ডঃ বাহারুল হক : আমার স্ত্রী এবং আমি টরন্টোতে কোথাও যাওয়া – আসা করার জন্য ঘর থেকে বের হলে প্রথমেই ভাবি ট্রেনের কথা- সাবওয়ে ট্রেনের কথা। টরন্টোতে পাবলিক যানবাহন হিসেবে সাবওয়ে ট্রেনের কোন তুলনা হয় না। এ পাবলিক সাবওয়ে ট্রেনের মালিক সিটি অব টরন্টো আর এর সার্বিক তত্বাবধানে আছে সিটি অব টরন্টো দ্বারা গঠিত একটি শক্তিশালী কমিশন- টরন্টো ট্র্যাঞ্জিট কমিশন যা সংক্ষেপে টিটিসি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
টরন্টোতে এই সাবওয়ে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা চালু করা হয় ১৯৫৪ সনের মার্চ মাসে। সাবওয়ে সিস্টেমের সাথে বাস ও স্ট্রিট কার সিস্টেম দুইটিও সংযুক্ত। টরন্টোতে বাস রুট আছে ১৪৯টি আর স্ট্রিটকার রুটও আছে ১১টি। বর্তমানে ছোট বড় চারটি লাইনে ট্রেন চলাচল করে।
লাইন ১। ইয়ং- ইউনিভার্সিটি।
এটি নর্থ-সাউথ বাউন্ড লাইন বলে পরিচিত। এ লাইনের দক্ষিণ প্রান্তে ডাউন টাউনের ইউনিয়ন স্টেশন। উত্তর প্রান্তে দুইটি স্টেশন- ভন মেট্রোপলিটন সেন্টার এবং ফিঞ্চ। ভন মেট্রোপলিটন সেন্টার স্টেশন পুর্ব দিকে অবস্থিত। এ স্টেশন থেকে দশ কিঃ মিঃ পশ্চিমে একই সমান্তরালে অবস্থান করছে ফিঞ্চ স্টেশন। ট্রেন দক্ষিণের ইউনিয়ন হয়ে ভন মেট্রোপলিটন সেন্টার এবং ফিঞ্চ স্টেশন দুটোতে যাওয়া আসা করে।
লাইন ২। ব্লৌর- ডেনফোর্থ।
এ লাইনটি ইস্ট- ওয়েস্ট লাইন বলে পরিচিত। এ লাইনে ট্রেন পুর্বের ক্যানেডি স্টেশন এবং পশ্চিমের কিপলিং স্টেশনের মধ্যে যাওয়া আসা করে।
লাইন ৩। স্কারবরো (আর-টি)।
এ লাইনটি আর-টি হিসেবে পরিচিত। এই লাইনের ট্রেনগুলো ক্যানেডি এবং ম্যাক্কাউন এ দুটো টেশনের মধ্যে চলাচল করে।
লাইন ৪। শেপার্ড।
এ লাইনটি শেপার্ড লাইন বলে সবাই জানে। এ লাইনটি ১ নং লাইনের ফিঞ্চ স্টেশনের কাছা কাছি শেপার্ড-ইয়ং স্টেশনের সাথে সংযুক্ত। শেপার্ড-ইয়ং থেকে লাইনটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে এবং শেষ হয়েছে ডন-মিলস স্টেশনে।
লাইন ৩ এবং লাইন ৪ দুটো ছোট লাইন।
টরন্টো সাব-ওয়েতে বিদ্যমান হেভি রেইল, লাইট রেইল, লাইট মেট্রো সব মিলিয়ে ট্র্যাকের মোট দৈর্ঘ ৭৬.৯ কিঃ মিঃ বা ৪৭.৮ মাইল। যাত্রী উঠা নামা করার জন্য সাবওয়েতে আছে মোট ৭৫টি স্টেশন। ট্র্যাকের উপর চলাচল করে ৮৫৮টি কার আর প্রতিদিন সাবওয়ের এসব কারে চড়ে প্রায় ১.৫৯ মিলিয়ন যাত্রী। যাত্রী সংখ্যাই বলে দেয় এই সাবওয়ে ট্রেন কিরুপ জনপ্রিয়।
গভীর রাতে কয়েক ঘন্টা ব্যাতিরেকে প্রায় সারাক্ষণ এই ট্রেন চলমান অবস্থায় পাওয়া যায় সাবওয়ের ট্র্যাকের উপর। ট্রেনগুলোর রক্ষণাবেক্ষন ব্যবস্থা কেমন আমি জানি না। তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার প্রচেষ্টা যে চালানো হয় তা বলা যায়। টিটিসির মুখপাত্র ব্র্যাড রসের মতে টিটিসি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে যে মান বজায় রাখে তা বিশ্বসেরা। তার এ বক্তব্যের সাথে পাবলিক কতটুকু একমত হবেন তা আমি জানি না। তবে এটাও ঠিক আমরা একনিষ্ঠভাবে চেয়ে থাকি শুধু টরন্টো ট্র্যানজিট কমিশন বা টি- টি-সি- র দিকে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে সাবওয়ে ট্রেনের কারগুলোর অভ্যান্তর ভাগ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার যত প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা টি-টি-সি চালাক না কেন সেগুলো তত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে না যদি যাত্রী হিসেবে আমরা সচেতন বা দায়িত্বশীল না হই। মেঝেতে থুথু ফেলে এমন যাত্রীও আমি দেখেছি। দেখেছি কফি কাপ বেকুবের মত চেয়ারের