রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবত কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহত মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
সাতান্ন.
চতুর্দশ অধ্যায়
গভীর মূল্যবোধ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ফক্স অধিগ্রহণ চুক্তিটি নিস্পন্ন করার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সমূহের সাথে দেন-দরবার এখনও শুরু করতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে রাশিয়া, চীন ও ইউক্রেন এবং ইইউ, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং ব্রাজিল ও মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে ব্যাবসা করার জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সমূহের অনুমোদন পেতে হবে। লাগাতার কয়েক মাস চেষ্টা করে একটা অঞ্চলের অনুমোদন পেয়েছি। অবশেষে ২০১৯ এর মার্চ মাসে প্রত্যেকটি দেশের আনুমোদন পাওয়া গেল। রুপার্টের সাথে আমার প্রথম কথোপকথনের উনিশ মাস পরে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিটি সম্পন্ন করতে পারলাম। এখন থেকে আমরা একটা একক কোম্পানি হিসাবে যাত্র শুরু করলাম।
চুক্তিটি একবারে ঠিক সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। পরের মাসে ১১ এপ্রিলে আমরা একটা বিস্তৃত, শ্রমসাধ্য, নানান ভাবে পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে নিখুঁতভাবে নির্মিত ডিজনি আ্যাপ বিনিয়োগকারীদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি যার মাধ্যমে সরাসরি ভোক্তার সাথে ব্যাবসা করা যাবে। এটির শুভ উদ্বোধন হবে ডিজনি চত্বরে। ফক্স অধিগ্রহণ চুক্তি আমরা যদি সময়মত সম্পন্ন করতে না পারতাম তবে বিনিয়োগকারীদের এই সমাবেশটি অন্য রকম। এত জাঁকজমকপূর্ণ হত না। অনুষ্ঠানে শত শত বিনিয়োগকারী উপস্থিত হয়েছিলেন। শতাধিক মিডিয়া কর্মীর সমাবেশ ঘটেছিল। তারা একটা সুসজ্জিত বিশাল স্টেজের সামনে সারিবদ্ধভাবে বসেছিলেন। সব মিলে এক অপরূপ দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে যখন আমরা প্রস্তুত হব তখন আমরা আমাদের নতুন স্ট্রিমিং পরিসেবা সম্পর্কে তাদের কাছে তথ্য শেয়ার করবো। স্ট্রিমিং পরিসেবা সম্পর্কে ঠিক কি পরিমান তথ্য শেয়ার করবো তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ছিল। আমি তাদের সবকিছুই দেখাতে চেয়েছিলাম। আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বচ্ছ ও অকপট ছিলাম। অতীতে ২০১৫ সালের সেই দুর্ভাগ্যজনক আয় উপার্জনের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা সকলেই সমস্যাগুলো চাক্ষুস দেখেছিলাম এবং তা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। এখন আমরা সমস্যার সমাধানে যা করতে সক্ষম হয়েছি সে সম্পর্কে সকলকে স্পষ্ট করে বলতে চাই। যা সত্য, যা বস্তব তা স্বতস্ফুর্তভাবে মেনে নেওয়াই কাজের কথা। আমি আমাদের তৈরি নতুন চলচ্চিত্র এবং সেটি ভোক্তার কাছে সরাসরি সরবরাহ করার যে প্রযুক্তি আমরা নির্মাণ করেছি তা তাদের দেখাতে চেয়েছি । ফক্স কিভাবে এই নতুন কৌশলের সাথে পুরোপুরি ফিট করে তা প্রদর্শন করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়াও এতসব উদ্যোগের নাটকীয় প্রভাব কি হতে যাচ্ছে সেটিও তাদের সম্মূখে তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাদের সামনে গৃহীত সকল উদ্যোগের খরচ কত হয়েছে তার একটা স্বচ্ছ হিসাব তুলে ধরতে চাই। স্বল্পমেয়াদে ক্ষতির পরিমান কেমন ছিল এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রাক্কলিত লাভের পরিমান কেমন হবে তার একটা তুলনামূলক চিত্র তাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় এক মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড কথা বললাম। ডিজনি এবং ফক্স যে সমস্ত সুন্দরভাবে নির্মিত চলচ্চিত্র মানুষের সামনে এনেছে তা চিরকাল ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমরা দুটি কোম্পানি আজ একত্রিত হয়েছি, আমরা একত্রিত হয়ে নতুন দিকে এগোচ্ছি কিন্তু আমাদের হৃদয়ে রয়েছে সৃজনশীলতা। বছরের পর বছর ধরে কোম্পানি দুটি বিষ্ময়কর আর অসাধারণ বিনোদন শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছে যা কখনও মানুষের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না। আর এখন আমরা একত্রিত হয়েছি, একিভূত হয়েছি, এখন থেকে আমরা আগের চেয়ে আরও জোরেসোরে কাজ শুরু করবো।
