Home কলাম যে বাহনে সারা জীবন

যে বাহনে সারা জীবন

রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

ঊনপঞ্চাশ.
দ্বাদশ অধ্যায়
নতুন কিছু উদ্ভাবন না করলে আপনি মারা যাবেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আমি নিশ্চিত আমাদের নিজেস্ব প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করতে হবে। টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন উদ্ভাবন অত্যাবশ্যক – এটি আমার কাছে পুরানো কথা, অনেক আগেই শিখেছি। সুতরাং আমার মনে পরবর্তী প্রশ্নের উদয় হলো: আমরা কি নিজেরাই একটা যুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করব? কেভিন মায়ার আমাকে সতর্ক করেন যে এটি নির্মাণে পাঁচ বছর সময় ব্যায় হবে এবং বিশাল নিয়োগের প্রয়োজন হবে। যদি আমরা একটা প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম ক্রয় করতে পারি তবে তাৎক্ষণিকভাবে কোম্পানি গতিশীল ক্ষমতা অর্জন করবে। যে গতিতে আশপাশের সমস্ত কিছু পরিবর্তন হচ্ছিল তা পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছিল এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা কোন বিকল্প হতে পারে না। যখন আমরা অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে চারপাশে তাকাই তখন দেখি গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজন এবং ফেসবুক বিক্রি হবে না। তাদের কোম্পানির আকার দেখেই অনুমান করা যায়। যতদূর জানি তাদের কেউই আমাদের কিনতে চাই না। (কিন্তু যদি স্টিভ বেঁচে থাকতেন তবে আমি বিশ্বাস করি আমরা আমাদের কোম্পানিকে একত্রিত করতে পারতাম অথবা খুব গুরুত্বের সাথে বিষয়টি আলোচনা করতে পারতাম।)

বাকি ছিল স্ন্যাপচ্যাট, স্পটিফাই এবং টুইটার। আকারের দিক থেকে এরা হজমযোগ্য। কিন্তু কোন কোম্পানিটি সম্ভাব্য বিক্রির জন্য প্রস্তুত এবং কেই বা সবচেয়ে কার্যকরভাবে এবং দ্রæততার সাথে আমাদের পণ্য ভোক্তাদের কাছে মান সম্পন্নভাবে সরবরাহ করতে সক্ষম? তা আমাদের জানা ছিল না। আমরা টুইটারে অবতরণ করলাম। তাদের প্রতি আমাদের আগ্রহ কম ছিল। কারণ তারা একটা নতুন সামাজিক মিডিয়া কোম্পানি। নতুন বিতরণ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে তারা কি পারবে সারা বিশ্বকে নাগালের মধ্যে রেখে আমাদের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, খেলাধুলা এবং সংবাদ সরবরাহ করতে।

