খই। এই যে আমার খাদ্যাভ্যাস এবং সেই সঙ্গে বিদেশ চলে যাওয়া, তিথি বরাভয় বলে, এই দু’টোর একটা দ্ব›দ্ব আছে। দ্ব›দ্ব তো থাকবেই। আমার ডান হাত আমার বাম হাতের মঙ্গল চায় না। আমার বাম পা আমার ডান পায়ের মঙ্গল চায় না। কিন্তু তিথি বরাভয় আমার মঙ্গল চায়। আমার মা আমার মঙ্গল চান। তিথি-র কোনো দুঃখ হোক সেটা আমি চাইব না। ধরা যাক, তার মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। এমন হলে আমার মনে খুব দুঃখ হবে। বলতে নেই, আমার মনে তিথির চেয়েও ভীষণ উদ্বেগ ও দুঃখ হবে। আমি ভাবব, আমি খুবই ভাবব তার ভালো চিকিৎসার জন্যে। আমি চেষ্টা করব একজন শ্রেষ্ঠ ডাক্তার খুঁজে বের করতে। আমার খুব কষ্ট হবে, তিথির যে-কোনো দুঃখে আমার এতটা কষ্ট হবে যে সেটা ঠিক আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

‘আমার মনটা কোমল। আমার প্রিয় উদ্ভিদ লজ্জাবতী লতা। মিমোসা। কর্কশ কিছু আমার ভালো লাগে না। পুরুষদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না। যদিও আমি একজন পুরুষ। পুরুষদের আমার জান্তব মনে হয়। মেয়েদের আমার অনেক অনেক বেশি মানুষ মনে হয়। তাদের হৃদয় আছে। তাদের মন আছে। তাদের সর্বোত্তম নিষ্ঠুরতা পুরুষদের চিমটির সমান। এই ঘরটায় এই এতগুলো মানুষের, পুরুষ মানুষের সঙ্গে থেকে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এরা সব্বাই আমার বন্ধু। হ্যাঁ এরা, এরা আমার বন্ধু। অসহ্য! অসহ্য! আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমার মা’র কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। এদেরকে আমার একদম ভালো লাগছে না। এই সান্ত্রিরা বর্বর। আমার বন্ধুরা বর্বর। এদের কারো মধ্যেই প্রার্থিত কোমলতা নেই। এরা কেউ সভ্য নয়। এদের রক্তে এখনও নেচে চলেছে বর্বরতার কৃমি।

‘পৃথিবীটা যদি আমার আর তিথির মতো মানুষে ভরা থাকত তাহলে এখানে কোনো যুদ্ধ হানাহানি মারামারি কাটাকাটি খুনখারাবি ঝগড়া বিবাদ গণ্ডগোল কোন্দল ভুল বোঝাবুঝি থাকত না। তিথি যখন বলে, ‘চলো নদীর ধারে যাই’ আমি অনায়াসে বলি ‘চলো যাই’। কিন্তু অন্য মানুষেরা কী করে? তারা কথায় কথায় ঝগড়া করবে। ছোট্ট ব্যাপারকে বিশাল বানিয়ে ফেলবে। এরা জটিলতায় ভোগে। হ্যান করেঙ্গা ক্যান করেঙ্গা। বাস্তবে এরা ফুটা কাপ্তান। এদের সঙ্গে আমি যে কী করতে মিশেছি! তিথি আমাকে কতোবার বলেছে। বলেছে, ‘মনের মতো লোকের সঙ্গে মেশ। যাদের সঙ্গে তোমার মেলে। তোমার একটা সম্মান আছে। তুমি বোঝ না। পৃথিবীটা অসরল।’ তিথির কথা না শোনারমূল্য দিচ্ছি আজ। তিথি আজ তোমাকে কথা দিলাম, আর কনো আমি তোমার কথার অবাধ্য হব না।

‘আমার বন্ধুগুলো বর্বর ও অপরিণামদর্শী। পৃথিবীতে যে কারাগার আছে, লালঘর, হাজতঘর আছে, তা এদেরই জন্য, এদেরকে ঠিকঠিকভাবে শায়েস্তা করবার জন্য। ওরা দেখতে পেল, একজন অত্যন্ত সম্মানিত বড় কর্তা ওদের কাছে এসেছেন। তার সঙ্গে মেপে হিসেব করে প্রয়োজনীয় কথা বল। ওয়াক ওভার দাও। না, ও মা, তর্ক! কথার ফুলঝুরি। সব জায়গায় ওস্তাদি কাজ করে না। সব জায়গায় এত কথা বলতে নেই। আমি তো সবসময় চুপচাপ ছিলাম। নাম জিজ্ঞেস করল, বললাম। পিতার নাম, বললাম। ঠিকানা, তাও বললাম। তারপর চুপ মেরে গেলাম। আর একটাও কথা বললাম না। এখন এরা ইতিহাস খুঁজছেন কারাগারের। গবেষণা করছেন। ভালো লাগে না। আমি নিজের কাছে স্পষ্ট। আমি তিথিকে ভালবাসি।

‘আমার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আমি এদেরকে একটুও বুঝতে দেব না। কিন্তু এদের সঙ্গে আমি আর মিশব না। এদেরকে খরচ করে ফেলব। দেখা হবে হাসব, কথা বলব, চা খাওয়াব। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। কোনো পার্টি, নো। কোনো পিকনিক, নো। বেড়ানো, নো। আড্ডা, নো। এদের সঙ্গে এসব চলে না। মাঝে মাঝে হাই হ্যালো করব। বুঝিয়ে দেব, আমি তাদের সঙ্গে আছি, আসলে কিন্তু আমি নেই। আমি চলে গেছি যোজন যোজন দূরে। আসলে আমি অন্যরকম। অনেকটাই অন্যরকম। আমাকে কেউ বোঝে না। এরা এন্তার বেন্তার কত কথা বলে চলেছে। এরা কেউ কি আমার মনের খোঁজ নিল? না, এরা নিজেদের জাহির করাতেই ব্যস্ত। তিথি আমাকে বুঝতে পারে। তিথির জন্য আমার মনটা কেমন করছে। প্লিজ তিথি, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। ছাড়া পাই, তোমার কথামতো আমি ধূমপান করব না আর। কথা দিচ্ছি। প্লিজ।’ (চলবে)