ফরিদ আহমেদ : আমার বা আপনার কাছে প্রস্রাব যতই দুর্গন্ধযুক্ত হোক না কেনো, আমেরিকান পুরুষ লবস্টারের কাছে মূত্র মন্ত্রের কাজ করে। এই মন্ত্র দিয়ে একাধারে যেমন প্রতিদ্ব›দ্বী পুরুষদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়, অন্যদিকে নারী লবস্টারদেরও শুধু মন্ত্রমুগ্ধই নয়, একেবারে মূত্রমুগ্ধই করে ফেলা যায়।

মেটিং সিজনে দূর দূরান্ত থেকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসে লবস্টারেরা। সাগর তীরের কাছাকাছি অগভীর পানিতে বাসা বানায় পুরুষ লবস্টার। বালুতে গর্ত করে এই বাসা বানানো হয়। মোটামুটি দুইজনের জায়গা হয় এমন আকারের গর্ত খোঁড়ে তারা। সে আর তার সম্ভাব্য প্রেমিকার জায়গা হলেই চলবে। এর জন্য নীড় ছোট হলেও ক্ষতি নেই, সাগরটাতো বড়।
বাড়ি বানিয়ে প্রেমিকার অপেক্ষায় বসে থেকেও শান্তি নেই। এমন বাড়ি বানিয়ে চারপাশে আরো অসংখ্য প্রেমিককুল তৃষ্ণার্তের মতো বসে আছে। প্রতিদ্ব›দ্বীদের এই ভিড়ের নিজের প্রেমিকা জুটবে কিনা, সবচেয়ে সুন্দরীটার হাত ধরার সুযোগ হবে কিনা, সেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় সকলে। এই দুশ্চিন্তা থেকে মেজাজও যায় রুক্ষ্ম হয়ে।

এই রুক্ষ্ম মেজাজের সময়ে মূত্র ছুড়ে দিতে থাকে তারা এদিক সেদিকে। এই মূত্র ছুড়ে দেবার পিছনে দুটো উদ্দেশ্য থাকে। এক : প্রতিদ্ব›দ্বীদের দেখানো যে ‘দ্যাখ ব্যাটা আমার প্রস্রাবের গন্ধ কতো তীব্র। ভালো থাকতে সরে পড় আমার আশপাশ থেকে।’ দুই : সুন্দরীদের জন্য এটা সংকেত হিসাবে কাজ করে। ‘আমি আছি এখানে, সময় হইলে কফি খাইতে আইসো।’
সুন্দরীদের জন্য সংকেতের উত্তর আসতে দেরি হয় তাদের দেমাগের কারণে। তবে, প্রতিবেশী প্রতিদ্ব›দ্বীদের থেকে দ্ব›দ্ব যুদ্ধের আহবান আসতে সময় লাগে না মোটেও। নিজের এলাকাকে প্রতিদ্ব›দ্বী শূন্য রাখতে রক্তাক্ত দ্ব›দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয় পুরুষ লবস্টারেরা। এই লড়াইটা হয় দেখার মতো, মাইক টাইসন এবং ইভান্ডার হলিফিল্ডের মতো হেভিওয়েট বক্সিং এ নামে তারা।

আমরা বাজার থেকে যে সব লবস্টার কিনি, সেগুলো সাধারণত দুই বা তিন পাউন্ডের বেশি হয় না। কিন্তু, এটা লবস্টারের আসল আকৃতি না। লবস্টারের আকৃতি এর থেকেও ঢের বেশি হয়ে থাকে। ২০০৬ সালে স্যান ডিয়েগোর সমুদ্র উপক‚লে একজন ডাইভার বারো পাউন্ড ওজনের লবস্টার ধরেছিলো। ক্যানাডিয়ান একজন ক্রু ধরতে সমর্থ হয়েছিল বিশ পাউন্ড ওজনের লবস্টার। গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে চুয়াল্লিশ পাউন্ড ওজনের লবস্টারের কথা উল্লেখ আছে। সেটা ধরা হয়েছিলো ১৯৭৭ সালে নোভা স্কশিয়াতে। যার দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় চারফুট।
এ রকম দৈত্যাকার দুই ক্ষিপ্ত পুরুষের লড়াই কতখানি তীব্র হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। এই লড়াইয়ে জেতার পরে বিজয়ী পুরুষটা বিজয়ের আনন্দে মূত্র ত্যাগ করে। বোস্টন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জেল আটেমার গবেষণা করে দেখিয়েছেন, পরাজিত পুরুষ লবস্টার তার প্রতিদ্ব›দ্বীর মূত্রের গন্ধ মনে রাখে। ফলে, অন্তত সপ্তাহ খানেক সে আর তার সাথে লড়াই করতে আসে না।

এ রকম বহু লড়াইয়ের বিজয়ী যে, তার মধ্যে এক ধরনের অহমিকা চলে আসে। নিষ্ঠুর সব আচরণ করতে থাকে সে। আশেপাশের প্রতিদ্ব›দ্বীদের বাড়িতে গিয়েও হামলা চালানো শুরু করে। হামলার শুরুটা হয় বাড়ির সামনে গিয়ে মূত্র ত্যাগের মাধ্যমে। ওই গন্ধ শুনলেই বাড়ির বাসিন্দা পালিয়ে যায় খিড়কি দরজা দিয়ে। তখন এই বিজয়ী গিয়ে ঢোকে সেই বাড়িতে। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নয়, কিছুক্ষণ সেখানে থেকে সে চলে আসে। বাড়ি দখল করা নয়, বরং কে এই এলাকার আসল রংবাজ, সেটা দেখানোই মুখ্য উদ্দেশ্যে থাকে তার।
এমন একজন আক্রমণাত্মক এবং শক্তিশালী পুরুষের প্রতি সুন্দরী লবস্টাররা আকৃষ্ট হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হচ্ছে এই বুনো মেজাজের পুরুষ যে তারও কোনো ক্ষতি করবে না, তার নিশ্চয়তা। ভয়ংকর এক ভয় এবং অদ্ভুত আকর্ষণের এই দোলাচলে ভুগতে থাকে নারী লবস্টার।

