Home কলাম রূপ-বাহারি ক্যানাডা

রূপ-বাহারি ক্যানাডা

খুরশীদ শাম্মী : মানুষ সুন্দরের পূজারি। সুন্দর কিছু দেখলে মানুষ মন ভরে উপভোগ করে। যেকোনো একটি সুন্দরকে ঘিরে নান্দনিক কিছু সৃষ্টির নেশায় পড়ে থাকেন সৃষ্টিশীল মানুষেরা। সুন্দরকে উত্তমরূপে আকর্ষণীয় করে তোলেন তাঁরা। তবে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এমনই একটি বিষয়, সেথায় প্রকৃতির প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং প্রতিটি জীব কিছুটা হলেও তা উপভোগ করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবার স্থান, কাল, জল, মাটি, হাওয়া, ইত্যাদি নির্ভর। সেইজন্য ভিন্ন ভিন্ন দেশের সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন রৌদ্রতপ্ত বালুকাময় মরুভূমির সৌন্দর্য কখনোই শীতপ্রধান কোনো দেশ কিংবা নাতিশীতোষ্ণ দেশসমূহের সাথে তুলনা করা যায় না।

যদিও উত্তর অ্যামেরিকার দেশ ক্যানাডা শীতপ্রধান একটি দেশ, তবুও তার নৈসর্গিক শোভা মোহিত করে। প্রতি বছর চারটি প্রধান ঋতু চারটি বিশেষ সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয় সময় আবর্তনে। কখনো তুষারাবৃত শুভ্রতার দেবী, কখনো স্বচ্ছ বরফ স্বর্গ, কখনো সবুজের সমারোহ, আবার কখনো রাশি রাশি হলুদ-কমলা- লাল রঙিন ম্যাপেল পাতায় সজ্জিত বালিকাসম। এগুলো তো গেলো ঋতুভিত্তিক সৌন্দর্যের ভিন্নতা। এলাকাভিত্তিক সৌন্দর্যের ভিন্নতা আরো ব্যাপক। দশটি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল নিয়ে আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ক্যানাডা। পূর্বদিকের আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর ও উত্তরে আর্টিক মহাসাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত দেশটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রতিটি প্রদেশ ও অঞ্চল অনন্য।

অন্টারিও প্রদেশের অন্যতম আকর্ষণ প্রকৃতির আশ্চর্যজনক এক সৃষ্টি বিশ্ববিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাত। উত্তর অ্যামেরিকার প্রধান দু’টো দেশ ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় অবস্থিত এই জলপ্রপাত দেশ দু’টোকে বেঁধে রেখেছে অনন্য জলধারায়। এই জলধারা প্রতিদিন সহস্রাধিক পর্যটক মনে আনন্দের দোল জাগায়, কল্পনার খোরাক হয়, আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মানুষের প্রয়োজন মেটায়। নায়াগ্রা জলপ্রপাত তলদেশের এরি হ্রদ এঁকেবেঁকে পৌঁছে গেছে অন্টারিওর প্রধান দু’টো হ্রদ হুরন ও অন্টারিও হ্রদ পর্যন্ত। এভাবেই নায়াগ্রার জল প্রবাহিত হয় হ্রদমাতৃক প্রদেশ অন্টারিওর শিরা-উপশিরায়।

প্রায় দশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশ ক্যানাডার জনসংখ্যা মাত্র উনচল্লিশ মিলিয়ন। তবুও এর ব্যস্ত শহরগুলোর নাগরিক জীবনযাপনের গতি নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতোই খরস্রোতা। সৌন্দর্য বহুরূপী। নীরবতা অন্বেষী ও প্রকৃতি অনুরাগীদের জন্য অরণ্য, পাহাড়, জল, পাখির কলরব পরতে পরতে।

উত্তরের অঞ্চল ও প্রদেশগুলো শীতের চাদর মুড়ে থাকে প্রায় বারো মাস। শীতকালে সাদা পাহাড়ের দেশ বলে অবুঝ মন দাবি করলে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। বরফ ঢাকা শ্রভ্রতায় ঘুরে বেড়ায় পোলার বিয়ার ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী। সেখানেও বসবাস করে লড়াকু মানুষের দল, যদিও সংখ্যায় যৎসামান্য। তারা দলবেঁধে বরফের তলদেশ থেকে তুলে আনে মাছ, শিকার করে বন্য প্রাণী। বরফের পাহাড় ভেঙে বৃহৎ জাহাজের মতো বরফ টুকরোগুলো জলে ভাসে কখনো। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক ভিন্ন মাত্রা সেখানে।

পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগর উপক‚লের ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের বাহক। পথের দু’ধারে লাল, কালো, ধূসর, নীল রঙের চোখ ধাঁধানো উঁচু পাহাড় সম্রাট রকি পরিবারের সদস্যরা দাঁড়িয়ে। তাদের সাথে লুকোচুরি খেলে দিবাকর। কঠিন পর্বতচূড়ায় জমে থাকা শুভ্র শীতল বরফে রবির সোনালী আলো বিচ্ছুরিত হয়ে কখনো উজ্জ্বল হীরকের রূপ ধরে। ঐ পাহাড় ঘেরা ভূপৃষ্ঠে অগণিত সবুজ গাছগাছালি, আছে বরফ শীতল গুহা, কুলকুল প্রবাহিত হয় বিভিন্ন আকারের জলপ্রপাত, কোথাও আবার পশুদের অভয়ারণ্য। ব্রিটিশ কলম্বিয়া হয়ে আলবার্টা প্রদেশ প্রর্যন্ত বিস্তৃত ক্যানাডার রকি মাউন্টেন। ঐ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে উঠেছে শহর, চলার পথ। মাঝেমাঝে বয়ে গেছে ছোট-বড় হ্রদ। হ্রদগুলোর জল স্থানীয় আবহাওয়া ও খনিজ দ্রব্য নির্ভর সবুজ, ফিরোজা, নীল, নানান রঙের। সূর্যরশ্মিও বিরাট ভূমিকা রাখে জলের রং নির্ণয়ে। আলবার্টার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ব্যানফ ও জ্যাসপার। সেখানে ঘন নীল আকাশের বুক চিরে সুবিস্তৃত পাহাড় নেমে এসে আলিঙ্গন করেছে লেক ম্যালিন, লেক লুইস ও লেক মোরেইনের ফিরোজা রঙের জল। ঝাঁকবাঁধা সাদা মেঘের আকাশ, কঠিন পাহাড় ও তরল জলের মিলনাস্থলে প্রেম-স্পর্শ সৃষ্টি করেছে মানুষের হৃদয় কাড়া দৃশ্য। স্বর্গের আমেজ আছে সেখানে। আবার আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে দূর থেকে কখনো হয়তো মনে হবে কাত হয়ে পড়েছে গোটা পর্বত, কখনো পালতোলা গয়নার নৌকা, কখনো বিশ্বের শেষ সীমানা। সেখানে কোলাহলের মাঝেও প্রায়শই দেখা যায় বৃহদাকার বল্গা, বারশিঙ্গা, সাম্বার প্রজাতির বুনো হরিণ, বুনো মোষ ও অন্যান্য পশুদের দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতে, হ্রদের জল পান করতে।

পূবের আটলান্টিক মহাসাগরের নীল জল ঘিরে রেখেছে ঘন সবুজ গাছগাছালির নোভা স্কশিয়া, নিউ বার্নসউইক, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড ও নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডর। ওইসব ধূসর লাল জমিনের শহরগুলোর সমুদ্র সৈকতে দর্শনার্থীরা ঝিনুক কুড়ালেও, জলের সাথে নিবিড় সম্বন্ধ গড়ে তোলে স্থানীয় জেলেরা। সাগরের গর্জন উপেক্ষা করে তারা চলে যায় মাছের কাছাকাছি, খাঁচা ভরে তুলে আনে নোনা জলের বৃহদাকার লবস্টার, স্যালমন, কীং-ফিস, ইত্যাদি। সাগর থেকে দলবেঁধে উপসাগরে ঘুরতে আসে তিমি। ছলাত ছলাত জলে লেজ নেড়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কালে উৎসুক দর্শনার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে যায় কিছুক্ষণ পরপর। গ্রীষ্মকালে সামান্য আঁধারে ভিজে মাটির ভাপকে বনচূড়ায় ঘন কুয়াশার ফোয়ারা ভেবে হঠাৎ করে কারো হৃদকম্পন ঘটাবে হয়তো, স্থির দৃষ্টির বুনো হরিণগুলো পথ আগলে ধরলে বুক ধড়ফড় করবে; কিন্তু দিনের আলোয় মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণগুলো তাদের যুগল হরিণীকে নিয়ে হেঁটে বেড়ায় বাড়ির আঙিনা, শিশুদের খেলার মাঠ, শস্যক্ষেত। নোভা স্কশিয়া ও নিউ বার্নসউইক এর মাঝে বে অফ ফান্ডি সৈকতে ঢেউয়ের খেলায় পাহাড় ক্ষয়ে তৈরি বিভিন্ন আকারের ফুলদানীর মতো প্রাকৃতিক ভাস্কর্য সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহুদূর। জল ও পাহাড়ের মিলনস্থলে এমন দৃশ্য মানুষের অস্থির মন স্থির করে। প্রভাতে অরণ্যকোল, পর্বতশৃঙ্গ কিংবা নীল জলের বুক চিরে লাল সূর্যোদয় ও গোধূলির সূর্যাস্ত কারো অনিন্দ্য জীবন গল্পের সাথে পুরোটাই মিলে যায় হয়তো। নতুবা কারো মনে বিচ্ছেদের জ্বালা সৃষ্টি করে। আর ওখানেই মানুষ ও প্রকৃতির একটা ভীষণ জটিল সম্বন্ধ। তারপরও প্রকৃতি নিজের মতো সুন্দর। সব মিলিয়ে প্রকৃতির এই সুন্দর বুননকেই আমার স্বর্গ বলে মনে হয়। ক্যানাডায় বাহারি রূপে তা’ বিকশিতও হয়। সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ নয়ন ভরে, হৃদয় জুড়িয়ে তা’ উপভোগ করে।

Exit mobile version