সাজ্জাদ আলী : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোট ছেলে রবির বিষয়বুদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। ছেলেটি কবি, লেখক, গায়ক, তা ঠিক আছে। কিন্তু খরচাপাতিতে তার যত ঝোঁক, রোজগারপাতিতে তত না! জমিদারের ছেলে প্রজা শাসন করবে, সেটাই তো কথা। কিন্তু বিষয়-আশয়ে ছেলের অনিহা। অগত্যা পুত্রদায়গ্রস্থ পিতা আদেশ করলেন রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য শিলাইদহে যেতে হবে। ঠাকুরদের জমিদারি তখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, রাজশাহীর কলিগ্রাম (পতিসর) এবং পাবনার শাহজাদপুর এলাকা জুড়ে বিশাল জমিদারি। এইসব এস্টেটের প্রধান সেরেস্তা ছিল শিলাইদহে। এ ছাড়া উড়িষ্যায়ও ঠাকুরদের কিছু তালুক ছিল।
শিলাইদহ জায়গাটি রবীন্দ্রনাথের বেশ পছন্দের। এখানকার জলবায়ু ও সংস্কৃতির সাথে তাঁর আগে থেকেই পরিচয় আছে। শৈশবে বাবার সাথে একবার গিয়েছিলেন সেখানে। এরপর ১৫ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার আসেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে। অবকাশ যাপনের জন্য রবি স্ত্রী পূত্র-কন্যাদের নিয়ে আরও একবার এসেছিলেন শিলাইদহে। তখন তাঁর বয়স ২৭। সে যাত্রায় সেখানটায় বেশ কিছুদিন ছিলেন। আর প্রায় পুরোটা সময়ই পদ্মার বুকে নৌকাবাস করে কাটান। ৩০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ আবারও এলেন শিলাইদহে। তবে এবার তিনি পুরোদস্তুর জমিদার।
ভারতবর্ষের প্রচলিত রীতিতে ‘জমিদার’ আর ‘প্রজা-পীড়ন’ প্রায় সমার্থক। কিন্তু শিলাইদহ স্টেটের নতুন জমিদারের মেজাজ আলাদা। একটা নমুনা বলি তবে। একবার খাজনা না দেওয়ায় এক প্রজার বিরুদ্ধে নালিশ হয়েছে। কাচারিতে বিচার সভা বসেছে। সেখানে জমিদার প্রজার পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন! বিচারিক কাজে নিযুক্ত পাইক পেয়াদারা তো হতবাক ! এমন আত্মঘাতি জমিদার কেউ কখনো দেখেছে?
খাজনা আদায়পত্রে মন নেই জমিদারের। বজরায় চড়ে দিনের পর দিন পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছেন। আর পাতার পর পাতা লিখছেন। জোড়াসাকোর শহুরে পরিবেশ থেকে গাঁয়ে এসে তার কাব্য প্রতিভা যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের রূপ পেয়েছে। জমিদারির কাজে বিরক্ত তিনি। ওই নায়েব গোমস্তারা যতটুকু করছে, তাতেই সই। জমিদার আছেন তাঁর লেখা-পড়া আর ‘প্রজা-মঙ্গল’ চিন্তায়।
শিলাইদহ অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকেরা প্রায় সবাই ঋণগ্রস্থ। মহাজনের উচ্চ সুদের ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে গৃহস্থ সর্বশান্ত। প্রজার এই দুর্দশা দেখে জমিদারের মন কাঁদে। ঠিক করলেন তাঁর জমিদারিতে কৃষিব্যাংক স্থাপন করবেন। সেখান থেকে প্রজারা স্বল্প সুদে ঋণ পাবে। কিন্তু জমিদারির আদায়পত্রের অবস্থা তো ভাল না। ব্যাংকের মূলধন আসবে কোথা থেকে? জমিদার হাত পাতলেন বন্ধু স্বজনদের কাছে। ধার কর্জের টাকা দিয়েই নিগিঢিগি অবস্থায় ব্যাংকের কাজ শুরু হলো।
কম সুদের এই ঋণ পেতে কৃষকদের মধ্যে বেজায় হুড়োহুড়ি। অচিরেই মূলধনে টান পড়ল। রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমন সময় নোবেল প্রাইজের ১,০৮,০০০ টাকা তাঁর হাতে এলো। একান্ত ইচ্ছা, টাকাটা শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কেই দেবেন। আবার প্রজাদের কাজে লাগলেও তিনি খুব খুশি হন। অবশেষে দুকুল রক্ষার একটা উপায় মিলল। টাকাটা শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের নামে কৃষিব্যাংকে ডিপোজিট রাখা হলো। বিনিময়ে ব্যাংক বিদ্যালয়কে বাৎসরিক ৮,০০০ টাকা লাভ দেবে।
শিলাইদহ পরগণার কৃষকরা মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত। ছোটখাট বিষয়ে থানা পুলিশ করতেই তারা ব্যতিব্যস্ত। এ অবস্থা থেকে প্রজাদের রেহাই দিতে জমিদার উদ্যোগ নিলেন। গ্রামগুলোর পঞ্চায়েতদের নিয়ে মণ্ডলীপ্রথা চালু হলো। আদেশ জারি হলো যে বড়সড় ফৌজদারী অঘটন ছাড়া প্রজারা থানা পুলিশ করবে না। পরস্পরের মধ্যে বিবাদ হলে গাঁয়ের লোকেরা মণ্ডলীসভায় নালিশ জানাবে। বিচারে কেউ অসন্তুষ্ট হলে আপিলের ব্যবস্থা থাকবে। আপিলসভার রায়েও যদি নিস্পত্তি না হয়, তবে জমিদার স্বয়ং চূড়ান্ত বিচার করবেন। শিলাইদহ পরগণার প্রজাদের এর সুফল পেতেও বিলম্ব হলো না।
তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজা জমিদারেরা ছেলেপেলেদের ব্যারিষ্টারি পড়াতে বিলাত পাঠাতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেকে আমেরিকায় পাঠালেন চাষাবাদ পড়তে। উদ্দেশ্য হলো, কৃষক-প্রজাদের আধুনিক চাষ পদ্ধতি শেখানো। প্রজা-কল্যাণের চিন্তা এই জমিদারের মাথায় সারাক্ষণ কিলবিল করে। চার বছর বাদে ছেলে রথীন্দ্রনাথ কৃষিবিজ্ঞান পড়ে দেশে ফিরলেন। বাবা তাকে শিলাইদহ ডেকে পাঠালেন।
দরীদ্র চাষাদের হালের বলদ কেনার সাধ্য নেই। মানুষের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে তারা জমি চাষ করে। আমেরিকা থেকে কলের লাঙ্গল ও কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে আনা হলো। জমিদারপুত্র রথীন্দ্রনাথ ট্রাক্টর দিয়ে কৃষকের জমি চাষে সাহায্য করতে লাগলেন। এক বিঘা জমি চাষ করতে কৃষকদের লাগতো দুদিন। মেশিনের কল্যাণে এখন দিনে চাষ হয় শত বিঘা। আর খরচ বিঘাপ্রতি মাত্র আট আনা!
