সাজ্জাদ আলী : ওই ভিটা, পুকুর, বটগাছ, জীর্ণ কালী মন্দির, সব কিছুরই মালিক ছিলেন রায়বাহাদুর প্রতাপ রায়চৌধুরী। সে বহুযুগ আগের কথা। রায় বাবু ছিলেন নিঃসন্তান। পুত্রলাভের জন্য তিনি অমাবশ্যার রাতগুলোতে ওই মন্দিরে যজ্ঞ করতেন। ক‚লদেবতাকে খুশি করতে প্রতিটি যজ্ঞেই একজন করে নারী বলি দেওয়া হতো। বছরের পর বছর চলছিলো ওই নৃশংস হত্যাকান্ড। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না। উল্টো সেই পাপে রায়চৌধুরী বংশে বাতি জ্বালানোর কেউ রইলো না।

সেই থেকে ওই কালী ভিটা বলি হওয়া নারীদের অতৃপ্ত আত্মার দখলে। প্রতাপবাবু মারা যাওয়ার পর থেকেই মন্দিরে ভয়ংকর সব কান্ড ঘটতে থাকলো। সন্ধ্যা আরতীর সময় মন্দিরের কপাট আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যেতো। ভেতর থেকে ভেসে আসতো নারী কন্ঠের কান্নার রোল। পুরোহিত, পূজারীরা সব প্রাণ ভয়ে মন্দির ছেড়ে পালাতো।

একদিন রায়চৌধুরী বাড়ির এক ভৃত্য গিয়েছিলো মন্দির ঝাড়– দিতে। সে আর ফিরলো না। ডাইনিরা তার ঘাড় থেকে মাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে মন্দিরের চ‚ড়ায় গেঁথে রাখলো। আর দেহ ছুঁড়ে ফেললো গাঁয়ের পথে। তারও কবছর বাদে দুই অভাবি জেলে ওই পুকুরে মাছ ধরতে গেলো। খোঁজ মেলেনি তাদেরও। ভয়ে জেলেদের সন্ধানে কেউ আর ওদিকটায় যায়নি। তারপর থেকে আজ অবধি অভিশপ্ত ওই মন্দির ভিটার দিকে গাঁয়ের কেউ পা বাড়ায় না।

কালে কালে মন্দিরটি জীর্ন হয়ে ভেঙে পড়েছে। তবে শতবর্ষী বুড়ো বট গাছটি ঝুরি ছেড়ে ছেড়ে এখনও যুবকের মতো দাঁড়িয়ে। কোনো কোনো ঝুরি এতটাই মোটা যে কোনটি গোড়া আর কোনটি ঝুরি, তা বোঝা দায়। মস্ত ওই গাছটি ঘিরে বাঁশ, বেত ও অন্যান্য আগাছারা নির্ভয়ে বংশ বিস্তার করেছে। লতা পাতায় ঠাসা ঘন সেই জঙ্গল ফুঁড়ে ভিটার মাটিতে সূুর্যের আলোও পৌঁছায় না। বটগাছের ডালে ডালে শকুন, পেঁচা ইত্যাদি অশুভ পাখিদের বসবাস। এখনও মাঝে মাঝে রাতের বেলায় গাঁয়ের লোকেরা ওই ভিটা থেকে স্ত্রীলোকের গোঙাানির শব্দ শুনতে পায়।

তা বছর তিনেক হবে ভীতিকর সেই মন্দিরে লক্ষী বোষ্টমি ডেরা বেঁধেছে। হঠাৎই একদিন ভিটার জঙ্গল থেকে তাকে বেরুতে দেখা গেল। গাঁয়ের লোকেরা তো হতবাক! এটা কী করে সম্ভব? ওই ভিটায় তো কারো জীবিত থাকার কথা না! তখন থেকেই লোকের বিশ্বাস যে ওই বোষ্টমি জীবিত কোনো মানুষই না। নিশ্চয়ই সে কারো প্রেতাত্মা।

পরণে ঢিলাঢালা ছালার চটের ফতুয়া। হাঁটলে তার লম্বা চুলের জটা মাটিতে গড়ায়। গলায় টুকরো টুকরো হাড়ের মালা। লোকে বলে ওগুলো নাকি মানুষের হাড়! পায়ে মোরগ বৈলের খড়ম, দুহাত ভরা কাঁচের চুরি। কপালের ঠিক মাঝখানটায় টকটকে লাল রঙের তিলক ফোঁটা। গালে ও গলায় পুরু করে চন্দনের দাগ কাটা। চোখদুটো সব সময় জবা ফুলের মতো রাঙা, মনে হয় বোষ্টমি জীবনে কখনো ঘুমায়নি। বেশভ‚সার কারণে তার বয়স আন্দাজ করা ভার। আটাশ হতে পারে, আবার আটত্রিশে গিয়েও ঠেকতে পারে। তবে সে যৌবনবতী। তাকে ‘সুন্দরী’ মানতে গাঁয়ের কারোরই আপত্তি হলো না।