২০১৬ সালের গ্রীষ্মে আমরা টুইটার অধিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তারা চক্রান্তের গন্ধ পেল। কিন্তু তারা বলল যে তাদের টুইটারের বাজার মূল্য যাঁচাই করা দরকার। তাই কিছুটা অনিচ্ছা থাকা সত্বেও আমরা নিলামে টুইটার ক্রয়ের জন্য রাজি হলাম। বর্ষার শুরুতে আমরা কার্যত একধরণের চুক্তি সম্পন্ন করলাম। টুইটার বোর্ড বিক্রয়ের পক্ষে সমর্থন দিল এবং অক্টোবর মাসের এক শুক্রবার বিকেলে আমাদের বোর্ড টুইটার ক্রয়ের চুক্তি চূড়ান্ত করার অনুমোদন দিল। তারপর সেই সপ্তাহিক ছুটির দিনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি চুক্তি সম্পাদনে যাচ্ছি না। যদি আগের অধিগ্রহণগুলোর দিকে তাকায়, বিশেষ করে পিক্সার অধিগ্রহণের বিষয়গুলো মনে করি তবে সেটি কোম্পানির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু টুইটার অধিগ্রহণের বিষয়ে আমার মন সাঁই দিচ্ছে না। আমার ভেতর থেকে কে যেন বলছে টুইটার কেনা ঠিক হচ্ছে না। টম মারফি আমাকে বছরের পর বছর বলেছেন, ‘যদি কোন একটা বিষয় আপনার কাছে সঠিক মনে না হয়, তবে তা সম্ভবত আপনার জন্য সঠিক নয়।’ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিভাবে প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম আমাদের নতুন উদ্দেশ্য অর্জনে কাজ করবে কিন্তু টুইটার অধিগ্রহণে ব্র্যান্ড-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো আমাকে বিব্রত করছে।
টুইটার আমাদের জন্য সম্ভাব্য শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হতে পারত কিন্তু টুইটারের সাথে আসা চ্যালেঞ্জগুলো আমি অতিক্রম করতে পারিনি। চ্যালেঞ্জ আর বিতর্কের সংখ্যা এত বেশি যে এগুলোকে তালিকাভূক্ত করা প্রায় অসম্ভব। ঘৃণাত্মক বক্তৃতা বা বিবৃতির বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যাবস্থা নেবেন তারা সেটা উল্লেখ করেছেন। বাক-স্বাধীনতা সম্পর্কে আশংকাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক ‘বার্তা’ সমৃদ্ধ জাল অ্যাকাউন্ট অ্যালগরিদমিকভাবে ছড়িয়ে পড়লে কি করবেন। আবার মানুষের রাগ, ক্ষোভ, অসভ্য আচরণ কখনও কখনও স্পষ্টভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো আমাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এগুলোর যে কোন একটার মুখোমুখি হলে আমার বিশ্বাস ডিজনি ব্র্যান্ড মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বোর্ড মাত্র আমাকে টুইটার অধিগ্রহণে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন পরে রবিবারে আমি সকল সদস্যকে একটা ই-মেইল পাঠালাম, বললাম যে আমি টুইটার অধিগ্রহণের সাহস হারিয়ে ফেলেছি এবং আমার যুক্তি ব্যাখ্যা করে ক্রয় প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করলাম। তারপর আমি টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসিকে ফোন করলাম যিনি ডিজনি বোর্ডেরও সদস্য। জ্যাক হতবাক হলেন কিন্তু আমার সাথে খুব ভদ্র আচরণ করলেন। আমি জ্যাকের মতো ভাগ্য কামনা করি এবং ফোন রেখে দিয়ে স্বস্তি বোধ করলাম।

যখন আমরা টুইটার ক্রয়ের জন্য আলাপ-আলোচনার শুরু করি প্রায় একই সময়ে আমরা আর একটা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিলাম। কোম্পানিটির নাম বিএএম-টেক যারা মূলত মেজর লীগ বেজবলের মালিকানাধীন ছিল। তারা একটি নিখুঁত স্ট্রিমিং প্রযুক্তি চালু করেছিল যেখানে ভক্তরা একটি অনলাইন পরিষেবাতে সদস্য হতে পারত এবং তাদের প্রিয় দলের খেলা সরাসরি দেখতে পারত (এইচবিও তার নিজস্ব স্ট্রিমিং পরিষেবা তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারা তীব্র সময় চাপের মধ্যে থেকে ‘এইচবিও নাউ’ এর নির্মাণ কাজ সময় মতো শেষ করেন যেখানে গেম অফ থ্রোনস-এর সিজন ফাইভ রিলিজ হয়।)

২০১৬ সালের আগস্ট মাসে আমরা তাদের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হলাম কোম্পানিটির ৩৩ শতাংশ শেয়ার কেনার বিনিময়ে। শর্ত হচ্ছে ২০২০ সালে আমরা কোম্পানিটি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবো। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল অন-লাইন সদস্য হবার সুযোগ সৃষ্টি করে ইএসপিএন ব্যবসার হুমকি প্রতিরোধ করা- যা ‘ইএসপিএন’এর প্রোগ্রামিং নেটওয়ার্কের পাশাপাশি চালু থাকবে। কিন্তু প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের বিনোদন সাবস্ক্রিপশন পরিসেবাগুলোতে আরো গভীরভাবে বিনিয়োগ করে। আমাদের জন্য জরুরী সরাসরি ভোক্তা বান্ডিল সৃষ্টি করা শুধু খেলাধুলার স¤প্রচারের জন্য না বরং টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের স¤প্রচারের প্রয়োজন আরও তীব্র হয়েছে।

