খুরশীদ শাম্মী : মানুষের জীবন রঙের কৌটো, যেভাবেই দেখি রং ছড়াছড়ি। ঋতু পরিবর্তনে রং বদলায় কখনো, উজ্জ্বল কিংবা ফিকে, তবুও রঙিন সর্বদা।
তখন আমার শিক্ষার্থী জীবন। ন্যায়-অন্যায় বিচার পোক্ত হয়নি ততো। মনের পর্দায় রঙটা গাঢ়। যা’ কিছু দেখি, লাগে ভালো। প্রেম টইটম্বুর অন্তরে সাঁতার কাটি দিবারাত্র। সিনেমার গল্প নিজের জীবনে মেলাতে সদাই থাকি ব্যস্ত। অবসর, অনবসর; এমন কি বাস, ট্রেন, লঞ্চ ভ্রমণেও খোলা জানালায় চলমান প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি মেলে প্রকৃতি দেখতে চাইনা, গল্প আঁকি মন ক্যানভাসে কত-শত, স্বপ্ন দেখি সুদর্শন যুবক হয়তো। সেইজন্য আমার তরুণ মনকে দোষারোপ করিনি কখনো, অভিযুক্ত হয়েছে লেখক, পরিচালকবৃন্দ। তাঁরা-ই তো বাস্তব জীবন দেখতে শিখিয়েছেন শিল্পে এঁকে। শিখিয়েছেন, প্রেম সে-তো অদ্ভুত এক শিল্প। শুধু কি প্রেম? কাহিনীতে প্রেম যদি ছিল সত্তর শতাংশ, বাকিটা শক্ত অংক। ন্যায়ের জন্য লড়াই, শত ঝড় উপেক্ষা করেও সত্যকে আগলে থাকার চেষ্টা, আধমরাদের জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা, পরচর্চা, সমাজের আদেখলেপনা, ঘিনধরা লালিত দৃষ্টি শনাক্ত করার উপায়গুলোও জানতে শিখিয়েছেন তাঁরা।
প্রজ্বলিত তারুণ্যে তখন নিঃশর্ত বন্ধুত্ব ছিল আমাদের দ্ব্যর্থহীন আলোচনা, ভালোবাসা, ভালোলাগা-মন্দলাগা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার একমাত্র জানালা। শিক্ষায়তনগুলোই মূলতঃ ছিল আমাদের মিলনায়তন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, যা-ই হোক বিদ্যালয়ে যাওয়া চাই-ই চাই। ওখানে ছিল যত শান্তি পেতে রাখা, অকারণে হাসাহাসি, কণ্ঠ জড়িয়ে মাতামাতি, ইচ্ছে হলেই হিসেবটাকে তুড়ি মেরে সরিয়ে ফেলি। অমৃত ছিল কলেজ ক্যান্টিনের শিঙাড়া, পিঁয়াজি, ডালপুরি, নষ্টপ্রায় চটপটিও। পেঁয়াজের গন্ধ নাসিকায় সুড়সুড়ি লাগিয়ে হাঁচি এনে দিলেও দলবেঁধে চটপটি খাওয়া বন্ধ হতো না। বৃক্ষছায়ায় প্রেমালাপকালে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার টালবাহানাও ছিল শত, ফাঁকা কক্ষে হ-য-র-ল-ব বসে বেঞ্চ চাপড়ে গল্পও হতো কত। শহর, দেশ, বিশ্বকে নিয়ে আলোচনা হতো বড়সড়। ঝড় উঠত তখন, যখন আলোচনা-সমালোচনাগুলো হতো রাজনীতি ভিত্তিক, কিংবা দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম নিয়ে পণ্ডিতদের মতামত হতো চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই করতে করতে দু’-চারজন বন্ধু ডুবে গেলো রাজনীতিতে। আর ডুববেই না বা কেন? সেই প্রথম দিন থেকেই তো সিনিয়র শিক্ষার্থীরা আমাদের পিছনে লেগেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেডেল দিয়ে নবীন বরণ করল, ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীরা লিফলেট দিয়ে সকলকেই সভায় নিমন্ত্রণ করল, ছাত্রশিবিরের শিক্ষার্থীরা অতিভদ্র বেশে সকল ধরণের সেবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে রাখল। শিরিন আপা, বলরামদা’ তখন তুখোড় ছাত্র নেতা-নেত্রী, কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী; কত্ত স্নেহ করত নবীনদের, তবুও আমাদের অনেককেই কখনো নিতে পারেনি তাদের মিছিল, আলোচনা সভায়। কেবল দূর থেকে শুনেছি তাদের বক্তৃতা। অতি কোমল মিষ্টিভাষী বিদূষী সহপাঠী যখন ক্লাস শেষে বৈকালীন পাঠ ও আলোচনায় নিমন্ত্রণ করল, খুশি মনে গেলাম সেখানে। বিরক্ত লাগল আলোচনায় উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে যখন তারা বলতে শুরু করল, “আল্লাহর নামে তারা সবকিছু করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।” তখন ভয় হলো মনে, “এ আমি কোন্ফাঁদে পড়লাম? সব দেখি ডান ঘেঁষা শিবিরের ছড়াছড়ি।” অভয় শক্তি সঞ্চয় করে মনকে সান্ত¡না দিলাম এই বলে, আমি তো ডান কিংবা বাম নই। আমি মানুষ। আমার যুক্তিতে ধর্ম অমূলক। যুক্তি ও বিবেকের বিচারে যখন যা’ সত্য প্রমাণিত হবে, আমি তখন সেই বিষয়টিকে সমর্থন করব। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ওইদিন আমার নীরবতা ও আলোচনার মাঝে বেরিয়ে পড়া পাঠ করেছিল উপস্থিত সকলে, হয়তো কেহ আমাকে ভুল বুঝেছিল, কেহ হয়তো সঠিক। তা’তে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কেননা রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী আমার ভাবনার মূল বিষয় ছিল না কখনোই।
তবে তখন আশ্চর্য হতাম রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় টিকে থাকা বন্ধুদের চালচলন দেখে। প্রশাসন, প্রশাসক, দল ও নেতা-নেত্রীদের নিয়ে মন্তব্য ছিল তাদের সর্বদা একরোখা। তর্কে হেরে গেলেও শিরদাঁড়া থাকত খাড়া। গহীন আডডার মাঝে হয়তো দূর থেকে ভেসে আসত, ¯েøাগানের আংশিক অংশ “‘বিচার চাই…বিচার চাই’, ‘…ভাইয়ের মুক্তি চাই’, ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, জ্বালো আগুন ঘরে ঘরে’।” খাড়াকর্ণে নিশ্চুপ হয়ে যেত দলভুক্ত বন্ধুরা। কোন্ দলের মিছিল পরিষ্কার হতো ¯েøাগানের চিহ্নিত অংশ “জয় বাংলা”, “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”, কিংবা “নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর” ধ্বনিতে। ¯েøাগানের নির্ধারিত দলের বন্ধুরা অমনি সকল খোশগল্প ভুলে তারা ছুটে যেত মিছিলে। কণ্ঠ মেলাত দলের অন্যান্যদের সাথে। মিছিলে তাদের হারিয়ে যাওয়া অনুভব করেছি বহুবার, কিন্তু কখনো সম্বন্ধস্থাপন করতে পারিনি।
খুব মনে পড়ে, একবার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোরা যে বিস্তারিত না জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়িস মিছিলে, মারামারি করিস অন্যান্য দলের ছাত্রদের সাথে, পুলিশের চোখ এড়িয়ে অন্যায় কাজ করিস, যদি তোর দলের নেতারাই ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে?” ওর উত্তরটা ছিল, সোজা ও দৃঢ়, “ব্যক্তিগত মতামত নয়, দলীয় মূল আদর্শটাই আমরা অনুসরণ করার চেষ্টা করি। আর সেজন্য যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিতেও হয়, তা আমরা সাদরে গ্রহণ করি।” আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ওকে, পড়ছিলাম ওর দৃষ্টি, ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গি।
আলতো করে বারবার সে স্পর্শ করছিল নাক ও কানের অগ্রভাগ। বিষয়টাকে সহজ করে আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, “দলনেতা যদি স্বার্থপর হয়? নিজ স্বার্থে দলের প্রতীকী আদর্শ ব্যবহারের ফাঁকে ফাঁকে যদি সকলকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করিয়ে নেয়? রাজনীতিতে এমন নজির তো বহু আছে।” তখন বন্ধুটির ঠোঁটের ভাঁজে এলোমেলো শব্দগুলোকে সাজালে এমন শোনা যেত হয়তো, “প্রতারক তো সর্বত্র আছে এবং থাকবে। তারপরও দল আগে।
দলনেতাকে অনুসরণ করা কর্মীদের কর্তব্য, যেমন স্কুলের শিক্ষকদের আদেশ মান্য করা শিক্ষার্থীদের কর্তব্য। প্রতিটি দলের ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক একটি কাজ হলো, নিজ দলের প্রতি কর্মীদের গভীর অনুগত মনোভাব তৈরি করা ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, আমাদের দলনেতারা ইতোমধ্যে তা’ করেছেন, সুতরাং আমরা তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখতেই পারি।”
