ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ২৭তম ভার্চুয়াল আসরটি মে মাসের ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্য ‘ছিন্নপত্রাবলী’।

‘ছিন্নপত্রাবলী’ নিয়ে আলোচনা করেন ‘রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার’ ও ‘রবীন্দ্রজীবনে শিক্ষাগুরু’ গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা, রবীন্দ্র গবেষক, লেখক পীতম সেনগুপ্ত। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র সময়কালে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে ছিলেন দুইজন গুণী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শাহজাহান কামাল ও সেমন্তী মঞ্জরী।

১৮৮৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৯৫ এর ডিসেম্বর, এই আট বছরে, ভাইয়ের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে ২৫২টি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ- যা বাংলাদেশের পতিসর, শাহজাদপুর, বোয়ালিয়া, শিলাইদহ ছাড়াও আরো কয়েকটি জায়গা থেকে লেখা গড়ে এগারো দিন অন্তর একটি করে চিঠি। প্রথমে ১৪৫টি চিঠি নিয়ে ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ছিন্নপত্র’। পরে আরো ১০৭টি পত্র সংকলিত হয়ে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হয় ‘ছিন্নপত্রাবলী’।

বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পড়া একটা আর্ট। কারণ শহর থেকে শহরতলী, শহরতলী থেকে গ্রামবাংলার অন্তরাত্মা অন্বেষণ-পাঠের এ এক অদ্ভুত, বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একজীবনে অনেকেই ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পাতায় বারে বারে ফিরে গিয়েছেন। নানা সময়ে নানা অবসরে ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পাঠের এই অভিজ্ঞতা নিয়েই ছিল ‘পাঠশালা’র এবারের আসর।
আলোচক পীতম সেনগুপ্ত ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে ‘ছিন্নপত্রাবলী’ নিয়ে দশটি ভাগে আলোচনা হয় ।

ফারহানা আজিম শিউলী: ‘ছিন্নপত্রাবলী’র চিঠিগুলো নানা সময়ে পড়েছি যখন, তখন প্রকৃতির অমোঘ টানে ফিরে ফিরে গিয়েছি সেই বৃষ্টির বিকেলে, কখনো নৌকায় গড়াই-ইছামতী-পদ্মায় ভেসেছি, কখনো বা চলে গিয়েছি একেবারে বোলপুরের সেই নির্জন প্রান্তরে। কেন এমন হয় চিঠিগুলো পড়তে পড়তে? আপনারও এমন অনুভূতি কাজ করে?

পীতম সেনগুপ্ত: এই তো আমি গত সপ্তাহে অতিমারীর ভয়ঙ্কর ত্রাসের দিনে পড়ছিলাম ‘ছিন্নপত্রাবলী’, আর পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, এই চিঠিগুলো ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দিদশায় সকাল বিকেল সন্ধে রাতে শুয়ে বসে পড়েছি ঠিকই কিন্তু এই পড়াটা তো ঠিক স্থির নির্বাক চিত্রের মতো পড়া নয়, এতো এক দেখাও, যেন অবিছিন্ন-চিত্রাবলী এক। এই চিঠি রবীন্দ্রনাথ তো কোনো মনকুনো ঘরকুনো পাঠকের জন্য লেখেননি!

কোলকাতার সুনিশ্চিত ছাদ আর চার দেয়ালের ঘেরাটোপ থেকে তিনি বেরিয়ে সর্বপ্রথম বুঝেছিলেন যে মানুষের, বিশেষ করে বাঙালি জাতির আসলে দুটি রূপ, ঘরে আর বাইরে অর্থাৎ গৃহস্থ আর সন্ন্যাসী। ফলে সেই বাহিরমুখী সন্ন্যাসীর জন্য তিনি প্রকৃতি থেকে মানবজীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে লিখে রেখেছেন। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র নানাপত্রে তিনি যখন যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন, তখন এই দীর্ঘযাত্রাপথে, পথের দাবির কাছে গৃহস্থের যুক্তি-তর্ক-বিবাদ-হিসাব-নিকাশ মুলতুবি রেখে নিজের সঙ্গেই সময় কাটিয়েছেন। আর সেই মহার্ঘ্য সময়কে অক্ষরবন্দি করে রেখেছেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর জন্য। আদতে তাও তো নয়। এ তো আসলে তাঁর গৃহের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার মুক্তির কথা, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’- নিজেকেই পাখিপড়ার মতো করে বলা।

এ পর্যায়ে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান শাহজাহান কামাল ও সেমন্তী মঞ্জরী। প্রথম গান ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’ ১৮৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পতিসরে লেখা। রবীন্দ্রনাথ ৪ পংতির খসড়া করেন এই সময়। পরে ১৩১৫ সালের শারদোৎসবের জন্য এর কলেবর বৃদ্ধি করেন। এ গানটি পরে গীতাঞ্জলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটির স্বরলিপিকার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাঙালীচরণ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভীমরাও শাস্ত্রী। গীতবিতানের পূজা পর্যায় ও বিরহ উপপর্যায়ের, রামকেলি রাগে এ ব্রহ্মসংগীতটি গেয়ে শোনান শিল্পী শাহজাহান কামাল।

দ্বিতীয় গান ‘ওলো সই ওলো সই’ ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে নৌকায় রচিত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ, কবি যখন সপরিবারে শিলাইদহে থাকতেন, সেখানে গিয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন কবি-পতœীর খুব ঘনিষ্ঠ। দুই সখীর গল্প-আলাপাদির চিত্র আছে এই গানে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এ বিভাস-কীর্তনটি গেয়ে শোনান শিল্পী সেমন্তী মঞ্জরী।

