Home কলাম যে বাহনে সারা জীবন

যে বাহনে সারা জীবন

রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

আটচল্লিশ.
একাদশ অধ্যায়
স্টার ওয়ারস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) সদ্য নির্মিত স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রটি ‘দ্য ফোর্স এ্যওয়েকেন’ বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাবার ঠিক আগে ক্যাথি জর্জকে দেখালেন। তিনি তার হতাশা গোপন করেননি। তিনি বললেন ‘নতুন কিছু নেই।’ প্রতিটি স্টার ওয়ার্স ছবিতে মূল চলচ্চিত্রের অনুরূপ ত্রিমাত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। নতুন বিশ্ব, নতুন গল্প, নতুন চরিত্র এবং নতুন উপস্থাপনা কৌশল ও প্রযুক্তির ব্যাবহার নিশ্চিৎ করতে পারলে তিনি বেশি খুশি হতেন। তিনি বললেন, ‘ভিজ্যুয়াল বা প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত ছিল না।’ তিনি ভুল বলেননি। কিন্তু আমরা যে কি চাপের মধ্যে ছিলাম তিনি তা উপলব্ধি করতে পারেননি। অতিউৎসাহী অনুরাগীদের একটা নিখুঁত স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্র উপহার দেওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং তার কোন কিছুই মূল্যায়ণ করলেন না। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি যাতে দৃশ্যত এবং কার্যত পূর্ববর্তী স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রের সাথে সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়। দর্শকবৃন্দ যেমনটি পছন্দ করেছিলেন এবং আশা করছিলেন তা থেকে যাতে খুব বেশি দূরে সরে না যায়। কিন্তু জর্জ আমাদের এ প্রচেষ্টার সমালোচনা করলেন। কয়েক বছরের আগে ফিরে তাকালে, কয়েকটি স্টার ওয়ার চলচ্চিত্র পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আমি বিশ্বাস করি জে.জে. অসাধ্য সাধন করেছেন। তার অর্জনসমূহ প্রায় অসম্ভব ছিল। আগের স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রগুলোর সাথে একটি নিখুঁত সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।

জর্জের এমন সব প্রতিক্রিয়া ছাড়াও সংবাদ পাড়ায় এবং স্টার ওয়ার্সের কট্টর ভক্তদের মাঝে আমরা স্টার ওয়ার্সকে কিভাবে ডিজনিতে আত্মিকরণ করছি সে সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা চালু ছিল। মার্ভেলের মতো আমি স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রের কৃতিত্বের জন্য কোথাও ডিজনির নাম ব্যাবহার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এমনকি বিপণন প্রচারাভিযানেও ‘ডিজনি’ ব্যাবহার করা যাবে না। কোন ভাবেই স্টার ওয়ার্সের লোগো পরিবর্তন করা যাবে না। অ্যানিমেশন-ব্র্যান্ডিং দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ডিজনি-পিক্সার’ মানানসইভাবে অর্থবোধক। কিন্তু লুকাস ভক্তদের আশ্বস্ত করতে হবে আমরা প্রথমে স্টার ওয়ার্সের ভক্ত, স্টার ওয়ার্সের স্রষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তার উত্তরাধিকার স¤প্রসারিত করতে চাই। স্টার ওয়ার্স দখল করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

যদিও ছবিটি নিয়ে তার সমস্যা ছিল, আমি ভেবেছিলাম ‘ফোর্স অ্যাওয়েকেন্সের’ প্রথম শোয়ে জর্জের উপস্থিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রথমে আসতে চাননি। কিন্তু ক্যাথি জর্জের বর্তমান স্ত্রী মেলোডি হবসনের সহযোগিতায় তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রথম শোয়ে তার উপস্থিতি সঠিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার আগে আমরা যে শেষ জিনিসগুলি আলোচনা করেছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল তিনি কোম্পানী বা এর পণ্য, পরিষেবা বা নেতাদের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা বলবেন না। আমি জর্জকে সম্মত করেছিলাম যে তিনি আমাদের নির্মিত স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রগুলির প্রকাশ্যে কোন সমালোচনা করবেন না। যখন আমি তার সামনে এই বিষয়টি উপস্থাপন করলাম তখন তিনি বললেন ‘আমি ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির একজন বড় শেয়ারহোল্ডার হতে যাচ্ছি। আমি কেন আপনাকে বা আপনি যা কিছু করেন সে সমস্তকিছুকে অসম্মান করব? আপনার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।’ আমি তার অঙ্গিকারে তাকে ফিরিয়ে আনলাম।

