অনলাইন ডেস্ক : ‘রয়েল চিটারের’ আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর রূপনগর থানা এলাকা। যত্রতত্র মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। প্রতারিতদের মধ্যে অধিকাংশই গার্মেন্টসকর্মী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। সব হারিয়ে সর্বস্বান্তরা বিচারের আশায় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, চলতি বছরের গত ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) রূপনগর থানায় মামলা হয়েছে ৮৯টি। এর মধ্যে মাদকসংক্রান্ত মামলা ৪৮, হত্যাচেষ্টা ৪, হত্যার হুমকি পেয়ে মামলা করেছেন ১১ জন। এই সময়ে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৪টি। শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, দস্যুতা, গাড়িসহ বিভিন্ন চুরি, মানবপাচার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে বাকিগুলো। করোনাকালীন সবচেয়ে কম যথাক্রমে ৫টি করে মামলা হয়েছে গত এপ্রিল ও মে মাসে। চলতি মাসের গত ১৭ দিনে ১৯টির মতো অভিযোগ জমা পড়েছে রূপনগর থানায়।
জানা গেছে, নামসর্বস্ব মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বশেষ গত ৯ জুলাই রূপনগর থানায় মামলা করেন আবু সালেহ নামে এক গার্মেন্টসকর্মী। প্রায় একই সময় থানায় অভিন্ন অভিযোগ জানান রাইজিং গার্মেন্টসের দুই কর্মী মোসাম্মৎ কলি ও মো রুহুল আমিন। প্রতারণাসংক্রান্ত মামলাগুলোর নথি ঘেঁটে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অভিযোগকারীরা বলছেন, মুনাফার লোভ দেখিয়ে রূপনগর থানা এলাকায় অবস্থিত প্রজাপতি শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি. ও সোশ্যাল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. নামে দুটি প্রতিষ্ঠান ৮০০ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু রয়েল চিটারই নয়, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে রূপনগরে গা-ঝাড়া দিচ্ছে মাদককারবারি ও চাঁদাবাজ চক্র। ইতোমধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে ঈদ-সালামির নামে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীর কাছে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে চক্রটি। কেউ কেউ থানা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন। প্রাণনাশের ভয়ে অনেকে নীরবে চাঁদাবাজদের দাবি মিটিয়েই ব্যবসার চাকা সচল রাখছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন (নম্বর-৪৭৩) ব্যবসায়ী মো. মিজান।
গতকাল শনিবার মিজান বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে আমাকে একটি ইন্টারনেট নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, ‘শান্তিমত ব্যবসা করতে চাইলে ১০ লাখ টাকা রেডি রাখ। নাইলে তো বুঝসই, দোকানে ঢুইক্যা ভিড়াইয়্যা দিমু।’ হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করলেও কখন কী হয়- এই চিন্তায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান।
২৪ জুন সন্ধ্যায় রূপনগর ১০ নম্বর সড়কে নিজ বাসার সামনে আব্দুস সাত্তার মাতব্বর নামে এক হাউজিং ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে ৩ দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় জড়িতদের পুলিশ গত শনিবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে সাত্তার মাতবর জানান। সূত্র বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর ক্যাডাররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে মুখ খুলতে রাজি হননি ভুক্তভোগী।
মাল্টিপারপাস প্রতারণার শিকার গার্মেন্টসকর্মী আবু ছালেহ জানান, ২০১৮ সালে রূপনগর আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ২৬/১ নম্বর বাসায় প্রজাপতি শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি. নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন মো. ইব্রাহীম। মুনাফার লোভ দেখিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছালেহের কাছ থেকে ইব্রাহীম হাতিয়ে নেন ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান তাকে কোনো মুনাফা দেয়নি, উপরন্তু সঞ্চয়ের আসল টাকাও মেরে দিয়েছে। ইব্রাহীম চক্রের সদস্য আবুল বাশার, আলমগীর, এমী ও শিল্পীসহ অচেনা ৮ থেকে ১০ জন এ কাজে জড়িত। শুধু ছালেহই নয়, একইভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠান তার মতো আরও ৩০০ সদস্যের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। পুলিশ প্রতিষ্ঠানটির এমডি ইব্রাহীমকে গ্রেপ্তার করলেও তার সহযোগীরা অধরা জানান ছালেহ।