শিলাইদহ অঞ্চলের মাটি দোআঁশলা এবং তা অতি উর্বর। কিন্তু চাষীরা সে জমিতে বছরে একবারই ধান চাষ করে। আর বাকি সময়টা সেই জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। জমিদার অনুভব করলেন, এ সব জমিতে দ্বিতীয় কোনো ফসল ফললে কৃষকের দুর্দশা ঘুচবে। কিন্তু এ অঞ্চলের কৃষকেরা তো একই জমিতে দুবার ফসল ফলানোর কৌশল জানে না। ঠাকুর এস্টেটের উদ্যোগে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি সংলগ্ন বিশাল খাস জমিতে প্রদর্শনী খামার গড়ে তোলা হলো। সেখানে আলু, টমেটো, আখ, ভুট্রা ইত্যাদি ফসলের চাষ হতে থাকল। তার দেখাদেখি অনেক চাষীই বছরে দুই ফসল ফলানোটা বুঝে নিলো।
দশ বিষ গাঁয়ে কোনো ডাক্তার নেই। দরীদ্র মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরে। ফকির কবিরাজদের তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুকই গরীবের চিকিৎসা-সম্বল! জমিদার প্রজাদের পাশে দাঁড়ালেন। গড়ে তুললেন একাধিক বিনামূল্যের চিকিৎসালয়।
ওদিকে আবার প্রজাদের শিক্ষার কোনো সুযোগই নেই। দিনে দিনে তারা কুসংস্কারের গহবরে নিমজ্জিত হচ্ছে। শিলাইদহ স্টেটের উদ্যোগে গাঁয়ে গাঁয়ে পাঠশালা গড়ে উঠল। নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ও হলো কয়েকটি। সেখানে সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা।
প্রতি বছর বর্ষা এলেই এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার মহামারি দেখা দেয়। শত শত লোক বেঘোরে প্রাণ হারায়। প্রজার দুর্দশায় জমিদার কাতর! তিনি মশা মারার উদ্যোগ নিলেন। নিজ খরচে পরগণার জঙ্গলগুলো কেটে সাফ করালেন। মজা পুকুরগুলো সংস্কারের ব্যবস্থা হলো। প্রজারা পেল সুপেয় জল।
শিলাইদহ অঞ্চলে খরা বন্যা লেগেই আছে। কোনো বছরেই চাষীরা নির্বিঘেœ ফসল ঘরে তুলতে পারে না। ছয় মাসেই ঘরের খাবার শেষ। এরপর থেকেই শুরু হয় আধাপেট খেয়ে থাকার পালা। প্রতি বছর এ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ফিরে ফিরে আসে। প্রজারা না খেয়ে মরবে, শিলাইদহের জমিদারের তো তা সইবে না! তিনি স্টেটের আয়ের কিছু অংশ ব্যয় করে একটি ধর্মগোলা প্রতিষ্ঠা করলেন। অভাবের সময়ে অনাহারী মানুষেরা সেখান থেকে বিনামূল্যে খাবার পেত।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারীর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই তাঁর সম্মানে কাচারিতে দরবার বসল। সর্বস্তরের প্রজারা সেখানে নিমন্ত্রিত। জমিদার লক্ষ করলেন হিন্দু প্রজারা বসেছে চেয়ারে বা বেঞ্চিতে, আর মুসলমান প্রজাদের বসতে দেওয়া হয়েছে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে। ভরা মজলিসে জমিদার এ বৈষম্যের কারণ জানতে চাইলেন। আমলারা বললে, বাবুমশাই এ তো প্রাচীন প্রথা। প্রজা শাসনের জন্য এ ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। সেই প্রিন্সের আমল থেকে মহর্ষির আমল অব্দি এমনই তো চলে আসছে (রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
নতুন জমিদার বেঁকে বসলেন। প্রজাদের মধ্যে বৈষম্য রেখে কোনো সম্মাননা তিনি নেবেন না। আদেশ দিলেন তৎক্ষনাৎ যেন সব প্রজাদের একই রকমের বসার ব্যবস্থা করা হয়।
এমনই ছিলেন শিলাইদহের জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)
তথ্যসূত্র : ছিন্নপত্রাবলী
ছেলেবেলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ, আনোয়ারুল করীম
সমবায়নীতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর