মণিজিঞ্জির সান্যাল : সবুজ একটা পান পাতা চোখ আর মনকে কিন্তু সহজেই জয় করে নেয়। হাতে একটা পান পাতা নিয়েই দেখুন না। পান পাতার আকৃতি যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর তার ভেতরের কারুকার্য।

চোখ আর মনকে শান্ত আর স্নিগ্ধ করে তোলে এই পান পাতা। আসলে আমাদের প্রত্যেককেই প্রতিনিয়ত মনের সাথে লড়তে হয়। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়কে নিয়ে ভাবলে মনটাও যেমন সুন্দর হয়ে ওঠে, তেমনি ছোট ছোট ভাবনার মধ্যে দিয়েই জীবনের অঅপরিসীম ভাবনার দ্বারটাও খুলে যায়।

যাই হোক আজকে এই পান পাতা নিয়ে কিছু কথা বলি।
পান পাতা দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর। মাঝে মাঝেই অবাক হই বিভিন্ন পাতার বিভিন্ন রূপ এবং তার আকৃতি দেখে। কি সুন্দর দেখুন! পান পাতাকে জলের মধ্যে রাখার পর আরো জীবন্ত মনে হয়। সবুজ আমার এমনিতেই প্রিয় রং। তার মধ্যে এই সবুজ পাতা মনকে কেমন ভাল করে দেয়। যেমন ভাল করে দেয় কিছু দৃশ্য বা জীবনের কিছু মুহূর্ত।
পানের রসের অনেক উপকারিতা আছে। তাই বলে জর্দা, খয়ের, চুন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি পানের কথা বলছি না।
শুধু পানের রসের কথা বলছি।

তবে মাঝে মধ্যে অনেক কিছু খাওয়া দাওয়ার পর আয়েশ করে অনেকেই পান খান। কোনো নেশাই ভাল নয়,তাই বলে জীবনকে উপভোগ করব না? মুহূর্তের এই জীবনে মনকে ভাল রাখতে কিছু ভাল লাগাকেও প্রাধান্য দিতে হয়। তাই কোনো একদিন ইচ্ছে করলে ঠোঁটকে লালে লাল করাই যায়।
তবে খাওয়ার পর শুধু পানের পাতা নিয়ম করে খেলে উপকার কিন্তু প্রচুর।
যেমন পানের রস আমাদের হজম শক্তি বাড়ায়।
পান খেলে মুখের স্বাদ ফিরে আসে। পেট পরিস্কার রাখে। গলা পরিস্কার করে। ছোটবেলায় শুনতাম পানের রস খেলে কণ্ঠস্বর ভাল হয়। যারা গান বা আবৃত্তি করেন তাদের জন্যে এই পান পাতা ভীষণ উপযোগী।
পানের রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি কাশি কমে যায়। গ্যাস্ট্রিক আলসার নিয়ন্ত্রণেও পানের ভূমিকা প্রবল।
আরো এটি একটি পুরনো প্রথা আছে। আগেকার দিনে নববিবাহিত দম্পতিদের অনেকেই যৌন মিলনে যাওয়ার আগে পান খেতেন। এতে নাকি যৌন ক্ষমতা ও মিলনের স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধি পায়।

জানেন কি দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় খাবার হলো এই পান।
আরো একটি পেছনে যাই, সেই প্রাচীনকাল; যখন রাজা-বাদশাদের আমল থেকেই পান পাতায় তাম্বুল সাজিয়ে আপ্যায়ন করা হত অতিথিদের। অতিথি আপ্যায়নের এক প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল পান পাতা।শুধু তাই নয় যে কোনও মঙ্গলজনক কাজে এই পাতা না হলে সেই কাজ থাকত অসম্পূর্ণ। পানের কদর সেই সময় থেকে আজও এতটুকুও কমেনি।
পুজোপার্বন থকে শুরু করে যে কোনও অনুষ্ঠান বাড়ি আজও বাঙালির রীতি-নীতি পরতে পরতে জায়গা জুড়ে রয়েছে এই পান পাতা। শাস্ত্র মতে, ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাবেদ চুনে। পানের খিলিতেই বাস করেন ত্রিদেব। তাই এই পাতার গুরুত্ব অপরিসীম।
বিয়ে তো বটেই, সকল মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠানে পান-সুপারির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই এর ব্যবহার চলে আসছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ ধনপতি সওদাগরের বিবাহ উপলক্ষে পান-সুপারির (পান গুয়া) উল্লেখ রয়েছে-
‘তৈল সিন্দুর পান গুয়া বাটা করি গন্ধ চূয়া
আম্র দাড়িম্ব পাকা কাঁচা।
পাটে ভরি নিল খই ঘড়া ভরি ঘৃত দই
সাজয়্যা সুরঙ্গ নিল বাছা’।