একই প্রতিষ্ঠানে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা রেখেছিলেন গার্মেন্টসকর্মী মোসাম্মৎ কলি। আর সাড়ে ১৪ লাখ টাকা জমিয়েছিলেন গার্মেন্টসের কর্মী রুহুল আমিন। টাকা খুইয়ে করোনাকালে খেয়ে না খেয়ে আছে তাদের পরিবার। গতকাল ভুক্তভোগী কলি বলেন, তাদের মতো আরও ৪০০ জনের কাছ থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রজাপতির এমডি ইব্রাহীম। টাকা উদ্ধারসহ প্রতারকচক্রটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
এদিকে সমবায় প্রতিষ্ঠানের নামে রূপনগরের ৩০০ সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছিলেন রূপনগরের ১৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত সোশ্যাল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামন ওরফে সহিদ। শেষরক্ষা হয়নি। গত ২৭ জুন সহিদকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
এই প্রতিষ্ঠানে ৩২ লাখ ৬১ হাজার টাকা রেখে ধরা খেয়েছেন মো. মুরাদ নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতারকচক্রটির বিরুদ্ধে গত ২৯ জুন রূপনগর থানায় মামলা করেছি। কিন্তু সহিদ গ্রেপ্তার হলেও চক্রের সদস্য ইমরান আহম্মদ, ইসরাত, কফিল উদ্দিন মল্লিক, মো. হাসিম, মোকারমসহ কয়েক জন এখনো অধরা।
এই ব্যবসায়ীর মতো সোশ্যাল মাল্টিপারপাসে ৮ লাখ টাকা খুইয়ে গত ২৭ জুন একই থানায় একটি মামলা করেন রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ী মো. সোহেল রানা। তিনি বলেন, ব্যবসার সব টাকা গচ্ছিত রেখেছিলাম ওই প্রতিষ্ঠানে। প্রতারিত হয়ে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছি। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন ভুক্তভোগী মুরাদ ও সোহেল।
শোরুম থেকে মাল এনে দাম না দিয়ে চম্পট দেওয়া গ্রুপ সক্রিয় এই প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে গত ৩ জানুয়ারি রূপনগর থানায় একটি মামলা করেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটে এম/এস হাবিব ইলেকট্রনিক্সের ম্যানেজার সাদেকুর রহমান রিফাত। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, গত ৩১ ডিসেম্বর চক্রের সদস্য মাসুদ চৌধুরীসহ ৩ থেকে ৪ জন তাদের শোরুমে গিয়ে ৬টি এলএডি টিভি অর্ডার করেন। ২ জানুয়ারি বিকালে সেলসম্যান পিকআপে করে টিভিগুলো মাসুদের দেওয়া ঠিকানায় (রূপনগরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় ৫ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাসা) ডেলিভারি দিতে যায়। মাসুদ তার এক সদস্যকে দিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ৫টি টিভি বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। একটি টিভি অদূরেই এক বন্ধুর বাসায় পৌঁছে দিতে বলেন সেলসম্যানকে। নির্ধারিত বাড়িতে গিয়ে ৬ নম্বর টিভি ডেলিভারি না নিয়েই কৌশলে চক্রের ওই সদস্য চম্পট দেন। এর পর ৫টি টিভির দাম পরিশোধের জন্য বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত মাসুদের মোবাইল ফোনে বহুবার রিং দিলেও সাড়া দেননি তিনি। আগের বাসার ভেতরে গিয়েও চক্রের সদস্য বা টিভির কোনো অস্তিত্ব না পেয়ে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তারা।
রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় এখন রূপনগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। প্রতারণা মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে থানায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। আমার এক বছর কর্মকালীন থানা এলাকায় কোনো মাদকের স্পট গড়ে উঠতে দিইনি। যে কজন ভ্রাম্যমাণ মাদক বিক্রেতা রয়েছে নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। চাঁদা দাবির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।