এখন প্রশ্ন হল কীভাবে প্রথম শো পরিচালনা করা হবে। আমি বিশ্বকে জানাতে চাই চলচ্চিত্রটি জে. জে. আব্রামসের সিনেমা এবং ক্যাথি কেনেডির সিনেমা এবং এটি আমাদের প্রথম স্টার ওয়ার সিনেমা। আমি সিইও হওয়ার পর থেকে এটি অবশ্যই সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র যা আমরা অবমুক্ত করতে যাচ্ছি। আমরা ডলবি থিয়েটারে একটি বিশাল প্রিমিয়ার শোয়ের আয়োজন করলাম। এখানে একাডেমি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হয়। মঞ্চে প্রথমে আমি উঠলাম। জে.জে. এবং ক্যাথিকে মঞ্চে ডাকার আগে আমি বললাম, ‘আমরা সবাই এখানে একজন ব্যক্তির কারণে এসেছি, যিনি আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টি করেছেন এবং পরে তিনি এই দ্বায়িত্ব ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির কাছে অর্পণ করেছেন।’ জর্জ তার আসনে ছিলেন। তখন সমাবেত কয়েক হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে দীর্ঘ স্বতঃস্ফুর্ত কড়তালি দিয়ে বিপুল সংবর্ধনা জানালেন। উইলো তার পিছনের সারিতে বসে তার একটি দুর্দান্ত ছবি তুলেছিল। ছবিটিতে তিনি কয়েক হাজার লোক দ্বারা বেষ্টিত ছিলেন, সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। পরে আমি এটি দেখে খুশি হয়েছিলাম। ছবিতে দেখতে পেয়েছি জর্জ তার উপর প্রশংসার বর্ষণে কতটা সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞ ছিলেন।

সাংহায়ে ডিজনি ওয়ার্ল্ডের আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোন অনুষ্ঠানে। আমার সাথে আছেন ওয়াং ইয়েং, চায়না কমুনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ও স্টেট কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরও আছেন হ্যান ঝেং, চায়না কমুনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ও সাংহায়ের পার্টি সেক্রেটারি

চলচ্চিত্রটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো এবং বক্স-অফিস আয়ে বেশ কয়েকটি মাইল ফলক অতিক্রম করল। আমরা সবাই দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম। আমাদের প্রথম স্টার ওয়ার ছাঁয়াছবি সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক পশ্চাদপদ ছিল। স্টার ওয়ার্স ভক্তরা এটি পছন্দ করেছেন বলে মনে হচ্ছে। যদিও একটা সাক্ষাৎকারে জর্জ কয়েক সপ্তাহ আগে চার্লি রোজকে তার হতাশার কথা বলেছিলেন। ছবিটি মুক্তি পাবার অল্পকিছু দিন পর সাক্ষাৎকারটি টিভিতে স¤প্রচার হল। তিনি অভিযোগের সুরে বললেন আমরা তার রূপরেখা অনুসরণ করিনি এবং তিন আরও বললেন যে ডিজনির কাছে স্টার ওয়ার্স বিক্রি করার অর্থ হচ্ছে নিজের সন্তানদের ক্রিতদাসে পরিণত করা। একটা দুর্ভাগ্যজনক এবং খুব বিশ্রী উপায়ে তিনি কোন কিছু বিক্রি করার অনুভূতি বর্ণনা করেছেন। তিনি স্টার ওয়ার্সকে নিজের সন্তানের সাথে তুলনা করেছিলেন। আমি চুপ থেকে সময় অতিবাহীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জন সম্মূখে তর্কে জড়িত হওয়া বা বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন অর্জন নেই। মেলোডি ক্ষমা প্রার্থনা করে আমাকে একটি ই-মেইল পাঠালেন। এতসব জর্জের পক্ষে ব্যাখ্যা করা অনেক কঠিন কাজ। তারপর জর্জ আমার সাথে ফোনে কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘আমি লাইনের বাইরে যেয়ে কথা বলেছিলাম। এমনটি বলা আমার উচিত হয়নি। আমি বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম স্টার ওয়ার্সের মলিকনা হস্তান্তর আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল।’

আমি তাকে বললাম আমি বুঝতে পেরেছি। সাড়ে চার বছর আগে আমি এক প্রাতঃরাশে জর্জের সাথে বসেছিলাম এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে আমি জানি লুকাসফিল্ম বিক্রি করা তার জন্য কতটা কঠিন। কিন্তু যখন তিনি বিক্রির জন্য প্রস্তুত হবেন তখন তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। অধিগ্রহণ আলাপ-আলোচনা চলে মূলত দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে – এক. বিক্রয় মূল্য এবং দুই. স্টার ওয়ারে জর্জের চলমান সম্পৃক্ততা কি হবে। জর্জের কৃতিত্বের জন্য তার প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা তার ভারসাম্য রক্ষার অনুশীলন চালিয়ে গেছি। অত্যন্ত গভীরভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি জানতাম স্টার ওয়ার্স তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি কোম্পানিটির দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র। আমি জর্জের উপর যথেষ্ট মাত্রায় সহানুভূতিশীল ছিলাম কিন্তু তিনি যা চেয়েছিলেন তা তাকে দিতে পারিনি। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে আমাকে নিশ্চিৎ হতে হয়েছে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। পুরো প্রক্রিয়াব্যাপী আমাকে তার আবেগপূর্ণ মুহূর্তগুলোর প্রতি সংবেদনশীল থাকতে হয়েছে ।
পিক্সার, মার্ভেল এবং লুকাসফিল্মের অধিগ্রহণের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় তাদের সকলের মধ্যে একই যোগসূত্র বিদ্যমান (তারা ডিজনিকে সমৃদ্ধ করেছে) প্রতিটি চুক্তি একটি একক নিয়ন্ত্রণকারী সত্তার প্রতি আস্থা গড়ে তোলার উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রত্যেকটি চুক্তির মধ্যে জটিল সমস্যা ছিল। আমাদের নিজ নিজ দল দীর্ঘ দিন এবং দীর্ঘ সপ্তাহ এগুলোর মিমাংশায় পৌছানোর জন্য শ্রম দিয়েছেন। অধিগ্রহণ চুক্তি গুলো প্রতিটি ব্যক্তিগত উপাদানকে হয় ভেঙ্গে ফেলেছে না হয় নতুন করে সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে খাঁটি মন মানসিকতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পিক্সারের সত্বার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল থাকবো আমার দেয়া এই প্রতিশ্রæতি স্টিভকে বিশ্বাস করতে হয়েছিল। আইককে বিশ্বাস করতে হয়েছে মার্ভেল টিম মহামূল্যবান হয়ে উঠবে এবং তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানে বিকশিত হবার সুযোগ দিতে হবে। জর্জকেও বিশ্বাস করতে হয়েছে যে তার উত্তরাধিকার, তার ‘সন্তান’ ডিজনিতে ভাল থাকবে।

দ্বাদশ অধ্যায়
নতুন কিছু উদ্ভাবন না করলে আপনি মারা যাবেন
তিনটি বিশাল কোম্পানি অধিগ্রহণের পর যে ধুলো আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দুষিত করেছিল সেটি থিতিয়ে যাবার জন্য কিছু সময় অতিবাহিত হল। তারপর আমরা আমাদের মিডিয়া ব্যবসায় নাটকীয় পরিবর্তনের উপর আরও জোড় দিলাম। প্রতিষ্ঠানে গভীর ফাটলের আশংকা আমরা অনুভব করছিলাম। মিডিয়া ব্যাবসার হতাশাপূর্ণ ভবিষ্যৎ আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলল। অবশেষে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম নতুন এবং আধুনিক উপায়ে আমরা আমাদের সামগ্রী সরবরাহ করবো। আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম যাতে কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি ভোক্তার কাছে আমাদের পণ্য পৌছে দেয়া যায়।

আমাদের জন্য প্রশ্ন ছিল: আমরা কি এমন একটি প্রযুক্তি খুঁজে পাবো যেটি কাজে লাগিয়ে পরিবর্তনের অগ্রভাগে আমরা আমাদের অবস্থান করে নিতে পারবো? নাকি প্রযুক্তিটি আমাদের আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? আমাদের কি তেমন শক্তিশালী পাকস্থলী আছে যার দ্বারা নিজেদের বর্তমান লাভজনক ব্যাবসাগুলো হজম করে একটা নতুন ব্যাবসায়িক মডেলের জন্ম দিতে পারবো? কোম্পানির আধুনিকীকরণ এবং রূপান্তরের স্বার্থে আমরা কি নিজেদেরকে সাময়িক ক্ষতির মুখোমুখী করতে পারবো এবং ওয়াল স্ট্রিট (বিনিয়োগ কারীরা) কি সাময়িক ক্ষতি মেনে নেবে? (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version