দশ মাস পরে ২০১৭ সালের জুনে আমরা আমাদের বার্ষিক ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড বোর্ড রিট্রিট অরল্যান্ডোতে আয়োজন করি। বার্ষিক রিট্রিট আমাদের একটা বর্ধিত বোর্ড সভা যেখানে আমরা আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সাথে আর্থিক অনুমানগুলো উপস্থাপন করে থাকি। সুনির্দিষ্ট কৌশলগত সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করি। আমরা ২০১৭ সালের পুরো অধিবেশনে ব্যবসায়িক সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের প্রত্যেক ব্যবসায়ীক নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম বোর্ডের সামনে তারা তাদের সমস্যাগুলোর গতিপ্রকৃতি ও মাত্রা উপস্থাপন করবেন। এ সমস্ত সমস্যা তাদের ব্যাবসার স্বাস্থ্যের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে সে সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী গুলোও আলোচনায় আসবে।

আমি জানতাম বোর্ড সমাধান চাইবে আর আমার একটা সাধারণ নিয়ম আমি সমস্যা সমাধানের একটা পরিকল্পনা প্রস্তাব ছাড়া কোন সমস্যা উন্থাপন করা পছন্দ করি না। (আমি আমার দলকেও তা করতে বলে থাকি — আমার কাছে সমস্যা আসবে ঠিক আছে, কিন্তু সম্ভাব্য সমাধান প্রস্তাবসহ আসতে হবে) তাই পরে আমরা উভয় পক্ষ যে পরিবর্তনগুলি অনুভব করছিলাম তার বিশদ বিবরণ এবং অনুমানগুলো বিশ্লেষণ সাপেক্ষে আমরা বোর্ডের কাছে একটি সাহসী, আক্রমণাত্মক এবং সমন্বিত সামাধানের প্রস্তাব উপস্থাপন করি: বিএএম-টেক-এর নিয়ন্ত্রণকারী শেয়ার কেনা ত্বরান্বিত করতে হবে। ডিজনি এবং ইএসপিএন এর প্রযুক্তি-প্ল্যাটফর্মটি চালু করতে হবে যাতে ভোক্তা কোন মাধ্যম ছাড়াই আমাদের পণ্য ক্রয় করতে পারেন। সবার উপরে আমাদের ভিডিও স্ট্রিমিং পরিষেবা চালু করতে হবে।
বোর্ড আমাদের পরিকল্পনা সমর্থন করেই ক্ষান্ত হলেন না, আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুরোধ করলেন। বললেন, ‘এক্ষেত্রে গতিই অগ্রগামী হবার আসল হাতিয়ার।’ (বোর্ডের সদস্যরা শুধুমাত্র জ্ঞানী এবং নিজেদের মতামতের প্রতি আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন না বরং তাদের বর্তমান বাজারের গতিশীলতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ এবং প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা ছিল। বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন জেনারেল মোটরস এর মেরি বাররা এবং নাইকি থেকে মার্ক পার্কার, দুজনই তাদের প্রতিষ্ঠানকে এ ধরণের গভীর সমস্যায় নিপতিত হওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন। উভয়েই পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপখাইয়ে না নিতে পারার সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন।) বোর্ডের রিট্রিট সভার পরে আমি আমার টিমের সাথে দেখা করলাম। বোর্ডের প্রতিক্রিয়া আমি তাদের সাথে শেয়ার করলাম। কেভিনকে দ্রুত বিএএম-টেক-এর নিয়ন্ত্রণ ক্রয়ের নির্দেশ দিলাম এবং অন্য সকলকে স্ট্রিমিং ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে বললাম।

এখন থেকে ঠিক দুই বছর আগে কোম্পানির দুর্ভাগ্যজনক আয়-ব্যায়ের হিসাব জন সমক্ষে পেশ করার পরে আমরা আমাদের স্টকের মূল্য পতন দেখেছি। কারণ আমি আমাদের ব্যাবসার সমস্যাগুলো নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছিলাম। এখন আগস্ট ২০১৭ সালে এসে আয়-ব্যায়ের বাৎসরিক হিসাব জন সমক্ষে পেশ করার সাথে বিএএম-টেক-এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কেনার জন্য আমাদের চুক্তি ত্বরান্বিত করার ঘোষণা করেছি এবং আমরা আমাদের দুটি স্ট্রিমিং পরিষেবা চালু করার পরিকল্পনা তুলে ধরেছি: একটি ২০১৮ সালে, ইএসপিএন-এর জন্য এবং অন্যটি ২০১৯ সালে ডিজনির জন্য। এই ঘোষণার পর আমাদের স্টকের দাম বেড়েছে। বিনিয়োগকারীদের আমাদের কৌশল বুঝাতে পেরেছি এবং উভয় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছি। কোম্পানির আয় বৃদ্ধির সুযোগ এখনও বিদ্যমান তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন। (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version