ফারহানা আজিম শিউলী: রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্রাবলী’র প্রায় প্রতিটি চিঠির মধ্যে কোনো না কোনো বাক্যে ফিরে এসেছেন নিজের কাছে। এই ফিরে তাকানোর প্রয়াসের মধ্যে রবিঠাকুর নিজেকে দেখেছেন তাঁর বাঙালিয়ানার মধ্য দিয়ে, দেখেছেন স্বদেশ চেতনার বাঙ্ময়ে এবং সর্বোপরি দেখেছেন জনাকীর্ণ পরিসরের বাঁধা ডিঙিয়ে অনাকীর্ণ পরিসরে তাঁর সৃষ্টিসত্তার পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশের মধ্যে। তাই তিনি আড়াল চেয়েছেন দিনের শেষে, কাজের শেষে এবং একান্তভাবে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছেন প্রকৃতির কোলে।

চিঠিগুলো পড়তে পড়তে আমরা আস্বাদন করি সূ² কৌতুক রসের স্বাদ। নিজেকে নিয়ে অনর্গল ঠাট্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, যেন দৈনন্দিন জীবনের বাধ্য হয়ে-পরা মুখোশগুলো পরতে পরতে খুলে মেলে দিতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনারও কি একই অনুভূতি?

পীতম সেনগুপ্ত: আমরা ‘ছিন্নপত্রাবলী’র প্রতিটি চিঠির মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সেই শহুরে ইমেজকে বা অস্তিত্বকে ভাঙতে দেখি। তাঁর পারিবারিক সম্ভ্রমশুভ্র শুচিতাকে অক্ষুন্ন রেখেই তিনি নিজেকে আভিজাত্যের খোলস ছেড়ে বের করে আনতে চেয়েছেন নানা ভাবে। কখনো কাব্য করে, কখনো উপমা দিয়ে, কখনো বা সরাসরি নিজের মতামত জানিয়ে। প্রকৃতির কোলে তিনি যেন এক নবীন শিক্ষার্থী। বলেছেন সে কথা, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।…’ এও বলছেন, ‘ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি এবং আর-এক পারে প্রলয়।’ আমরা যেন কান পাতলে এর মধ্যে তাঁর ভাঙাগড়ার রূপ দেখতে পাই।

এর পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি পত্রেই তিনি নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। নানাভাবে করেছেন, কোথাও গাম্ভীর্য আর বিজ্ঞতা ফলিয়ে। তাই বলেছেন, ‘আমার নিজের অপার গাম্ভীর্য এবং অতলস্পর্শ বুদ্ধিমানের চেহারা কল্পনা করে সমস্তটা একটা প্রহসন বলে মনে হয়। প্রজারা যখন সসম্ভ্রম কাতরভাবে দরবার করে এবং আমলারা বিনীতভাবে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় এদের চেয়ে এমনি আমি কী মস্ত লোক যে আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবনরক্ষা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আমি যে এই চৌকিটার উপরে বসে বসে ভান করছি যেন এই-সমস্ত মানুষের থেকে আমি একটা স্বতন্ত্র সৃষ্টি, আমি এদের হর্তাকর্তাবিধাতা, এর চেয়ে অদ্ভুত আর কী হতে পারে!!’ আবার ঠিক এরপরেই তিনি করুণ সুরে বলছেন, ‘অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখদুঃখকাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোটো ছোটো বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর! এই-সমস্ত ছেলেপিলে-গোরুলাঙল-ঘরকন্না-ওয়ালা সরলহৃদয় চাষাভুষোরা আমাকে কী ভুলই না জানে! আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না।’

এই যে দ্ব›দ্ব, এই যে সঠিকভাবে প্রকাশিত না হবার তাড়না তা তিনি এই বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালায় থেকে বুঝেছিলেন। এই তীব্র অন্তর্দৃষ্টি, নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে এর আগে তিনি উপলব্ধি করেননি। শুধু তো নিজেকে নয়, জগৎকেও অকপটে দেখতে দিয়েছেন তাঁর অন্তরের স্বরূপকে।

আলোচনার এই পর্যায়ে গাওয়া হয় দুটো গান। প্রথম গান ‘হৃদয়ের এক‚ল ওক‚ল দুক‚ল ভেসে যায়’ ১৮৯৩ সালে শাহজাদপুরে লেখা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র?্য উপপর্যায়ের এই বিভাস-কীর্তনটি গেয়ে শোনান সেমন্তী মঞ্জরী।

দ্বিতীয় গান ‘পুষ্প বনে পুষ্প নাহি’ ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে রচিত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, ললিত-কালাঙড়া রাগে, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র?্য উপপর্যায়ের এ গানটি গেয়ে শোনান শাহজাহান কামাল।

ফারহানা আজিম শিউলী: ‘ছিন্নপত্রাবলী’র একটা বড়ো অংশ জুড়েই আছে পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, ইছামতী সহ আরো অনেক ছোটো ছোটো নদী। আর আছে পদ্মাবোট। এরাই নায়কের রূপে হাজির হয়েছে বিভিন্ন পটভূমিতে। নদীর দুই ক‚ল ও চর, চর জুড়ে শান্ত পল্লীগ্রাম, উদার ধরা ও উধাও আকাশ- সকাল থেকে দুপুর, সন্ধে থেকে রাত, আবার গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা, বর্ষা থেকে শরৎ, হেমন্ত বা কখনও বসন্ত, পটভূমি বদল হতেই থাকে। ‘ছিন্নপত্রে’র এমনই মানচিত্র বা বিশাল ক্যানভাস। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এর প্রভাব কেমন পড়েছিল?