২০০৪ সালে ডিজনি বোর্ডের সামনে ডিজনির প্রধান নির্বাহী পদে মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার সময় আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম এই সমাবেশ তার জোড়াল প্রমান। বলেছিলাম অতীতের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার সময় নেই। শুধুমাত্র ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার দিকে মনোযোগী হতে হবে। সেদিন আমি বলেছিলাম শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ডের পণ্য-সামগ্রী উত্পাদন, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ আর বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান বাজারের প্রসারের কথা। আমি তখন আন্দাজ করতে পারিনি কিভাবে আমরা তা করব। আমি কখনই এইরকম একটি দিনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারিনি। আমি ভাবতেও পারিনি তখনকার আমার সেই রূপকল্পের তিনটি স্তম্ভ এত প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হবে। আমরা কোম্পানির জন্য ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রদর্শন করেছিলাম মাত্র।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/07/Bk-02.jpg?resize=696%2C905&ssl=1)
একে একে ডিজনি, পিক্সার, মার্ভেল, স্টার ওয়ার, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আমাদের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রধানরা মঞ্চে আসলেন। সতর্কতার সাথে চয়নকৃত যে সমস্ত সিনেমা শো, টিভি সিরিয়াল, ছায়াছবিসমূহ সুবিন্যাসিতভাবে আমাদের নতুন স্ট্রিমিং পরিষেবাতে আপলোড করা হয়েছে তারা সেগুলোর বর্ণনা দিলেন। তিনটি নতুন মার্ভেল সিনেমা শো স্ট্রিমিং পরিষেবাতে অবমুক্ত করা হয়েছে। লুকাসফিল্মের দুটি নতুন সিরিজ আপলোড করা হয়েছে যার মধ্যে প্রথম স্টার ওয়ার্স লাইভ-অ্যাকশন সিরিজ, দ্য ম্যান্ডালোরিয়ান। একটা পিক্সার সিরিজ, নতুন ডিজনি টেলিভিশন শো এবং লেডি অ্যান্ড দ্য ট্র্যাম্প সহ লাইভ-অ্যাকশন চলচ্চিত্র আছে। সব মিলিয়ে পঁচিশটিরও বেশি নতুন সিরিজ এবং দশটি মৌলিক বিশেষ চলচ্চিত্র চলতি বছরে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল সেগুলির সবকটিই একই স্তরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে গুণগত মান বজায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। সবকটি ফিল্ম বা টেলিভিশন শো আমাদের স্টুডিওতে নির্মাণ করা হয়েছে। কার্যত পুরো ডিজনি লাইব্রেরি ১৯৩৭ সালে স্নো হোয়াইট এবং সেভেন ডোয়ার্ফের পর থেকে তৈরি প্রতিটি অ্যানিমেটেড ফিল্মও এই পরিসেবায় সরাসরি ভোক্তা উপভোগ করতে পারবেন। বেশ কয়েকটি মার্ভেলের ব্যানারে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মার্ভেল এবং অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম। ফক্সের দ্য সিম্পসন-এর সকল এপিসোড, ছয়শো শো বা তারও বেশি এখানে অফার করা হয়েছে।
পরে উপস্থাপনা করলেন উদয় শঙ্কর। উদয় শঙ্কর এশিয়াতে আমাদের ব্যাবসা পরিচালনার নতুন সভাপতি। তিনি ভারতের বৃহত্তম স্ট্রিমিং পরিষেবা ‘হট স্টার’ সম্পর্কে কথা বলার জন্য মঞ্চে আসলেন। আমরা সরাসরি ভোক্তার কাছে আমাদের পণ্য পৌছে দেবার কৌশলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং এখন ফক্স অধিগ্রহণের ফলে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ বাজারগুলির মধ্যে একটিতে সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং পরিসেবা ব্যবসার মালিক হয়েছি। বিশ্বব্যাপী এই ব্যাবসার প্রসার আর প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয় ছিল।