প্রথম দিনেই বোষ্টমি লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা চাইলো। বললো, লক্ষী বোষ্টমি দ্বারে গো মা, মুষ্টিভিক্ষা দাও।

কেউ তাকে খালি হাতে ফেরালো না। চাল, ডাল, আলুটা, মূলোটা, যার যা জুটলো, বোষ্টমির আঁচল ভরে দিলো। অনেকেই তাকে খাতির যত্ন করতে চাইলো। কিন্তু লক্ষী কারো বাড়িতেই বসলো না। তবে মন্দিরে ফেরার পথে ইদ্রীস বয়াতীর কুঁড়েঘরে গিয়ে আসন পাতলো, যেন কতদিনের চেনা। বয়াতীও অচেনা অতিথিকে সামাদর করলো।

ইদ্রিসের গানের গলা নাই বললেই চলে। তবুও লোকে তাকে ‘বয়াতী’ বলেই ডাকে। তবে গলায় সুর না থাকলে কী হবে, তার সারিন্দার সুরে লোকের চোখে জল গড়ায়। জগৎ সংসারে ইদ্রিসের কেউ নাই, কিছুই নাই। থাকার মধ্যে সম্বল ওই সারিন্দাটা। মোল্লাদের আমভিটায় তালের ডাউগা দিয়ে একখানা দোচালা ঘর বানিয়েছে। সেই ঘরে বসে দিনরাত ভাঙ্গা গলায় গান গায়। গাওয়ার থেকে কাশে বেশি। মাঝে মাঝে কাশির সাথে রক্তও বের হয়। ক্ষিদা লাগলে এ বাড়ি সে বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। দুমুঠো খাবার তার জুটেই যায়। গাঁয়ের লোকের রোগে শোকে বয়াতীর ফুঁ দেওয়া পানি, পড়ে দেওয়া সুঁতা, ধন্বন্তরি কাজ দেয়। তার নির্জন দোচালা ঘরে আজই প্রথম অতিথি এলো। সে জিজ্ঞাসা করলো, একলা আইছো যে? তুমার বোষ্টমরে সাথে আনো নাই?

মৃদু হেসে বোষ্টমি বললে, থাইকলে তো আইনবো? বোষ্টম তালাস করত্যাছি গো।
বাঁশের চটা তীক্ষè করে চেছে ধারালো ছুরির মতো বানিয়েছে ইদ্রিস। গাছ থেকে দুটো চাউলানো আম ছিঁড়ে ফালি ফালি করে কেটে বোষ্টমিকে খাওয়াচ্ছে। “দুপুর রোদে কাঁচা আম”, উপযুক্ত আপ্যায়নই বটে। ইদ্রীস জানতে চাইলো, তুমার দ্যাশ কুহানে গো বোষ্টমি?
কী যে কও, বোষ্টমির আবার দ্যাশ কী? সব বিদ্যাশই আমার দ্যাশ। সগগলিই আমার আপনার জন, বুইঝলা গুসাই। এই যেমনে তুমি আমার আপনার!

আ, হাহা ! কী মধুর কতা তুমার! শুইনা মনডা জুড়াই গেল। ও বোষ্টমি, আমারে তুমার সাতে নেও। সংসারে আমার কেউ নাই। তুমার সেবা করবো, বললো বয়াতী।
ও তুমি পাইরবা না, বড়ই কঠিন জীবন আমার, বেজার মুখে বললো বোষ্টমি।
সখী, তুমারে আমি খুশি রাখতি পারবো। একবার সুযোগ দিয়া দেহো, হাত জোড় করে বললো ইদ্রীস।

বোষ্টমি যত এড়িয়ে যায় বয়াতী ততই অনুনয় করে। নাছোড়বান্দা ইদ্রিসের কাকুতি-মিনতিতে অবশেষে লক্ষী বললে, আইচ্চা গুসাই, তুমারে গানের দুইডা পদ শুনাইতিছি। এর সাতে তুমার আরো নতুন দুইডা পদ বানাতি হবি। যেদিন তুমি নতুন পদ বানাতি পারবা, সেই দিন সারিন্দডা লইয়া ওই কালী মন্দিরে চইলা আইসবা। তয় সংসারের মায়া ত্যাগ কইরা আইসো।