পীতম সেনগুপ্ত: আসলে আমাদের বুঝতে হবে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শিলাইদহ পর্বের আগে ছিলেন নিপাট একজন নাগরিক কবি। প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে দীর্ঘদিন দেখার অবকাশ তাঁর হয়নি। পরন্তু পল্লীগ্রামের অন্তরকেও এত গভীরভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখে লিখেছিলেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।’ এখানেই তাই তাঁর প্রকৃতিপাঠের হাতেখড়ি হয়েছিল। এই সমৃদ্ধি থেকেই কবি হিসেবে তাঁর প্রকাশ পূর্ণ হবার বা পূর্ণতা প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।

পাশাপাশি এই জমিদারির সুযোগে পল্লীগ্রামের প্রত্যন্ত প্রান্তের পল্লীবাসীর সুখদুঃখের সাথী হবার দুর্লভ সুযোগটাও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসেবায় বিপুল পরিমাণে সাহায্য করেছিল। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন তিনি। শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে থাকাকালীন ঘুরে বেড়াতে গিয়ে যে জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল, তার প্রধান কুশীলব ছিলেন পল্লীর সহজ-সরল মানুষ, নিরন্ন কৃষক যারা তাঁর প্রজা সকল। এতে কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। তাঁর জমিদার সত্তাকে আড়ালে ফেলে সামনে চলে এলেন যে মানুষ, তিনি সবাইকে অকপটে বলতে পারলেন, ‘আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তা হলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত।’ অনেক চিঠিতেই জানা গেছে এই মানুষগুলোর জন্য তাঁর উদ্বেগ, তাঁদের বিপন্নতা, তাঁদের অসহায়তা নিয়ে তাঁর ভাবনা।

পাশাপাশি আবার অনেক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। কখনো নদীর চরে বোট নোঙর করে বসে দেখছেন নদীর দুই তীরের অসংখ্য দৃশ্যপট। বলেছেন, ‘একলা বসে বসে আমি যে এর ভিতরে কী অনন্ত শান্তি আর সৌন্দর্য দেখতে পাই সে আর ব্যক্ত করতে পারি নে।’ গ্রামের ঘাটের উপর বোট লাগিয়ে বলেছেন, ‘অনেকগুলো ছেলেয় মিলে খেলা করে, বসে বসে দেখি।’

তিনি দেখেছেন হাটের মানুষজন, কোনো বালিকা বধূর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া — এই যে বালিকা বধূর যাওয়া, তা কি শুধুই দেখেছেন দূর থেকে? নাকি সেই দেখার মধ্যে বাঙালি নারীর এক নিগূঢ় ক্রন্দনকে দেখেছেন। তাঁর সেই দেখাকে আমরা ফিরে দেখি একবার — ‘অবশেষে যখন যাত্রার সময় হল তখন দেখলুম আমার সেই চুল-ছাঁটা, গোলগাল হাতে বালা পরা উজ্জ্বল সরল মুখশ্রী মেয়েটিকে নৌকোয় তোলবার অনেক চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু সে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না — অবশেষে বহুকষ্টে তাকে টেনেটুনে নৌকোয় তুললে। বুঝলুম, বেচারা বোধ হয় বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে — নৌকো যখন ছেড়ে দিলে মেয়েরা ডাঙায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল, দুই একজন আঁচল দিয়ে ধীরে ধীরে নাক চোখ মুছতে লাগল।…’

এসব দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হল, ‘সকাল বেলাকার রৌদ্র এবং নদীতীর এবং সমস্ত এমন গভীর বিষাদে পূর্ণ বোধ হতে লাগল।’ বলেছেন, ‘এই অজ্ঞাত ছোটো মেয়েটির ইতিহাস আমার যেন অনেকটা পরিচিত হয়ে গেল।’

এই পরিচয় রবীন্দ্রনাথ যেন প্রত্যেক পল্লীবাসীর সঙ্গে করেছিলেন ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পাতায় পাতায়। কান পেতে তিনি শুনছেন পল্লী-জীবনের কলগুঞ্জন, নদীতে স্নান করতে অথবা জল নিতে আসা মেয়েদের কলধ্বনি অথবা প্রতিদিনের গল্প।

এ পর্যায়ে ছিল আরো দুটো গান। প্রথম গান ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’ ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই শাহজাদপুরে লেখা। রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে লিখেছেন ‘‘‘বড়ো বেদনার মতো’ গানের সুরটা ঠিক হয়তো মজলিসি বৈঠকি নয়। এ-সব গান যেন একটু নিরালায় গাবার মতো। সুরটা যে মন্দ হয়েছে এমন আমার বিশ্বাস নয়, এমন-কি ভালো হয়েছে বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হয় না। ও গানটা আমি নাবার ঘরে অনেক দিন একটু একটু করে সুরের সঙ্গে তৈরি করেছিলুম। ৃএ গানটা আমি এখনও সর্বদা গেয়ে থাকি — আজ প্রাতঃকালেও অনেকক্ষণ গুন্? গুন্? করেছি, গাইতে গাইতে গভীর একটা ভাবোন্মাদও জন্মায়। অতএব এটা যে আমার একটা প্রিয় গান সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের, কালাঙড়া রাগে এই গানটি গেয়ে শোনান সেমন্তী মঞ্জরী।

দ্বিতীয় গান ‘নহ মাতা নহ কন্যা’ ১৮৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর শিলাইদহের অভিমুখে জলপথে লেখা। এটি নাট্যগীতি ‘শাপমোচনে’ পরে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা ১৩০২ সালে লিখলেও ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের পৌষে শান্তিনিকেতনে কবির জীবদ্দশায় ‘শাপমোচনে’র শেষ অভিনয়ের জন্য কবি এই দীর্ঘ কবিতাটি মার্জনা করে গানটি তৈরি করেন। প্রফুল্লকুমার দাস স্বরলিপিকৃত, মিশ্র কানাড়া রাগে এই গানটি গেয়ে শোনান শাহজাহান কামাল।

ফারহানা আজিম শিউলী: সেই আমলে ব্রিটিশ উপনিবেশের ফলে ভারতবর্ষ এক ভারসাম্যহীন দেশে পরিণত হয়েছিল, যেখানে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রান্ত-দেশকে বঞ্চিত করেছে প্রতিনিয়ত। পশ্চিমী ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের তত্ত¡ ও প্রয়োগ নিয়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথের তীব্র আপত্তি ছিল। রবীন্দ্রনাথ এই ভারসাম্যহীনতা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন — গ্রামের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং দেশের শাসক যদি কেন্দ্রের পাশাপাশি গ্রামের দিকেও ফিরে তাকায়, তবেই কেবল উন্নয়ন সম্ভব। শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে সেইসময়ে কয়েক বছর থেকে ও দেখে তাঁর এই উপলব্ধি আরো প্রবল ও দৃঢ? হয়েছিল। এই সম্ভাবনার প্রকাশ কি শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন গড়ার সময় প্রভাব ফেলেছিল?

