নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রশান্তিময় গ্রামের নাম ঝিকরাপাড়া। ইদানিং এই গ্রামটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশের মানুষের দৃষ্টিতে এসেছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, এই গ্রামে বছরের কয়েকটি সময়ে বিশেষ করে বাংলা বৈশাখ মাসে শুরু হতে থাকে নাম না জানা অসংখ্য পাখির আগমন। এই পাখিগুলো মূলত এই গ্রামে আসে ডিম পাড়তে আর নিজেদের বাচ্চা লালন পালন করতে। অনেকেই অবাক বিস্ময়ে দেখে এক হাজারের বেশী জন অধ্যুষিত এই গ্রামে একেবারে নিশ্চিন্তে এই পাখিগুলো গাছ ছেয়ে ফেলে, এমনকি অবলীলায় গ্রামের পথে পথে হেঁটে বেড়ায়। নির্ভয়ে ও নির্বিঘেœ চলাফেরা করা এই পাখিদের দেখে মনে হয় তারাও এই গ্রামের সদস্য। পাখিদের অভয়ারণ্য এই গ্রামের সবাই ভালোবাসে এই সব পাখিদের, কোনভাবেই কারো দ্বারা কখনও সামান্যতম ক্ষতিগ্রস্থ হয় না কোন পাখির। কয়েক দশক ধরেই এমন ঘটনা ঘটে চলছে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাখিপ্রেমী মানুষেরা ছুটে আসে এই গ্রামে এই সব পরিযায়ী পাখিদের কাছ থেকে দেখতে।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার এই গ্রামে গত ২রা ফেব্রæয়ারি, শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যাতিক্রমধর্মী মিলন মেলা। ‘এসো মিলি বন্ধনে, শিকড়ের টানে’ শ্লোগানে এই মিলন মেলায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশ নেয় প্রায় পাঁচশ মানুষ। ঝিকরাপাড়ার ঐতিহ্যবাহী হাজী বাড়ীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এই মিলন মেলা। এই মিলন মেলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে হচ্ছে, নিজেদের স¤প্রীতির বন্ধন অটুট রাখার সাথে সাথে নিজের শিকড় আর নিজ ভ‚মির ভালোবাসার উষ্ণতা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া। সেই সাথে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের পাশে সাধ্যমত দাঁড়ানো।
উল্লেখ্য, ‘পাখি গ্রাম’ নামে খ্যাত এই ঝিকরাপাড়ার চারিদিকে রয়েছে বিশাল প্রান্তর জুড়ে সেই প্রাচীন রোমের এম্পিথিয়েটারের মত আবাদি জমি। অনেক দূর থেকে একটু উঁচুতে গড়ে উঠা এই গ্রামটি দেখা যায়। আর এই গ্রামের দুই তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম যেগুলোতে বসবাস করে সাঁওতাল, মুণ্ডা, মুড়ীয়ারী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। শত শত বছর ধরে এই প্রাকৃত মানুষগুলো একে অপরের মাঝে বিলিয়ে আসছে ভালোবাসা আর স¤প্রীতির সৌন্দর্য।
ঝিকড়াপাড়ার হাজী বাড়ির প্রাণ পুরুষ ছিলেন হাজী আতর উদ্দিন সরকার। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই গ্রামীণ জনপদের একজন জন দরদী ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে সম্মানীত ও পরিচিত ছিলেন তিনি। এমন এক গ্রামীণ এলাকায় সেই ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯৪৫ সালে একটি পাঠাগার। হাজী আতর উদ্দিন সরকারের পাঁচ পুত্র – করিম বক্স সরকার, কাদের বক্স সরকার, ইয়াকুব আলী সরকার, ইয়াসিন আলী সরকার ও নুরুল ইসলাম সরকারের উত্তরসূরিরাই এই গ্রামকে দিনে দিনে এক সৌন্দর্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের উদ্যোগেই প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মিলন মেলা।
ঝিকরাপাড়ার অগ্রগামী মানুষেরা শুধু নিজেদের গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশেই দাঁড়ায় না, বরং সব সময় পাশে দাঁড়ান আশে পাশের মানুষের কাতারে। বিশেষ করে আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের পাশে তারা সব সময় দাঁড়ান সাহায্য ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে। গত জানুয়ারি মাসের প্রচÐ শীতে এই গ্রামের কয়েক জন উদ্যমী যুবকের উদ্যোগে রাজশাহী শহরের ৮৬’র এসএসসি ব্যাচের সদস্যদের সহায়তায় আদিবাসী গ্রামের প্রায় দুই শত সদস্যকে কম্বল ও শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়। হয়তো মনে হতে পারে, এই সংখ্যাটা খুবই নগণ্য, কিন্তু যে প্রাণান্ত আগ্রহ আর সৌন্দর্যের স্বপ্ন নিয়ে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা যদি বাংলাদেশের সব জায়গায় নেয়া হতো, তবে গ্রামীণ এলাকার সমাজের চিত্র বদলে যেতো অনেকাংশে।
‘পাখি গ্রাম’ খ্যাত ঝিকরাপাড়ার মানুষেরা তাদের গ্রামকে এক আলোর গ্রাম হিসেবে তৈরি করে চলেছেন নিরন্তর। এই আলোর ভালোবাসার আঁচ টের পেয়েছে অসংখ্য নাম না জানা পাখি। যারা সততই নিজেদের প্রাণের টানে আর নিজেদের নতুন প্রজন্মকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য অবলীলায় চলে আসে এই গ্রামে।
ভয়হীন আনন্দে সময় কাটিয়ে চলে যায় পাখিগুলো অজানা কোন জায়গায়, তারপর আবার ফিরে আসে এক অনাবিল আনন্দ ভালোবাসায়। শিকড়ের টানে, বন্ধনের মিলনকে সামনে রেখে ঝিকরাপাড়া গ্রামে যে মিলন মেলার আয়োজন চলছে প্রতি বছর, তা চলুক সুন্দরভাবে আগামী বছরগুলোতে। আর এই আয়োজন দিন দিন এক অনন্য আলোকিত প্রাণের উচ্ছ¡াসে উদ্ভাসিত আলো ছড়িয়ে দিক দিক-বিদিক। পাখি আর মানুষ, উভয়েরই দেহমনে।