উপর রেখে বসে আছে যাত্রী। তারপর সামান্য জার্কিং হতেই কফি কাপ কাত হয়ে পড়ে চেয়ার আর মেঝে সয়লাভ কফিতে। দেখেছি ময়লা জুতা চেয়ারে তুলে শুয়ে আছে। নাকের ময়লা আঙুল দিয়ে বের করে চেয়ারে মুছতেছে, যাত্রীর এমন কর্মও আমার চোখে পড়েছে। যাই হোক, এখানে যা উল্লেখ করলাম তা যে হর হামেশা ট্রেনের হর কামরায় দেখা যায় তা কিন্তু নয়। দেখা যায় কদাচিৎ বা একেবারে মাঝে মধ্যে। যারা হামেশা সাবওয়ের ট্রেনে চলা ফেরা করেন তাদের চোখে পড়তে পারে এরকম দৃশ্য। রাতের বেলায় যখন ট্রেনে যাত্রী থাকে খুব কম তখন দেখা যায় আরেক দৃশ্য। তখন দেখা যায় ছেঁড়া অত্যান্ত ময়লা কাপড় পরা দু একজন যাত্রী সিটের উপর পা মেলে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। পায়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে পায়ের জুতা জোড়া পরিধেয় কাপড়ের চেয়েও বেশি ময়লা। ভালো করে দেখলে দেখবেন শুয়ে পড়া এসব যাত্রী শোয়ার জন্য সাধারণত ফ্যামিলি সিট (পাশাপাশি তিনটা চেয়ার নিয়ে সিট) বেছে নেয়।
একদিন আমার স্ত্রী আর আমি অনেক রাতে বাসায় ফিরছিলাম সাবওয়ে ট্রেনে চড়ে। সেদিন আমার স্ত্রী প্রথম দেখলেন এক যাত্রী শুয়ে আছে লম্বা এক ফ্যামিলি সিটে।
লোকটি তার সার্টের বুতাম খুলে রেখেছে; শরীরের সামনের দিকটা তাই উদাম। লোকটি হাত দিয়ে তার শরীরের উদাম জায়গা সমানে চুলকাচ্ছে। পা দুটোতে আছে এক জোড়া ছেঁড়া নোংরা জুতা। সেই জুতা জোড়াসহ লোকটার পা সিটের উপর। কিছুক্ষণ পর লোকটি বমি করে দিল। আমরা আর দেরি করলাম না। উঠে দুরে এক সিটে গিয়ে দুজনে আবার বসলাম। পরবর্তি স্টেশনে ট্রেন থামলে আমরা নেমে গেলাম এবং দ্রæত অন্য এক কারে উঠে বসলাম। শুয়ে পড়া এ ধরনের যাত্রী দিনের বেলায় চোখে পড়ে না। এদের বিচরণ পরিলক্ষিত হয় রাতে। যাই হোক, ঘটনাটা কোন সুখস্মৃতি হিসেবে থাকবে না কারো মনে। স্বাভাবিকভাবে আমার স্ত্রীর মনেও না। তিনিও ভুলেন না।
এবার অন্য এক দিনের কথা বলবো। তার আগে জেনে নেই প্রখ্যাত লেখক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের জীবনের এক ঘটনা। প্রভাত কুমার বাংলা সাহিত্য জগতের এক উজ্জল জ্যোতিস্ক। তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন ছোট গল্প লিখে। তার লিখিত ছোট গল্পের মধ্যে ‘ফুলের মুল্য’ বোধ করি স্রেষ্ঠ গল্প। এখন তার জীবনের যে ঘটনা বলবো সে ঘটনার অনুঃপুঙ্খ বর্ণনা আছে ‘ফুলের মুল্য’ নামক তার সেই কালজয়ী ছোট গল্পে।
ব্যাচেলর ডিগ্রী নেওয়ার পর প্রভাত কুমার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে গেলেন আইনশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্যে। সেখানে এক রেষ্টুরেন্টে প্রভাত কুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় তের / চৌদ্দ বছর বয়সী দরিদ্র এক ইংরেজ বালিকা এলিস মার্গারেট ক্লিফোর্ডের সঙ্গে। লন্ডনের যে হোটেলে সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে প্রভাত কুমার মধ্যাহ্নভোজে যেতেন ঠিক সে হোটেলে প্রতি শনিবারে লাঞ্চ করতে আসতো ম্যাগি (এলিস মার্গারেট ক্লিফোর্ড)। এতে প্রভাতকুমার আর ম্যাগি এই দুই অসম বয়সী ভিন দেশীয় মানব মানবীর মধ্যে কথাবার্তা বলার, পরস্পর পরস্পরকে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ম্যাগি অভাবি সংসারের পিতৃহীন একটা বালিকা। মা আর এক বড় ভাই ফ্রাংককে নিয়ে ম্যাগির সংসার। তবে লন্ডনের বাসায় আপন জন বলতে এখন এক মা। উল্লেখ্য তখন প্রথম মহা যুদ্ধ চলছে। ম্যাগির বড় ভাই ফ্রাংক তখন বৃটেনের হয়ে বৃটিশ শাসিত দেশ ভারতবর্ষের পাঞ্জাবে বৃটেনের