অ্যাপটি স্মার্ট টিভিতে বা ট্যাবলেটে বা ফোনে কীভাবে কাজ করবে তা প্রদর্শন করার জন্য কেভিন মায়ার মঞ্চে আসলেন। স্টিভ ২০০৫ সালে আমার অফিসে নতুন একটা ভিডিও আইপডের আদি সংস্করণ হাতে নিয়ে আমাকে দেখাচ্ছেন – এই দৃশ্যটি মনের মুকুরে ভেসে উঠল। এই মুহূর্তে স্টিভকে স্মরণ না করা আমার জন্য অসম্ভব? আমরা দুজনে পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতাম। পরিবর্তনকে বেছে নেবার জন্য আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অন্যদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াতাম। এখন আমরা ঠিক তাই করছি। প্রায় পনেরো বছর আগে স্টিভ আর আমি নিজেদেরকে যে প্রশ্নগুলো করতাম সেগুলো হল: উচ্চ-মানের ব্র্যান্ডেড পণ্যগুলি কি পরিবর্তিত বাজারে আরও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে? আমরা কীভাবে আমাদের পণ্যগুলি আরও প্রাসঙ্গিক, আরও সৃজনশীল উপায়ে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেব? মানুষের ভোগ-বিলাসের জন্য কোন নতুন অভ্যাস সৃষ্টি করা যায় এবং আমরা কীভাবে সেগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিব? কীভাবে আমরা প্রযুক্তিকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যাবহার না করে উন্নয়নের শক্তিশালী নতুন হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করব?
অ্যাপটি তৈরি এবং কন্টেন্ট নির্মাণ খরচ আর আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত ব্যবসাগুলিকে কমিয়ে আনার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সব একসাথে যোগ করে হিসাব করলে দেখা যাবে প্রথম কয়েক বছর আমাদের মুনাফার পরিমান বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। মুনাফার অঙ্কে সফলতা পরিমাপ করার জন্য কিছু সময় পার করতে হবে। প্রথমত গ্রাহকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমরা চাই বিশ্বজুড়ে পরিষেবাটি যতটা সম্ভব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠুক। আমরা একটা মূল্য নির্ধারণ করেছি যেটি দিয়ে আমরা অনুমান করছি যে প্রথম পাঁচ বছরে ষাট থেকে নব্বই মিলিয়ন গ্রাহক হবে। কেভিন যখন ঘোষণা করলেন এই পরিসেবার গ্রাহক হবার জন্য গ্রাহককে প্রতি মাসে ৬.৯৯ ডলার খরচ করতে হবে, তখন সকলে একটা স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাস নিলেন।
ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিক্রিয়া আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৫ সালে আমাদের স্টকের মূল্য খুব আকস্মিকভাবে, দ্রুত নিচে নেমে গিয়েছিল যখন আমি ব্যাবসায়িক সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলাম। এখন স্টকের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের বিনিয়োগকারীদের সম্মেলনের পরের দিন এটি ১১ শতাংশ লাফিয়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। মাসের শেষের দিকে এটি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালের পুরো বসন্ত মৌসুম ব্যাপী ঊর্ধ্ব গতি বজায় থাকল। সিইও হিসাবে আমার মেয়াদের যে কোন সময়ের চেয়ে এটা ভাল সময় ছিল। আমরা অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম রিলিজ করেছি, যা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আয়কারী সিনেমা। পরে ডিজনিল্যান্ডে আমারা নতুন স্টার ওয়ার্স চালু করলাম, নাম গ্যালাক্সি’স এজ। তারপর কমকাস্টের মালিকানায় থাকা হুলুর অবশিষ্ট শেয়ারগুলো কিনলাম। ডিজনি+-এ দেখা যাবে না এমন চলচ্চিত্রগুলো হুলুতে দেখা যাবে। হুলু আমাদের সাবস্ক্রিপশন স্ট্রিমিং পরিষেবা হিসাবে কাজ করবে। এই পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা আবার পুরস্কৃত হয়েছেন? অতীতে যদি আমাকে কিছু শিখিয়ে থাকে তাহল এই আকারের বিশ্বের এত বড় কোম্পানি যেখানে এত কর্মচারীর সমাবেশ সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সবসময় ঘটবে। খারাপ খবর অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আপাতত ভালো চলছে, সত্যিই ভালো, পনেরো বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফল পেলাম। (চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।