পীতম সেনগুপ্ত: ১৮৯৩ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে লেখা ‘ছিন্নপত্রাবলী’র একটি চিঠি পড়া যাক্। ‘ভারতবর্ষীয় ইংরেজগুলোকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি নে। তারা স্বভাবতই আমাদের বড়ো অবজ্ঞার ভাবে দেখে, আমাদের উপর তাদের কানাকড়ির সিম্প্যাথি নেই, তার উপরে আবার তাদের কাছে নিজেকে বীযরনরঃ করা আমার পক্ষে বড়োই কষ্টকর। …ইংরেজের ঘরে যত বড়ো গোরুই জন্মাক-না কেন সে যে আমাদের দেশের সকল লোকের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে সেটা মনের ভিতর বড়ো আঘাত করে। …এরা দেশের লোককে কিছু শেখাতে চায় না, দেশের ভাষাকে অবজ্ঞা করে, যে-কোনো বিষয়ে ইংরেজের চোখ পড়ে না সে-সকল বিষয়ে উদাসীন।’ এই কারণে তিনি শিলাইদহ থেকে শ্রীনিকেতন সর্বত্রই পল্লী উন্নয়নের কথা শুধু ভাবেননি, আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

আলোচনার এই পর্যায়ে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। প্রথম গান ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ ১৮৯৭ সালে চলনবিলে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে লেখা। এই গানের স্বরলিপিকার সরলা দেবী, অনাদিকুমার দস্তিদার ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইমন?কল্যাণ? রাগে, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এ গানটি পরিবেশন করেন শাহজাহান কামাল।
দ্বিতীয় গান ‘কে দিল আবার আঘাত’ ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে লেখা। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, কেদারা রাগে, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এ গানটি পরিবেশন করেন সেমন্তী মঞ্জরী।

ফারহানা আজিম শিউলী: ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পড়তে পড়তে বারে বারে একটা শূন্যতা থেকে পূর্ণতা বৃত্তে আমরা তরুণ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পাই। কবির জীবনে কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যুর বিষয়টি আমাদের মনে পড়ে যায়। এই অকালমৃত্যুর শোক তাঁকে সামলাতে হয়েছে পদ্মাপারের বিপুল অবসরকালে। বিবাহিত জীবন, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি সামলে উঠেছিলেন কয়েক বছরের এই জমিদারি জীবনে। হয়ত মৃত্যুর শোক কাটানোর ব্যাপারটাই রবীন্দ্রনাথকে এমন এক জীবনের কেন্দ্র খুঁজতে সুযোগ করে দিয়েছিল। মৃত্যুর শূন্যতা প্রকৃতির পূর্ণতা দিয়ে ভরাট করতে তিনি তৈরি হচ্ছিলেন এই পল্লীজীবনের মধ্যে। মৃত্যুর দুঃখ তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত আনন্দ দিয়ে ভুলতে চেষ্টা করেছিলেন। এজন্যই ‘ছিন্নপত্রাবলী’র চিঠিগুলোতে দুঃখ অতিক্রম করে আনন্দের একটা সুর বাজতে শোনা যায়, যে আনন্দ ‘আমাদের প্রতিদিনের তুচ্ছ বন্ধন’ থেকে আমাদের মুক্ত করে। আপনার কী মনে হয়?
পীতম সেনগুপ্ত: ‘ছিন্নপত্রাবলী’র একটি চিঠি ১৮৯৪ সালের ৭ অক্টোবর লেখা। একটু পড়ে শোনানো যাক্, ‘….তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি। …তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনো কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।…’ এই স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর সাহিত্য আলোচনায় নতুন বৌঠানের শূন্যস্থানে ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে বসিয়েছেন। কেন তাঁকে সেই স্থানে বসিয়েছেন? সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে, তখন তো তিনি বিবাহিত পুরুষ, তিন সন্তানাদির পিতা। তবু কেন তাঁর এই ইচ্ছে হয়েছিল? এর জবাব তিনিই দিয়েছেন সেই চিঠিতেই, ‘চব্বিশ ঘণ্টা যাদের সঙ্গে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত। …তোর এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে, এমন একটি সহজ সত্যপ্রিয়তা আছে যে, সত্য আপনি তোর কাছে অতি সহজেই প্রকাশ হয়। সে তোর নিজের গুণে। যদি কোনো লেখকের সবচেয়ে ভালো লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।…’
ঠিক এইখানে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’য় লেখা একটি কথা মনে পড়ে যায়, ‘মনে পড়ে পয়ারে ত্রিপদীতে মিলিয়ে একবার একটা কবিতা বানিয়েছিলুম; তাতে এই দুঃখ জানিয়েছিলুম যে, সাঁতার দিয়ে পদ্ম তুলতে গিয়ে নিজের হাতের ঢেউয়ে পদ্মটা সরে সরে যায়, তাকে ধরা যায় না। অক্ষয়বাবু তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই কবিতা শুনিয়ে বেড়ালেন। আত্মীয়রা বললেন — ছেলেটির লেখবার হাত আছে। বউঠাকুরনের ব্যবহার ছিল উল্টো। কোনো কালে আমি যে লিখিয়ে হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না। কেবলই খোঁচা দিয়ে বলতেন কোনো কালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারব না। আমি মন-মরা হয়ে ভাবতুম তাঁর চেয়ে অনেক নীচের ধাপের মার্কা যদি মিলত, তা হলে মেয়েদের সাজ নিয়ে তাঁর খুদে দেওর কবির অপছন্দ অমন করে উড়িয়ে দিতে তাঁর বাধত।’

এই যে রবীন্দ্রনাথের লেখক সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়, সেই সত্তার প্রয়োজনে কাদম্বরী দেবী থেকে ইন্দিরা দেবী হয়ে আরো নানা নারীর উপস্থিতি সারাজীবন লক্ষ্য করা গেছে তাঁর জীবনে।

আর ঠিক এই কারণেই হয়ত ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন, ‘এতদিন এই বৃহৎ আকাশের জন্যে ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষুধা ছিল।’ বা প্রকৃতির রূপের কাছে নানাবিধ দার্শনিক সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছেন এমন ভাবে — ‘কী এক বিশাল শান্তি এবং কোমল করুণার’ দেখা’ বা ‘আমাদের দেশের মাঠ-ঘাট আকাশ রোদ্দুরের মধ্যে একটা সুগভীর বিষাদের ভাব’- এর কথা বলে।

এ পর্যায়ে পরিবেশিত হয় দুটো গান। প্রথম গান ‘আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা’ ১৮৯৭ সালে নাগর নদীবক্ষে রচিত। এটির স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী। কালাংড়া রাগে, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এ গানটি গীত হয় শাহজাহান কামালের কণ্ঠে।

দ্বিতীয় গান ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না’ ১৮৯৭ সালে চলনবিলে ঝড়ের সময় টলমল বোটে লেখা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, ছায়ানট রাগে, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এ গানটি গীত হয় সেমন্তী মঞ্জরীর কণ্ঠে।

ফারহানা আজিম শিউলী: অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ছত্রে ছত্রে দেখা যায় তারুণ্যেভরা রবীন্দ্রনাথের ওপর যেন এক অসীম আলস্য ভর করে আছে। অথচ ইতিহাস বলে, রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন অত্যন্ত কাজের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁকে অলসতা পেয়ে বসেনি। তাহলে যে মানুষটি ছুটে বেড়িয়েছেন চিরকাল, তিনি এই দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরে বসে অমন আলস্যে দিন কাটিয়েছিলেন কেমন করে? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন।

পীতম সেনগুপ্ত: হ্যাঁ এইসব দিনযাপনের মধ্যে একটা আলস্য সত্যি সত্যি লক্ষ্য করা গেছে। কেজো মানুষটি এই উদার ধরার মাঝে, উধাও আকাশের নিচে কেমন যেন নিশ্চেষ্ট নিস্তব্ধ নিশ্চিন্ত নিরুদ্দেশ হয়ে যাপন করেছেন। একটি চিঠিতে ওই যে উল্লেখ করলেন, ‘পৃথিবী যে কী আশ্চর্য সুন্দরী এবং কী প্রশস্ত প্রাণ এবং গভীর ভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। যখন সন্ধেবেলা বোটের উপর চুপ করে বসে থাকি, জল স্তব্ধ থাকে, তীর আবছায়া হয়ে আসে এবং আকাশের প্রান্তে সূর্যাস্তের দীপ্তি ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে যায়, তখন আমার সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের উপর নিস্তব্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কী-একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি। কী শান্তি, কী স্নেহ, কী মহত্ত¡, কী অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ। এই লোকনিলয় শস্যক্ষেত্র থেকে ঐ নির্জন নক্ষত্রলোক পর্যন্ত একটা স্তম্ভিত হৃদয়রাশিতে আকাশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, আমি তার মধ্যে অবগাহন করে অসীম মানসলোকে একলা বসে থাকি —’

আমাদের এখানে বুঝতে হবে জোড়াসাঁকোর যৌথ পরিবারের মধ্যে থাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্রটি কিন্তু তার আগে চার দেয়ালের চৌহিদ্দির মধ্যে অত্যন্ত কড়া শৃঙ্খলা বা নিয়মের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। তাই সেই পারিবারিক হৈ-হুল্লোড়ের চৌকাঠ পেরিয়ে এসেই এইখানে তিনি প্রকৃতির কাছে ডানা মেলে দিয়েছিলেন। সেই যে ‘ছেলেবেলা’য় লিখেছিলেন, ‘নিয়মের শেখা যাদের ধাতে নেই, তাদের শখ অনিয়মের শেখায়’। এই ধরার প্রান্তরে এসে তাঁর তাই শখ হয়েছে অনিয়মের অবসরযাপন পালনে। তাই স্বীকার করেছেন এই বলে, ‘এই নিশ্চেষ্ট, নিস্তব্ধ, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্দেশ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটি বৃহৎসৌন্দর্যপূর্ণ নির্বিকার উদার শান্তি দেখতে পাওয়া যায়।’

নাগরিক ক্লান্তি থেকে এমন উদার শান্তি পেতেই তাঁর এমন আলস্য এসেছিল সেইসময়ে।
এই প্রসঙ্গে শিলাইদহ থেকে ১৮৯১ সালের ১৮ অক্টোবরে লেখা চিঠিটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘আমার বোধ হয় কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে এলেই মানুষের নিজের স্থায়িত্ব এবং মহত্তে¡র উপর বিশ্বাস অনেকটা হ্রাস হয়ে আসে।’ এরপরেই তুলনা করে লিখছেন, ‘এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি — চারিদিকে এমন জিনিস দেখা যায় যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশু দিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্মমৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে — প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্ত ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।’ এও বলেছেন পতিসর থেকে অপর এক চিঠিতে, ‘এখানে আমি দলছাড়া, এবং এখানকার প্রত্যেক দিন আমার নিজের দিন — নিত্য-নিয়মিত-দম-দেওয়া কলের সঙ্গে কোনো যোগ নেই।’