বন্ধুর মন্তব্যে হতবাক হয়েছিলাম সেদিন যতটা, তারথেকেও বহুগুণ বেশি আশ্চর্য হই তাদের দেখে, যারা বয়সের ভারে প্রবীণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও একইভাবে নেতা-নেত্রীদের অন্ধের মতো অনুসরণ করে এবং সত্য-মিথ্যা বিচার না করেই বিরোধী দল ও দলভুক্তদের হেয় করতে শোরগোল বাঁধিয়ে রাখে। অথচ মুক্ত বাজারে ইহা খুবই স্পষ্ট যে রাজনীতি বাণিজ্য ব্যতীত অন্য কিছু নয়। রাজনৈতিক বাণিজ্য আবার বহুরূপী, বহুরঙী। যেমন ক্ষমতার বাণিজ্য, অর্থের বাণিজ্য, তোষামোদের বাণিজ্য, গুম-খুনের বাণিজ্য, ইত্যাদি, ইত্যাদি। রাজনৈতিক বাণিজ্যে সুশৃঙ্খলভাবে নিজের স্থান তৈরি করে নিতে যদি মেধা, প্রতিভা ও জনসেবা ব্যয় হয় ষোলো আনা, অন্যকে ধ্বংস করতে লাগে মাত্র এক আনা। আর ওই এক আনা হচ্ছে নীতি বিসর্জনের ইচ্ছেটা। রাজনীতিতে এক আনা ব্যয় করার নেতা-নেত্রী ও কর্মী সংখ্যা অসংখ্য। লোভী নেতা-নেত্রীগণ অভ্যাসগত কারণে প্রায়শ দলের বাইরেও চালিয়ে যান একই পদ্ধতি। তারা সমর্থন কেনা-বেচা করেন মেকি বন্ধুত্ব করে, জনসেবার নামে নিত্য-নতুন সংস্থা সৃষ্টি করে; একবার স্বার্থটা আদায় হলো, তো, শুরু হয় অন্যকিছু। স্বার্থ আদায়ে ঢিলেমি তাদের সহ্য হয় না তেমন, সুতরাং অপেক্ষা না করে শুরু করে নতুন কিছু, নতুন রূপে। লোভীদের লোভ দেখিয়ে একান্ত নিজের ও নিজ পরিবারের স্বার্থে তারা করতে পারে না এমন কিছু নেই। রস টইটুম্বর টোপ ফেলে তারা এক শত্রæকে নিজের অধীনে এনে দমন করে অন্য শত্রæ। তারপরও তারা নির্লজ্জের মতো প্রতিদিন লোক-লোকারণ্যে নীতির কথা বলে থুতু ছিটায়, জনগণের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে খোলা ময়দানে। তারা রং বদলায় ঘনঘন, প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে।
আমরা সাধারণ জনগণ, রং মেখে হোলি খেলতে পছন্দ করলেও, এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি রাজনীতিবিদদের পরিবর্তনশীল রং ও ঢং। তবুও কি রাজনীতি এড়িয়ে চলতে পারি? রাজনীতিবিদদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও রাজনীতির চালগুলো হালকা তুলোর মতো বাতাসে ওড়ে। দৃষ্টির অগোচরে লেপ্টে যায় সাধারণের জীবনে। অতঃপর তা পরিবার ও বন্ধু মহলেও সংক্রমিত হয়। সংক্রমিত হয় সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও সংগঠনগুলোতেও। এভাবে গোটা বিশ্ব সংক্রমিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতির চাল পাল্টে দেয় সাধারণ জীবনের রং। কারো জীবনে হয়তো তা আশীর্বাদ হয়ে ফুটে, কারো জীবনে অভিশাপ। নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণ ক্ষমতার ওপর। তবে তা’ একবারে উপেক্ষা করার উপায় থাকে না তেমন। যেমন আমিও পারিনি, সঠিক ধারণা না থাকায় শিক্ষার্থী জীবনে মিষ্টিভাষী সহপাঠীর চালে পড়ে অপ্রত্যাশিত এক সভায় উপস্থিত হয়েছিলাম। ওখানেই শেষ নয়, এরপরও বহুবার ধাপ্পাবাজদের প্রবঞ্চনায় বোকা বনেছি, কিন্তু কাটিয়েও উঠেছি প্রতিবার। এখনও চারপাশের এত্ত এত্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সম্পূর্ণ রঙিন আঁকা ছক দেখে ভীত হয় মন, আবার যদি নতুন করে কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বলির পাঁঠা হই? তখন কতটা বদলে যাবে আমার জীবনের রং?
খুরশীদ শাম্মী: টরন্টো, অন্টারিও
kjshammi@yahoo.com