মাহমুদুজ্জামান: ২৭ মে শনিবার। বাসা থেকে যখন বের হলাম তখন বিকেল ৬:৩৫। ঝকঝকে দিন। সারা দিনের গরমে ড্রাইভিং সিটে বসতেই মনে হলো প্রি-হিটেড ওভেনের মধ্যে ঢুকলাম। মে মাসের এসময়কে আসলে বিকেল বলাটা ভুল। তখনও প্রখর রোদ, গন্তব্য বার্চমাউন্ট রোডের নন্দন ইভেন্টস অডিটোরিয়াম। রাজীব হাসান চৌধুরীর একক সংগীত সন্ধ্যা।
বিজ্ঞাপনে লেখা আছে ৫:৩০- গেইট ওপেন. ৬:৩০ – অনুষ্ঠান শুরু। ভাবলাম মূল অনুষ্ঠানের আগে অন্তত ৩০ মিনিটের আলোচনা তো থাকবেই, তাই একটু দেরিতে যাওয়া। একটা অনুষ্ঠানে শিল্পীর যেমন প্রস্তুতি থাকে, দর্শক শ্রোতারও তো প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। তাই ইউটিউবে রাজীব চৌধুরী নামে সার্চ দিতেই তার চ্যানেলটা পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোক দেখি ভীষণ রকমের মাল্টি ট্যালেন্টেড। যেমন মারাত্মক ছবি তোলেন, তেমন গানের গলা। খোঁজ নিলে হয়তো আরো কিছু প্রতিভা পাওয়া যাবে।
লরেন্স রোড ধরে আগাচ্ছি আর শুনছি শিল্পীর মৌলিক গানগুলো। অন্য রকম ঈদ, প্রকৃতির কান্না, চিঠি, মনের দেহ গানটা শেষ না হতেই নিজেকে আবিস্কার করলাম নন্দন ইভেন্টস এর কার পার্কে। ততক্ষণে ৬টা ৫০ বেজে গেছে। টিকেট ভেরিফিকেশনের পর ভেতরে ঢুকতেই দুইজন কিশোর-কিশোরী হাসিমুখে একটা কালো এনভেলপ এগিয়ে দিল। কোনায় একটা ফ্রেরো রোশেএ চকলেট আটা। বললো এর মধ্যে র্যাফেল ড্রর কুপন আছে। আলো আঁধারি অডিটোরিয়াম ততক্ষনে প্রায় পুরোটাই ভর্তি শুধু পেছনের সারির কয়েকটা চেয়ার ফাঁকা।তারই একটাতে বসলাম।গিটার হাতে রাজীব হাসান চৌধুরী যখন স্টেজে চেয়ারে বসলেন, ঘড়ির কাটা তখন ঠিক সাতটায়।এসেই এতো সহজ ভঙ্গিতে কথা শুরু করলেন- যেন মনে হলো শিল্পী তার লিভিং রুমে পারিবারিক পরিবেশে আপন কিছু মানুষকে গান শোনাতে এসেছেন। বললেন “পুনম (স্ত্রী) বলেছিল, এই রকম অনুষ্ঠান করার এতো বড় সাহস দেখাচ্ছ, দেখো তোমার বন্ধুরা ছাড়া কেউ আসবে না।আজকে এই অডিটোরিয়ামে আমি আমার বন্ধুদেরকেই শুধু দেখতে পাচ্ছি।” গান ধরলেন “তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো” ওয়াও! হোয়াট এন ইন্ট্রো! – খোঁজ নিতে হবে ভদ্রলোকের মার্কেটিংয়ে মেজর ছিল কি না?
এরপর আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, বেলা বোস, কথা দাও আবার আসবে, আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তাঁরা, পাখি রে তুই দূরে থাকলে, মনে পরে রুবি রায় একের পর এক গেয়ে চলেছেন আর প্রতিটি গানের মাঝে মাঝে গল্প করছেন, কথা বলছেন, রসিকতা করছেন. ওলির ও কথা শুনে বকুল হাসে গানটার পরে যখন বললেন “এটা আসলে একটা হিংসুটে বৌয়ের কথা বলা হচ্ছে যে সব সময়ই বলে যে- অমুক এটা করছে তো তুমি করছো না কেন” আর সবাই হো হো করে হেসে উঠছে। আবার যখন বাবা কে নিয়ে নিজের সুর করা গান “হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেই হারিয়ে ফেলি আমি আর হারিয়ে যাও তুমি” অথবা জেমসের মা গানটা গাইলেন তখন অনেক দর্শকের চোখ ভিজে উঠতে দেখেছি। পুরো হলভর্তি দর্শকও মাঝি নাও ছাইড়া দে, এই মন তোমাকে দিলাম, অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান, ও রে নীল দরিয়া, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায় বা যখন থামবে কোলাহলের মতো পুরোনো সব কালজয়ী গানেও যেমন সবাই একসাথে গলা মিলিয়েছে, ঠিক তেমনি আবার এলো যে সন্ধ্যা, মন শুধু মন ছুঁয়েছে, সেই তুমি, ভালো আছি ভালো থেকো, ওই দুই পাহাড়ের ধারের মতো বহুল জনপ্রিয় ব্যান্ডের গানেও গলা ছেড়ে গেয়েছে।
র্যাফেল ড্রর খাম, স্টেজ সজ্জা, অডিটোরিয়াম ডেকোরেশন, চেয়ার বিন্যাস সবকিছুতেই রুচিশীলতা এবং পরিমিতিবোধের ছাপ লক্ষণীয়। তবলা ও কাহনে সজীব, গিটারে অর্নব, রিদমে শিল্পী নিজে এবং পিয়ানোতে শিল্পীর মেয়ে জয়িতা তাদের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অনেক ইনস্ট্রুমেন্ট আর বড় মিউজিক সিস্টেম ছাড়াও যে একটা সুন্দর অনুষ্ঠান করা যায় এটাই তার প্রমান। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমাকে যেটা আকৃষ্ট করেছে সেটা হচ্ছে দর্শক। এতো সুশৃংখল, উচ্ছল, গানের সাথে মিশে যাওয়া দর্শক অনেকদিন পর দেখলাম।
রাজীব চৌধুরী যখন আমি তোমাকেই বলে দেব গানটা দিয়ে শেষ করলেন তখন প্রায় রাত ১১টা। কি আশ্চর্য! অনুষ্ঠান শেষ কিন্তু দর্শক তখনো বসে। কেউ উঠছে না। আমি আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে এলাম। শহরের রাস্তার আলোয় আলোকিত রাতের আকাশ, কি বিশাল আকাশটা! মাথার মধ্যে শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে “হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেই হারিয়ে ফেলি আমি, আর যাও হারিয়ে তুমি, ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে ধরি ছেলেবেলার মত, হারিয়ে যাবার ভয়ে, গন্ধ নেবার ছলে”। পা বাড়ালাম গাড়ির দিকে।