আলোচনার এ পর্যায়ে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হয়। প্রথম গান ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে’ ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে নৌকায় লেখা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, ইমন রাগে, গীতবিতানের বিচিত্র পর্যায় ও বিচিত্র উপপর্যায়ের এ গানটি গেয়ে শোনান সেমন্তী মঞ্জরী।
দ্বিতীয় গান ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’ ১৮৯৭ সালে শাহজাদপুরে রচিত। অনাদিকুমার দস্তিদার স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এই কীর্তনটি গেয়ে শোনান শাহজাহান কামাল।

ফারহানা আজিম শিউলী: ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পাঠ পাঠকের কাছে প্রকৃতি শিক্ষার অন্যতম প্রধান পাঠ হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের আগে এতো গভীর, এতো স্বচ্ছ, এতো বিস্তারিত এবং এতো আকুল করে কোনো লেখক বা কবি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটাননি। প্রকৃতিপাঠের নন্দনতত্ত¡ বা জাদুকরী মনমোহিনী ভাষায় প্রতিটি পত্র সমৃদ্ধ। তন্ময় হয়ে যেতে হয় পাঠ করার সময়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমস্ত দৃশ্যপট। বাংলাদেশের আকাশ-নদী-মাঠ-দুপুর-সন্ধ্যা-রোদ-আলো-হাওয়া-ঝড়-জল-বর্ষা-রাত ও অন্ধকারকে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখা যায়। যেন মনে হয় ‘দুপুর বেলায় স্নানাহারের পর বারান্দার সামনে একটি আরাম-কেদারার উপরে পা ছড়িয়ে দিয়ে অর্ধশয়ান অবস্থায় জাগ্রত স্বপ্নে নিযুক্ত ছিলুম।’ ররবীন্দ্রনাথের কথাতেই আমাদের মনের ব্যাখ্যা করা। তাই ‘ছিন্নপত্রাবলী’ না পড়লে আমাদের প্রকৃতি পাঠ অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেত। আপনার মতামত শুনতে চাই।
পীতম সেনগুপ্ত: আমি আপনার এই মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তবে সেই পাঠ আমাদের বাস্তবজীবনে কতটা আমাদেরকে সচেতন করেছে তা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত সন্দেহ আছে। মাত্র একশো সোয়াশো বছরের ব্যবধানে সভ্যতার ভয়ানক সংকট দেখা দিয়েছে। কবির দেখা সেই প্রকৃতিকে কি আমরা তেমন করে পাই? পাই না; আমাদের চোখের সামনে আমরা প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্যকে হরণ করে নিচ্ছি। যথেচ্ছাচার করছি প্রতিনিয়ত। আজ নদীগুলো সব মজে গেছে। বনবনানী কেটে নগরায়ন করছি। খাল বিল পুকুর বুজিয়ে চলেছি। কৃষিজমি অধিগ্রহণ করছি সভ্যতার বিকাশের জন্য। ফলে ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পড়ার মনোহারী মজাটা শুধু পড়ার ফাঁকেই। বাস্তবে আমরা বহুদূর চলে এসেছি। কবির ভাষাতে যেন ভারী একটা উদাস মৃত শূন্যতা বিরাজ করছে।

এ পর্যায়ে দুটো গান পরিবেশিত হয়। প্রথম গান ‘ঝর ঝর বরিষে বারিধারা’ ১৮৯৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শিলাইদহে লেখা। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র চিঠিতে গানটির চার লাইনের খসড়া আছে। এই গানের স্বরলিপিকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেঘমল্লার রাগে, গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ের বর্ষা ঋতুর এ গানটি সেমন্তী মঞ্জরী গেয়ে শোনান।

দ্বিতীয় গান ‘আজি যে রজনী যায়’ ১৮৯৩ সালের ২৯ জুন শিলাইদহে রচিত। ‘ব্যর্থ যৌবন’ কবিতায় আরও একটি স্তবক আছে। ইন্দিরা দেবী স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এই রবীন্দ্র-টপ্পা মতান্তরে কীর্তনাঙ্গের গানটি (ভৈরবী-কীর্তন) শাহজাহান কামাল গেয়ে শোনান।

ফারহানা আজিম শিউলী: প্রকৃতির উদার বিস্তারের মধ্যে আকন্ঠ নিমজ্জিত রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা অনেকভাবে নিজেকে উন্মোচন করেছে তা বলা বাহুল্য। পল্লী, নদী, শস্যক্ষেত, ঋতুভেদে আকাশ বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর বর্ণনায়। সেই চিত্রশিল্প যেন ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পাতায় কখনো বিমূর্ত, কখনোবা পরাবাস্তবতার পরশ নিয়ে পাঠকের কাছে হাজির হয়েছে। কবির একটি গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে —
‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা —
আনমনা যেন দিকবালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা।
যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্ খেয়ালির কোন্ আনন্দে
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকেলবেলা ।।
যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
তার হাতে দিই আমার ছন্দÑ কোথা যায় কে জানে সে।
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা।।’

কবির এই পথের নেশার অভিষেক ঘটেছিল বাংলার লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় ভেসে যেতে যেতে। দুহাত ভরে প্রকৃতি তাঁকে আনন্দের পাথেয় তুলে যেন আশীর্বাদ করেছিল, যা তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৯৫ সালের ১১ মার্চ শিলাইদহ থেকে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন সেখানে অকপট স্বীকারোক্তি ছিল এমন — ‘আমার গদ্যে পদ্যে কোথাও আমার সুখদুঃখের দিনরাত্রিগুলি এ রকম করে গাঁথা নেই।’ আসলে বড়ো বেদনার মতো বলেছেন তার আগেই, ‘যদি দীর্ঘকাল বাঁচি তা হলে এক সময় নিশ্চয় বুড়ো হয়ে যাব; তখন এই-সমস্ত দিনগুলো স্মরণের এবং সান্ত¡নার সামগ্রী হয়ে থাকবে।’