একথা বলে গানের পদদুটো গাইতে গাইতে বোষ্টমি সেদিনের মতো বিদায় নিলো,
আপনারে খুঁজি পরাণ মাঝে
তালাস পাওয়া বিষম দায়.. .. ..
ভীষণ এক সংকটে পড়লো বয়াতী! সে তো লেখাপড়া জানে না। জীবনে টিপসই দ্ওেয়ারও দরকার পড়েনি। বোষ্টমির গাওয়া লাইনদুটো সে সাথে সাথেই সারিন্দায় তুলে নিয়েছে। ভাঙা গলায় তা গাইছেও। পরবর্তী দুই লাইনের সুর কী হবে, তা সাথে সাথেই তার মনে এসেছে। সারিন্দায় তা বাজাচ্ছেও। কিন্তু নতুন সেই সুরটুকুর কথা সে জানে না। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সারাদিন ধ্যানমগ্ন থাকে বয়াতী। গানের নতুন পদের জন্য যুৎসই শব্দ তার চাইই চাই। বোষ্টমিকে তার মনে ধরেছে। জীবনের বাকি কটা দিন তার সেবা করেই কাটাতে চায়।
বয়াতী গাঁয়ের পথ দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে বেড়ায়। হাতে সারিন্দা, গানের দুটো লাইন বারে বারে গাইছে, আপনারে খুঁজি পরাণ মাঝে, তালাস পাওয়া বিষম দায়.. ..।

পথে যাকে পায় তাকেই গেয়ে শোনায়। আর জিজ্ঞাসা করে, এর পরের লাইন কী হতি পারে কওতো মিয়ারা? লোকেরা তার প্রশ্নটির পাত্তা না দিয়ে যার যার কাজে যায়। বয়াতী বুদ্ধি করে বিশ্বাস বাড়ির সিরাজের কাছে গেলো। আর গেলো মোল্লাদের ভাগ্নে আহাদের কাছে। ওরা দুইজন কলেজে পড়ে। আশা করেছিলো, গানের দুটো নতুন লাইন ওরা বলে দিতে পারবে। কিন্তু সুবিধা হয়নি। তারা নাকি কাব্য রচনা করতে জানে না। অবশ্য “কাব্য রচনা” ব্যপারটা যে কী, বয়াতী তা বোঝেনি।

এমনি করে কেটে যায় মাস ছয়েক। গাঁয়ে মুষ্টিভিক্ষা চাইতে এলে বোষ্টমি বয়াতীর বাড়িতে একদন্ড বসে যায়। নতুন পদ রচনার খবর জানতে চায়। নিরাশ হয়ে খানিক্ষণ বসে থেকে ফিরে যায়। বয়াতী অবশ্য লক্ষীকে নতুন পদ দুটির সুর সারিন্দায় বাজিয়ে শুনিয়েছে। আশ্বস্ত করে বলেছে, আর কয়ডা দিন সময় দাও গো সখি। গাইয়া শুনাবো তুমারে।

এর কিছু মাস পরে এক ভোররাতে আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখে বয়াতী হুড়মুড় করে জেগে উঠলো। সাথে সাথেই হাতে তুলে নিলো তার সারিন্দা আর ছড়। চোখ মুদে গাইতে লাগলো স্বপ্নে দেখা সেই গান। পুরোনো পদ দুটোর সাথে নতুন দুটো পদও বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে। বিলম্ব না করে বয়াতী ছুটতে ছুটতে চললো মন্দির-ভিটার দিকে। গাঁয়ের লোকেরা হা হুতাস করতে লাগলো। কেউ কেউ পেছন থেকে ডেকে তাকে ফেরানোর চেষ্টাও করলো। সে তো নিশ্চিত মৃত্যুমুখে যাচ্ছে। ওই বোষ্টমি ছাড়া কেউ কোনোদিনও মন্দিরে গিয়ে ফিরে আসেনি!

সারাটা দিন গ্রামবাসীরা উৎকন্ঠায় কাটালো। সবাই বলাবলি করলো যে বোষ্টমির কারণে ইদ্রিসের জীবনটা গেল। সেই রাতে মন্দির-ভিটায় ধোয়ার কুন্ডলি দেখা গেল। নারী কন্ঠের কান্নাও শুনতে পেলো কেউ কেউ। ইদ্রিস বয়াতীর ভাগ্য আন্দাজ করতে কারোরই বিশেষ অসুবিধা হলো না।

পরদিন ভোরে গাঁয়ের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে এলো। তার রেশ কাটতেই লোকেরা আরো একটি সুর শুনতে পেলো। কালী মন্দির থেকে ক্রমেই সেই সুর লোকালয়ের দিকে এগুচ্ছিলো। বোষ্টমী আর বয়াতী পাশাপাশি হাঁটছে। একজন গাইছে, আরেকজন বাজাচ্ছে,
আপনারে খুঁজি পরাণ মাঝে
তালাস পাওয়া বিষম দায়,
এই পাই তো সেই হারাই
ধরতি ধরতি ছুইটা যায়।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)