শত্রুদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত। একমাত্র ছেলে ফ্রাংক যুদ্ধ করতে ভারত যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেদিন লন্ডন ত্যাগ করেছে সেদিন থেকেই ম্যাগির মা ফ্রাংকের জন্য চিন্তিত। ম্যাগির মা চিন্তিত দুই কারণে; ১ম কারণ হলো যুদ্ধ আর ২য় কারণ হলো সেই যুদ্ধ ক্ষেত্র হলো ভারত বর্ষ। ম্যাগির মা জানে ভারতবর্ষ সাপ, বাঘ, ইত্যাদি জীবনহরনকারী ভয়ংকর সব প্রাণী আর নানা রকম অনিরাময়যোগ্য অসুখ বিসুখের এক দেশ। ম্যাগি একদিন প্রভাত কুমারকে তার পরিবারের কথা বললো এবং এটাও বললো যে তার মায়ের খুব ইচ্ছা তিনি একজন ভারতীয় পেলে তার মুখ থেকে ভারত বর্ষের কথা নিজ কানে শুনবেন।
ম্যাগির মায়ের ইচ্ছা পুরণের জন্য ম্যাগির বাসায় যেতে প্রভাত কুমার তার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ম্যাগি খুব খুশি হয়। হোটেল থেকে বের হয়ে দুইজন হাঁটতে থাকলো লন্ডনের দরিদ্র পল্লী ল্যাম্বেথের উদ্দেশ্যে যেখানে ম্যাগি আর তার মা বসবাস করে। কিছু সময় পর তারা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন যেখান থেকে শুরু হয়েছে দুইটি রাস্তা – স্ট্র্যান্ড রোড আর এম্বেংকমেন্ট রোড। দুটোর মধ্যে স্ট্র্যান্ড রোড ধরলে ল্যাম্বেথ পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে। প্রভাত কুমার তাই এম্বেংকমেন্ট রোড ধরে হাঁটার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু ম্যাগি রাজি হলো না। ম্যাগি বললো- “সে রাস্তা দিয়ে গেলে কম সময়ে ল্যাম্বেথ পৌঁছা যায় আমি জানি তবুও আমি সে পথে যাই না”। প্রভাত কুমার কারণ জানতে চাইলে ম্যাগি বললো- “রাস্তাটা খুব নোংরা। রাস্তার পাশেই বস্তি বাসিদের বসবাস ফলে সে রাস্তা পরিস্কার রাখা যায় না এবং আমিও সে পথ দিয়ে হাঁটি না”। সেদিন অশিক্ষিত দরিদ্র বালিকা ম্যাগির প্রখর পরিচ্ছন্ন ও সৌন্দর্য বোধের পরিচয় পেয়ে প্রভাত কুমার লজ্জা বোধ করলেন এবং ম্যাগির পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য বোধের কাছে নিজেকে পরাজিত মনে করলেন। যেদিন রাতের ট্রেনে আমি আর আমার স্ত্রী কিপলিং থেকে ফিরলাম তার কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমি আর আমার স্ত্রী এক জায়গায় যাওয়ার জন্য উঠলাম সাব ওয়ের লাইন ২- এর একটা ট্রেনে। উঠেই আমি খালি একটা ফ্যামিলি সিটের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে আমার স্ত্রী আমাকে টেনে ধরলেন এবং বললেন- না, কোন ফ্যামিলি সিটে বসবে না। আমি বললাম- কেন? উত্তরে আমার স্ত্রী বললেন – ফ্যামিলি সিটগুলো লম্বা তো তাই সেগুলোতে রাতের বেলা চর্মরোগসহ নানারোগে আক্রান্ত অসুস্থ নোংরা কাপড় পরা লোকজন শুয়ে থাকে। আমি তাই ফ্যামিলি সিটে বসি না। তোমার মনে নাই দুই দিন আগে কিপলিং থেকে ফিরার পথে কি দেখেছিলে? হাঁ, মনে পড়লো; সাথে সাথে আরো মনে পড়লো লন্ডনের এক রাস্তায় প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় আর ম্যাগির কথোপকথন। মনে পড়লো কিভাবে তের / চৌদ্দ বছর বয়সী দরিদ্র ইংরেজ বালিকা ম্যাগির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা আর প্রখর সৌন্দর্য বোধের কাছে সেদিন পরাজিত হয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ষ্টুডেন্ট প্রথিতযশা ছোট গল্পলেখক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। পরিচ্ছন্নতাবোধ আর ফ্যামিলি সিটে বসা নিয়ে আমার স্ত্রীর কথা শুনার পর সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমি যেন ম্যাগির সামনে পরাজিত মনে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রভাত কুমার।