আমরা প্রতিবছর দেখি বিজয়ার দিন উমাকে বরণ করা হয়। পিতাগৃহে ছুটি কাটিয়ে দশমীর দিন পতিগৃহে রওনা দেওয়ার আগে উমাকে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। দশমীর দিন উমা অর্থাত দুর্গাকে সিঁদূরে রাঙিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে, পান, ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করা হয়। উমার বরণের পরই সধবা মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদূর খেলায়।

অনেকেই খেয়ে উঠে পান মুখে পুরে ফেলেন। এতে নাকি তৃপ্তি মেলে। কিন্তু জানেন কী এই পান শুধু তৃপ্তিই দেয় না, বরং স্বাস্থ্যের পক্ষেও বেশ উপকারি। আগেকার দিনে অনেকেরই অভ্যাস ছিল পান খাওয়ার। তাই বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভাবে এর চাষও করা হয়। তবে চুন, সুপারি, মৌরি ব্যবহারে খাওয়ার মধ্যেই পান পাতার উপকারিতা শেষ নয়। এতে আছে বিভিন্ন ওষধিগুণও। আজও অনেকেই জানে না পান খাওয়ার উপকারিতা।

পান পাতা কে না চেনে? পান পাতা খুবই সাধারণ ও রোজকার জীবনে ব্যবহৃত একটি পাতা, কিন্তু এই পানের গুণ যে এতটাই বেশি সেকথা সবার জানা আছে কি? কতোজনই বা পানের উপকারীতার কথা ভেবে পান খান? অনেকেই হয়তো শখে পান খেয়ে থাকেন। কিম্বা কারো মুখে পান দেখলে অপর জন জানতে চান “পানের নেশা আছে নাকি?”
কিন্তু কারো জানা আছে কি ভারতবর্ষ ও চীন মিলিয়ে এই পান পাতা প্রায় ১০০ ধরণের চাষ হয়। পান পাতায় রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা ডায়বেটিস, দাঁতের সমস্যা ও ক্যান্সারের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে শরীরকে সুস্থ রাখতে পারে।

পানের সঙ্গে বাঙালির এক দারুন ও বহু পুরোনো সম্পর্ক বলতে পারেন। আগে বাড়ির মহিলারা দিনের সব কাজ কর্ম সেরে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে পানের বাটা নিয়ে আড্ডা দিতে বসতেন। এখনও বাড়ির ঠাকুমা-দিদিমাদের দেখা যায় এই দৃশ্যে। সবাই মিলে একসাথে পান খাওয়ার আড্ডা হয়ে যেত।

পান পাতার আরেক নাম হল সবুজ স্বর্ণ। এই নামের পেছনে বিশেষ কারণ হল এটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে প্রায় ৪০০ বছর ধরে একটি ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। পান পাতার বৈজ্ঞানিক নাম হল পিপার বিটেল কারণ এটি গোল মরিচের একটি জাত। পানের উপকারিতা বিভিন্ন ধরণের শরীরের সমস্যা যেমন মাথা ব্যাথা, ফুলে যাওয়া, কাটা ছেড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ইত্যাদি দূর করতে সাহায্য করে। পান পাতা থেকে তৈরি হয় এক বিশেষ ধরণের এসেনশিয়াল অয়েল যাতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাক্টিরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান।
শরীরের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে পান পাতার বিভিন্ন ধরণের উপকারিতা দেখা গিয়েছে। যেমন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করা, ব্যাথা কমানো ও ভাইরাল সংক্রমণ কমানো ইত্যাদি।

নানা পৌরাণিক ঔষধি তথ্যে পাওয়া গিয়েছে যে সর্দি ও ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হয়ে গেলে সর্ষের তেলে পান পাতা চুবিয়ে রেখে তা গরম করে বুকে মালিশ করলে ফুসফুসে বসে যাওয়া কফ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়া পান পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ালে তরল কফ একেবারে কমে যায়। ব্রঙ্কাইটিস মেটাতেও এই পান পাতা উপকারী। পান পাতা দিয়ে তৈরী এসেনশিয়াল অয়েল এক্ষেত্রে সমান ভূমিকা পালন করে থাকে।
ঠিক যেমন শরীরে ট্যাটু করা হয়, তেমনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে দাঁত লাল করা একটি প্রথা। এর ফলে দাঁতের নানারকমের সংক্রমণ ও ব্যথা দূর করা যায়।
খুব পান পাতা চিবোলে প্রাকৃতিক উপায় দ্বারা দাঁত লাল করা যায়। পান পাতায় রয়েছে ক্যাটেকোলামাইন যা মুখের ক্যান্সার রোধ করে।

খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে অনেকেই পান খেয়ে থাকে যার মূল উদ্দেশ্য হল খাবার হজম করা। পান পাতায় থাকা বিভিন্ন অ্যান্টি -মাইক্রোবিয়াল উপাদান যা অম্বল, গ্যাস ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। ফলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে পান পাতার উপকারিতা অনস্বীকার্য।
হজম ক্ষমতা বাড়লে ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই খাওয়ার ইচ্ছে শক্তি ও খাবারের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যাবে। ফলে সারাদিন ধরে যে পেট ভার, পেট জ্বালা বা অম্বল গ্যাসের সমস্যা সেগুলি কেটে যায়।

পান পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল উপাদান যা দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে মুখে আলসার বা ঘা হলে কমে যায়। শুধু তাই নয়, আলসারের ফলে যে মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে তা পান পাতার সাহায্যে দূর করা যায় কারণ পান পাতা দারুন একটি প্রাকৃতিক মাউথ ফ্রেশনারের মত কাজ করে। পানের রস ও গরম জলের সাহায্যে রোজ কুলকুচি করলে মাড়ির রক্তপাত সমস্যা দূর হয়।
শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে পানের উপকারিতা অনেকটাই বলা যেতে পারে। এই পাতা শরীরের দুর্গন্ধ দূর করা সুগন্ধি অর্থাত ডিওড্রেন্টের কাজ করতে পারে। প্রতিদিন স্নান করার আগে জলে পান পাতা চুবিয়ে সেই জল দিয়ে স্নান করলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের দুর্গন্ধ ও ঘামের গন্ধ দূর হয়ে যাবে।

পান পাতায় রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-মিউটাজেনিক ও অ্যান্টি-ক্যান্সার উপাদান যা ক্যান্সার রোধ করতে সক্ষম বলে জানা গেছে। এমনকি, যাদের ধূমপান করার নেশা থাকে, তারা পান পাতার সাহায্যে এই নেশা ছাড়াতে পারেন।
খাওয়ার পর পান পাতা খেলে হজম শক্তি বাড়ে। পেট পরিষ্কার থাকে যা ওজন কমানোর জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়া পান পাতার রস অতিরিক্ত ক্ষিদে কমিয়ে সঠিক মাত্রায় খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করা থেকে নিজেকে সহজেই দূরে রাখা যায়।

ষোড়শ শতাব্দীর একটি রান্না বইতে নিম্মত্মামা-ই নাসিরুদ্দিন-শাহী, মান্ডুর সুলতান গিয়াস-উদ-দ্বীন খলজি (১৪১৯-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) বর্ণনা করেছেন, সেরা মানের কোমল পান পাতার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, যখন তাদের উপর জাফরান যুক্ত করা হয়। বিস্তৃত সুপারি বা পানে চিবানোতে সুগন্ধযুক্ত মশলা এবং গোলাপ জলে কাটা সুপারি বাদাম থাকবে।
দক্ষিণ ভারত এবং আশেপাশের অঞ্চলে যে কোনও শুভ অনুষ্ঠানে অতিথিদের,পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই, পান পাতা, সুপারি (টুকরো বা পুরো) এবং নারকেল দেওয়া একটি ঐতিহ্য। এমনকি বিবাহিত মহিলাকে, বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথিদের দুটি পান পাতা, সুপারি এবং নারকেল বা কিছু ফল দড়িতে গাথা থ্রেডেড ফুলের মালা দেওয়াও একটি ঐতিহ্য। এটি তাম্বোলাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

দক্ষ পান প্রস্তুতকারক উত্তর ভারতে পানওয়ালা নামে পরিচিত। অন্যান্য অংশগুলিতে পানওয়ালাগুলি পানওয়ারি বা পানওয়াদি নামেও পরিচিত। উত্তর ভারতে, আশীর্বাদের জন্য দীপাবলি পুজোর পরে পান চিবানোর রীতি রয়েছে।
ভিয়েতনামে সুপারি এবং পান পাতাগুলি প্রেম এবং বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক যা ভিয়েতনামীতে “সুপারি এবং পান বিষয়” শব্দবন্ধটি বিবাহের সমার্থক। পান চিবানোর মাধ্যমে তরুণ দম্পতির বিবাহ সম্পর্কে বরের বাবা-মা এবং কনের পিতামাতার মধ্যে আলোচনা শুরু করা হয়। তাইজন্যে পান পাতা এবং রস ভিয়েতনামী বিবাহগুলিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত হয়।

কাঠমান্ডুর বেশিরভাগ বাসিন্দা মাঝে মাঝে পান খান। মিঠা পান নামে পানের একটি মিষ্টি সংস্করণ অনেকের মধ্যে জনপ্রিয় যারা সাদা পানের তীব্র স্বাদ পছন্দ করেন না। কিছু বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের বিশেষ অনুষ্ঠানে মিঠা পান খাওয়ার অনুমতি দেয় কারণ এটি তামাকমুক্ত।
প্রসঙ্গত পানের রস খাওয়া বা পান পাতা চিবিয়ে খাওয়া এক জিনিস কিন্তু পানের মধ্যে সুপুরি, চুন, অধিক মাত্রায় খাওয়া ঠিক নয়, আর জর্দা তো নয়ই। এতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়ে থাকে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