‘লাল-সবুজের পালা’ ছবিতে তারেক আনাম একজন রুক্ষ্ম মেজাজের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সাধারণ মানুষকে শোষণ করে খাওয়া আসাদের লাঠিয়াল ছিলেন তিনি। আসাদের স্বার্থ দেখার জন্য একে তাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেওয়াই ছিলো তার কাজ। রাগী এই লাঠিয়ালকে সমঝে চলতো মানুষ। এই কঠিন ধরনের ভয়ংকর মানুষটারই প্রেমে পড়ে যান সুচরিতা। তারেক আনামের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে থাকেন তিনি। ফলে, পথে ঘাটে নানা জায়গায় তাঁকে উত্যক্ত করা শুরু করেন তিনি। অন্যেরা তারেক আনামকে প্রচণ্ড ভয় পেলেও, তার মধ্যে সেই ভয়ের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায় না।
সাগরের নীচের নারী লবস্টার সুচরিতার মতো ভয়ডরহীন হতে পারে না। ফলে, সে নেয় ভিন্ন একটা স্ট্রাটেজি। সুচরিতার মতো টিজিংও করবে, আবার নিজের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে তার। ওই মেজাজি পুরুষের বাড়ির সামনে যায় সে অতি সতর্কতার সাথে। তারপর খানিকটা মূত্র ত্যাগ করেই পালিয়ে যায় সে দ্রুত গতিতে। পুরুষটা তাকে ধরার জন্য ঝাঁপ দেয়, কিন্তু তার আগেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় নারী লবস্টারটা।

এই মূত্র ত্যাগের খেলায় লবস্টারের একটা সুবিধা আছে। বেশিরভাগ প্রাণীরই বর্জ্য নিষ্কাশিত হয় মাথা যেদিকে তার উল্টোদিকে। লবস্টারের বর্জ্য থাকে তার মাথায়। চিংড়ির গু থাকে তার মাথায়, এই কথাটা আমরা বহুবার শুনেছি। সেটা আসলেই সত্যি। চিংড়ির বর্জ্য তার মস্তিষ্কের ঠিক নীচেই থাকে। এখান থেকেই নলের মাধ্যমে লবস্টার তার মূত্র সামনের দিকে ছুড়ে দিতে পারে।
প্রেমে পড়া ভীতু প্রেমিকার এই টিজিং প্রতিদিন অব্যাহত থাকে। প্রতিদিন সে প্রেমিকের বাড়ির সামনে আসে। মূত্র বিসর্জনের কাজ করে, আর তারপর দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মাটির কলসির ঘষাতেও পাথরের ক্ষয় হয়, আর এতো সুন্দরী নারীর প্রলোভন। একসময় ধীরে ধীরে মেজাজি পুরুষটা নরম হয়। তার বাড়িতে ঢোকার সুযোগ করে দেয় সুন্দরীকে। বাড়িতে ঢুকলেও, শুরুতেই স্থায়ী আবাস সেখানে গড়ে না সুন্দরী। কিছুক্ষণ থেকেই নিজের বাড়ির দিকে চলে যায়। এর কারণ হিসাবে লবস্টার কনজারভেন্সির বিজ্ঞানী ডায়ান কাওয়ান বলেছেন, এই নারীর লবস্টারের এই অস্থায়ীভাবে থাকাটা এক ধরনের পরীক্ষা। সে দেখতে চায় পুরুষটা সত্যি সত্যি এই বাড়ির মালিক কিনা, এর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে আছে কিনা, নাকি অন্য কেউ এসে তাকে ঘর থেকে বের করে দেবে। তখনতো গাছের তলায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতে পস্তানোর চেয়ে কবুল বলার আগেই সবকিছু বুঝে নেওয়া ভালো। শুধু নারীটাই যে এই যাচাই-বাছাই করে, তা নয়। পুরুষও এই সময়টাতে নারীটাকে পরীক্ষা করে। তার সন্তানের মা হবার জন্য এ প্রস্তুত কিনা, পেটের নীচে অগুনতি ডিম আছে কিনা, ভবিষ্যতে ভালো জিনের সন্তান জন্মাবে কিনা, সেটা দেখে নেওয়াটাও তার দায়িত্ব।

দুই পক্ষ সন্তুষ্ট হবার পরেই নারী লবস্টার স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চলে আসে পুরুষের বাড়িতে। সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই শুরুটা হয় খোলস বদলের মাধ্যমে। নারী লবস্টার তার খোলস বদলে ফেলে। লবস্টারের ডিম থাকে শরীরের বাইরে। ফলে, খোলস বদলের সাথে সাথে পুরনো ডিম পরিত্যক্ত হয়। সেখানে অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শ থাকলেও, সেই স্পর্শ ধুয়ে মুছে যায়। খোলস বদল করে নতুন করে কুমারী হয়ে প্রেমিক পুরুষের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সে।