অনলাইন ডেস্ক : গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার। সঙ্গে গানম্যান। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি বিলবোর্ডে সাঁটিয়ে দিয়েছেন হাসপাতালের সামনে। তিনি সিলগালা করে দেয়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ। ২০১৩ সালে হাসপাতালের লাইসেন্স নেয়ার পর আর নবায়ন করার গরজ অনুভব করেন নি। লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানকে করোনার মতো স্পর্শকাতর চিকিৎসাসেবা দেয়ার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শুরু থেকেই এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনা চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগ আসায় সোমবার হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

গত মঙ্গলবার শাখা দুটি সিলগালা করে দেয়া হয়। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনার ভুয়া সনদ, বাড়তি অর্থ আদায় করে আলোচনায় আসা এই হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদকে নিয়ে কৌতূহল চারপাশে। তিনি কীভাবে এমন একটি হাসপাতাল গড়ে তুললেন, করোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব বাগিয়ে নিলেন- এমন নানা প্রশ্ন মুখে মুখে। অভিযানের পর তিনি লাপাত্তা। পাওয়া যাচ্ছে না হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ভুয়া পরিচয় দিয়ে তিনি নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতেন। নিজের ফেসবুক পেজে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ জানিয়েছেন, মোহাম্মদ শাহেদ এমন কোনো কমিটিতে নেই। রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে মো. শাহেদ বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও অংশ নিতেন। দিতেন নানা পরামর্শ। নিজে প্রতারণার জাল ফেলে কীভাবে মানুষকে এভাবে নসিহতের বাণী শোনাতেন না নিয়ে বড় বিস্ময় মানুষের মাঝে।
মো. শাহেদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকলেও তার আসল নাম মো. শাহেদ করিম, পিতা: সিরাজুল করিম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএস?সি। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ি তার ঠিকানা হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১। গ্রামের বাড়ী সাতক্ষীরা জেলায়। বিএনপি সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীন অনেকের সঙ্গে তার সুস্পর্ক ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ১/১১ সরকারের সময় তিনি দুই বছর জেলে ছিলেন বলে তার ঘনিষ্টজনরা বলছেন। জেল থে?কে বের হয়ে শাহেদ ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নং রোডে এমএলএম কোম্পানী বিডিএস ক্লিক ওয়ান খুলে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারনা করে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আর সেসময় তিনি মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী বলে পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় ২টি মামলা, বরিশালে ১ মামলা, বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিস এ চাকুরীর নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারনার কারণে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে বলে সূত্রের দাবি।

এছাড়াও প্রতারণার টাকায় তিনি উত্তরা পশ্চিম থানার পাশে গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট কলেজ ও ইউনির্ভাসিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। এর একটিরও কোন বৈধ লাইসেন্স নেই বলে অভিযোগ আছে। আর অনু?মোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে শাহেদের বিরুদ্ধে। প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিতে নিজের কার্যালয়ে একটি টর্চার সেল গড়ে তুলেছিলেন বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

রিজেন্টের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪২৬৪টি স্যাম্পল রিজেন্ট টেস্ট করেছে এবং এর বাইরে ৬ হাজারের বেশি স্যাম্পল টেস্ট না করেই তারা ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ২০১৪ সাল থেকে নেই। আর আইসিইউ যেটা আছে সেটা ভালোভাবে চলছিলো না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডায়াগনোসিস ল্যাব আছে, সেখানে কোনো মেশিন নেই, সেখানে কোনো টেস্ট না করেই রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, অভিযান চলাকালে ফ্রিজের মধ্যে এক অংশে মেডিসিন অন্য অংশে মাছ মিলেছে। হাসপাতালটির ডিসপেনসারি সেখানে সব সার্জিক্যাল আইটেম ৫/৬ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ। নেই মালিকের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন। এর আগে প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানোর সময় বেশ কিছু রিপোর্ট সেগুলো হাসপাতালে থাকার কথা সেগুলো মিলেছে রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে। র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, যেই চিকিৎসা বিনামূল্যে করার কথা সেটির জন্য রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার সরকারের কাছ থেকেও সেই টাকা গ্রহণ করেছে হাসপাতালটি।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার বলেন, ‘করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা এবং বাড়িতে থাকা রোগীদের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করতো রিজেন্ট হাসপাতাল। এ ছাড়াও সরকার থেকে বিনামূল্যে করোনা টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্ট প্রতি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আদায় করতো তারা। এভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট। এই সমস্ত অপরাধ ও টাকার নিয়ন্ত্রণ চেয়ারম্যান সাহেব (রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদ) নিজে করতেন অফিসে বসে।’

সারোয়ার আলম বলেন, ‘রিজেন্টের প্রধান কার্যালয় থেকেই এই অপকর্মগুলো হতো বিধায় এটি সিলগালা করা হয়েছে। পাশাপাশি রোগীদের স্থানান্তর করে হাসপাতাল দুটিও সিলগালা করা হয়েছে।’ এর আগে সোমবার রাতেই মো. সাহেদের মালিকানাধীন হাসপাতাল থেকে অননুমোদিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ও একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ওই গাড়িতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখে ধুলো দিতেই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার ব্যবহার করা হতো।

৫০ শয্যার রিজেন্ট হাসপাতালটিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদন দিয়েছিলো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে ২০১৭ সালে মিরপুরেও হাসপাতালটির আরেকটি শাখা খুলে তার অনুমোদন যদিও এসব হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ একবার উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর নবায়ন করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

করোনা আক্রান্ত বাবাকে রিজেন্টে ভর্তি করেন নি শাহেদ: রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদের বাবাও করোনা আক্রান্ত হন। তবে তাকে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। বিষয়টি জানা যায়, এই হাসপাতালের একজন সাবেক কর্মীর মাধ্যমে। তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি রিজেন্ট হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। তাকে ফোন দিয়েছিলেন মো. শাহেদ। তিনি প্লাজমা দেয়ার আবেদন জানিয়ে ছিলেন তার কাছে। তবে রক্তের গ্রুপ না মেলায় তিনি প্লাজমা দিতে পারেন নি। এ ছাড়াও নিজের ফেসবুক ওয়ালে বাবার জন্য বি পজেটিভ প্লাজমার জন্য আবেদন করে পোস্টও দিয়েছিলেন শাহেদ। তিনি ওই কর্মীকে জানিয়ে ছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে তার বাবা চিকিৎসা নিচ্ছেন।