আপনার মতামত জানতে চাই।
পীতম সেনগুপ্ত: আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে — ‘ছিন্নপত্রাবলী’র বাংলাদেশ কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের কবি-কথা। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ, শিলাইদহ থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে শাহজাদপুর, শাহজাদপুর থেকে পাবনা, পাবনা থেকে নাটোর, নাটোর থেকে দিঘাপাতিয়া, দিঘাপাতিয়া থেকে পতিসর, পতিসর থেকে কালীগ্রাম এই হল তার মানচিত্র। গোরাই, আত্রাই, ছোট যমুনা, চলনবিল, ইছামতী, পদ্মা, যমুনা, নাগর এই নদীর ক‚ল থেকে ক‚লে তার গতিপথ। মনে রাখতে হবে, শিলাইদহ এবং শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ি ছাড়া গোটা পথটাই তাঁর বোটে কেটেছে রাতদিন।

আমরা এও জানি রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্রাবলী’ লেখার সময়কালেই অর্থাৎ ১৮৯১ সালেই প্রথম গল্প লিখতে শুরু করেন। এর আগে তিনি কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস লিখেছিলেন বটে, কিন্তু গল্প লেখেননি কোনো। তাই ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পড়তে পড়তে তাঁর কাব্যরসের কথা মনে হলেও প্রান্তিক মানুষের জীবনকথাকে যেন আমরা অস্বীকার না করি। কিভাবে জমিদারের বেশে উপস্থিত হয়েও তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘আমি তোমাদেরি লোক’ তার একটা উদাহরণ আজকের আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে দিতে চাই-

‘এখানকার প্রজাদের উপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে- এদের কোনোরকম কষ্ট দিতে আদবে ইচ্ছে করে না- এদের সরল ছেলেমানুষের মতো অকৃত্রিম আবদার শুনলে বাস্তবিক মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। যখন তুমি বলতে বলতে তুই ব’লে ওঠে, যখন আমাকে ধমকায়, তখন ভারী মিষ্টি লাগে। …এই প্রাচীন পৃথিবীতে কেবল সৌন্দর্য এবং মানুষের হৃদয়ের জিনিষগুলো কোনোকালেই কিছুতেই পুরোনো হয় না, তাই এই পৃথিবীটা তাজা রয়েছে …।’

‘ছিন্নপত্রাবলী’র পাতায় পাতায় এই পাওয়াটাই পরম পাওয়া, কি কবির কি পাঠকের।
এবারে পরিবেশিত হয় শেষ দুটো গান। প্রথম গান ‘এসো এসো ফিরে এসো’ ১৮৯৪ সালে শিলাইদহে রচিত। ১৮ই ভাদ্র কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার পথে রাণাঘাটে একদিনের জন্য রবীন্দ্রনাথ মহকুমা হাকিম নবীনচন্দ্র সেনের আতিথ্য গ্রহণ করেন। তখনই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সদ্য রচিত গানটি তাঁকে শুনিয়েছিলেন। এ গান রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘মেঘ ও রৌদ্র’-এ আছে। গল্পে একদল বৈষ্ণব ভিক্ষুক গুপিযন্ত্র ও খোল করতাল যোগে গাইছিল এই কীর্তনের শুরুর দিক এবং গল্পের নায়ক শশীভূষণ বাকিটুকু রচনা করে। প্রতিভা বসু ‘জীবনের জলছবি’তে লিখেছেন, ‘‘[দার্জিলিঙে] বদ্ধ কাচের জানালার সঙ্গে সংযুক্ত গোল ঘরের গোল গদির আসন, যেমন পাহাড়ি শহরে প্রায় সর্বত্রই থাকে, সেই আসনে বসতাম আমি, রবীন্দ্রনাথ বসতেন মুখোমুখি একটি বেতের আরাম কেদারায়, বাইরে কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বত আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠতো, আস্তে আস্তে পর্বতের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতো লাল গোল তপ্ত সূর্য, দৃশ্যের পট পরিবর্তন হতো। রবীন্দ্রনাথের কাঁপা কাঁপা গলার সঙ্গে আমি আমার গলা মিলিয়ে গান করতাম, ‘আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত’ [এসো এসো ফিরে এসো], এই গানটা রবীন্দ্রনাথ খুব ভালোবাসতেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই লাইনটাই গাইতেন, আমাকে একা গাইতে বলে চোখ বুজে শুনতেন।ৃ’’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরলিপিকৃত, গীতবিতানের প্রেম পর্যায় ও প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের এই ভৈরব-কীর্তনটি গেয়ে শোনান শিল্পী সেমন্তী মঞ্জরী।

সবশেষ ও দ্বিতীয় গান ‘ছিন্নপাতার সাজাই তরণী’ ১৯২৭ সালের ৫ মার্চ শান্তিনিকেতনে রচিত। এই গানটি ‘ছিন্নপত্রাবলী’র সময়কালে লেখা না হলেও এই গানের বাণী একেবারে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র অনুসঙ্গে রচিত। এটি খেয়াল-ভাঙা গান। এই গানের স্বরলিপিকার অনাদিকুমার দস্তিদার ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঝিঁঝিট রাগে, গীতবিতানের পূজা পর্যায় ও পথ উপপর্যায়ের এ গানটি পরিবেশন করেন শিল্পী শাহজাহান কামাল?

ফারহানা আজিম শিউলী: সংরক্ষণ ছাড়িয়েও রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ব্যাপারে আরো ব্যাপক ভূমিকা ছিল। আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।
পীতম সেনগুপ্ত: ইন্দিরা দেবীকে কেন চিঠি লিখেছিলেন সেটি এই আলোচনায় ইতিমধ্যে কিছুটা এসেছে, কাদম্বরী দেবীর আলোচনা প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো আসত এবং ইন্দিরা দেবী দুটো খাতায় লিখে রাখতেন। এই দুটো খাতা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথ সেই খাতা থেকে অনেক পরিমার্জন, সংশোধন ও সম্পাদন করে পরবর্তীতে সাহিত্যের আদলে ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশ করেন বিশ্বভারতী থেকে। ইন্দিরা দেবীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ এই কারণে যে, তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে বুঝেছিলেন এসব চিঠির সাহিত্যমূল্য এবং তিনি সেগুলোর অনুলিপি করে রেখেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বোনের মেয়ে সরলা দেবীর প্রায় শখানেক চিঠি বিনিময় হলেও সেগুলো কিন্তু সংরক্ষিত হয়নি। ফলে আমরা বঞ্চিত হয়েছি রবিজীবনের একটা অধ্যায় থেকে। রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, ইন্দিরা দেবীও নিশ্চয় তাঁকে লিখেছেন এবং ইন্দিরা দেবী লিখেছেন বলেই প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ এত কথা লিখেছেন। যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে বিশদভাবে জানতে চান তাঁদের কাছে ঐ চিঠিগুলোও খুব জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত এখনো আমরা চিঠিগুলো পাইনি। সেগুলো পেলে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র অর্ধবৃত্তটা পূর্ণবৃত্তে রূপ নিতো। একটা প্রাসঙ্গিক তুলনা দেওয়া যেতে পারে এখানে। রবীন্দ্রনাথ জগদীশ চন্দ্র বসু ও অবলা বসুকে যে চিঠি (চিঠিপত্র ৬) লিখেছিলেন, শুধু সেই চিঠিগুলোই বিশ্বভারতী প্রকাশ করেছে। ওদিকে বসু বিজ্ঞান মন্দির কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশ চন্দ্র বসু ও অবলা বসু তিনজনের চিঠিই প্রকাশ করেছে। ফলে একটা পূর্ণ বৃত্ত পাই আমরা। ‘পাঠশালা’র এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই বিশ্বভারতীর কাছে অনুরোধ জানাই, ইন্দিরা দেবীর চিঠিগুলো থাকলে যেন প্রকাশ করা হয়। তাহলে রবীন্দ্রনাথকে জানা আরো বেশি পূর্ণতা পাবে।

ফারহানা আজিম শিউলী: এবারে সবশেষ প্রসঙ্গ। প্রশান্তকুমার পাল ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য রবীন্দ্রজীবনী আছে আমরা জানি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ কেন আত্মজীবনী লেখেননি?

পীতম সেনগুপ্ত: রবীন্দ্রনাথ মজার মানুষ ছিলেন। তিনি ১টি গানের কেবল স্বরলিপি করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি স্বরলিপি করতে জানতেন, ইচ্ছে করেই করেননি।
রবীন্দ্রনাথ কেন আত্মজীবনী লেখেননি এবং আমরা কীভাবে সেটা পেতে পারি এই প্রশ্নটা আমি রেখেছিলাম দুজন প্রাজ্ঞ রবীন্দ্র গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তি — বাংলাদেশের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও পশ্চিমবঙ্গের সুধীর চক্রবর্ত্তীর কাছে। দুজনই বলেন — রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত জানতে গেলে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র পড়তে হবে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা সাড়ে ৭০০০ এর ওপর চিঠি পাওয়া গিয়েছে। আমরা যদি অনুপুঙ্খভাবে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো পড়ি, তাহলে রবীন্দ্রনাথের অনেকটাই না-বলা কাহিনি জানতে পারব।
রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর বয়সে ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করেন। প্রবাসী থেকে অনেক অনুরোধ উপরোধের মুখে তৎকালীন প্রবাসীর সহকারী সম্পাদক চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন — ‘বাঃ তুমি তো বেশ লোক! একেবারে আমার জীবনে হস্তক্ষেপ করতে চাও! এতদিন আমার কাব্য নিয়ে অনেক টানাটানি গিয়েছে — এখন বুঝি জীবন নিয়ে ছেঁড়াছেড়ি করতে হবে? সম্পাদক হলে মানুষের দয়ামায়া একেবারে অন্তর্হিত হয় তুমি তারই জ্বাজল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছ। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন জীবনটা থাক্।’

যদিও রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ লিখেছিলেন কিন্তু সেটা ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত ঘটনাগুলো নিয়ে এবং লিখেছিলেন সাহিত্যের আদলে। ‘ছেলেবেলা’ও ছোটোবেলাকার জীবন নিয়ে। ফলে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁর চিঠিপত্র পড়া ভীষণ জরুরি। বিশ্বভারতী এখন পর্যন্ত ১৮টি খণ্ডে চিঠিপত্র প্রকাশ করেছে। প্রশান্তকুমার পালের ৯ খণ্ডের ‘রবিজীবনী’ ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ৪ খণ্ডের ‘রবীন্দ্রজীবনী’র বাইরেও আমাদের চিঠিপত্র পড়া উচিত। ফলে আজকে আলোচিত ‘ছিন্নপত্রাবলী’র সাহিত্যমূল্য ছাড়াও আরো একটি মাত্রা আছে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্য ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ভীষণরকম ব্যাপ্ত ক্যানভাস তুলে ধরার দুরূহ কাজটি পীতম সেনগুপ্ত আসরের স্বল্প পরিসরে বেশ সার্থকভাবেই সম্পন্ন করেন। আলোচনার পাশাপাশি সঙ্গীত পরিবেশনায়, ‘ছিন্নপত্রাবলী’ যেন আরো বেশি মূর্ত হয়ে ওঠে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ বইটি নিয়ে পীতম সেনগুপ্তের গভীর, নিবিষ্ট ও সরেস আলোচনা এবং শিল্পী শাহজাহান কামাল ও সেমন্তী মঞ্জরীর ধ্যানমগ্ন সঙ্গীত পরিবেশনা পাঠশালার এবারের আসরটিকে এক অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করে। দর্শকরাও তাঁদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন তাৎক্ষণিক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে।