Home কলাম যে বাহনে সারা জীবন

যে বাহনে সারা জীবন

রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবত কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহত মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

সাতচল্লিশ.
একাদশ অধ্যায়
স্টার ওয়ারস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) চুক্তিটি ২০১২ এর শেষে সম্পন্ন হল আর তখনই ক্যাথি, অ্যালান এবং আমি একটা সৃজনশীল দল গঠনের জন্য অনুসন্ধান শুরু করলাম। জে জে আব্রামস আমাদের প্রথম স্টার ওয়ার সিনেমা পরিচালনা করার জন্য রাজি হলেন। আমরা অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। আমরা মাইকেল আর্নটকে নিয়োগ দিলাম, যিনি টয় স্টোরি-৩ এবং লিটল মিস সানশাইনকে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। আমাদের প্রথম স্টার ওয়ার সিনেমা পরিচালনা করার দ্বায়িত্ব নেয়ার পর জে.জে. এবং আমি একটা ডিনারে মিলিত হলাম। আমরা একে অপরকে আগে থেকেই চিনতাম। তিনি আমাদের জন্য ‘অ্যালিয়াস’ আর ‘লস্ট’ নির্মাণ করেছিলেন। সে সময় তিনি আরও অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার সাথে বসা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করা একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়া এই ডিনারে একসাথে মিলিত হবার কারণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বর্তমান স্টার ওয়ার সিনেমা নির্মাণের মতো ইতিপূর্বে আমরা কখনও এত বড় কাজ একসাথে করিনি। রাতের খাবারের সময় আমি মস্করা করে বললাম ‘এটি একটি ৪ বিলিয়ন ডলারের চলচ্চিত্র’— যার মানে পুরো অধিগ্রহণ তার সাফল্যের উপর নির্ভর করে – পরে জে. জে. আমাকে বলেছিলেন এটি মোটেও হাসি তামাশার বিষয় নয়।

প্রথম স্টার ওয়ার চলচ্চিত্র যেটি জর্জ লুকাস নির্মাণ করছেন না। ছবিটি পরিচালনা করছেন জে. জে. আব্রামস। ছবিটি নর্মাণে আমিও জে. জে. আব্রামসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছি। এ জন্য তিনি আমার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। একটা ছবি নির্মানের প্রাথমিক পর্যায়ের আলাপ আলোচনায় আমি সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলাম – যেমন একটা পৌরাণিক কাহিনীর প্রকাশ ভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত। কিভাবে শুরু করা প্রয়োজন। চিত্র ধারণ মঞ্চ থেকে এডিটিং রুম পর্যন্ত আমার অবাধ অংশগ্রহণ ছিল। আমি জে. জে. আব্রামসকে বোঝাতে চেয়েছি আমি প্রকল্পের একজন অংশীদার। আমি শুধুমাত্র একজন সিইও হিসাবে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমি এত ব্যাপক অংশগ্রহণ করিনি বরং আমি চেয়েছি দারুণ একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এবং বড় একটা বক্স অফিস সাফল্য অর্জন করতে। আমাদের দুজনের উপরই মাত্রাতিরিক্ত চাপ কাজ করছিল। আমি তাকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম তিনি যে কোনো মুহূর্তে আমাকে আলোচনার জন্য ফোনে কথা বলতে পারেন। যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য যৌথভাবে কুস্তি লড়তে প্রস্তুত এবং আমার মাথায় কোন সৃজনশীল ধারণা আসলে আমি তার সাথে ফোনে কথা বলবো, এ বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। আমি তার জন্য একদিকে যেমন সম্পদ ছিলাম তেমনি একজন একনিষ্ঠ সহযোগী। কিন্তু আমি এমন কেউ ছিলাম না যে তার ছবিতে আমার নাম যেতে হবে বা আমার পক্ষ থেকে অন্য কোন বাধ্যবাধকতাও ছিল না। ভাগ্যক্রমে আমরা দুজনই অনুরূপভাবে সংবেদনশীল ছিলাম এবং অভিন্ন রূচি ও স্বাদের মানুষ ছিলাম। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একমত ছিলাম কোনটি সমস্যাপূর্ণ আর কোনটি যুত্সইভাবে কাজ করছে। দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াই জে.জে. নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি একজন মহান সহযোগী এবং প্রকল্পের বিশালতায় তিনি কখনও খেই হারিয়ে ফেলেননি।
ক্লান্তিহীনভাবে লস অ্যাঞ্জেলেস, লন্ডনের পাইনউড স্টুডিও, আইসল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আবুধাবিতে প্রকল্পের বিষ্ময়কর বোঝা বহন করে চলেছেন। জর্জের সাথে, স্টার ওয়ার্স ভক্তদের সাথে, প্রেসের সাথে এবং আমাদের বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রকল্পের গুরত্ব তুলে ধরতে কখনও কোন বিচ্যুতি চোখে পড়েনি।

এমন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকবেলার জন্য কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু সাধারণভাবে আপনাকে মনে রাখতে হবে যখন একটি প্রকল্পের গুরুত্ব খুব বেশি হয় তখন প্রকল্পে কাজ করা মানুষদের উপর অতিরিক্ত চাপ দিয়ে খুব বেশি কিছু অর্জন করা যায় না। আপনার উদ্বেগ আপনার টিমের সামনে উপস্থাপন করা হিতে বিপরীত হতে পারে। সূ² একটা কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। এটির প্রয়োগে অনেক সময় গোলমাল হয়ে যেতে পারে। কর্মীদের বোঝাতে হবে আপনি তাদের কাজের চাপ খানিকটা নিজেও ভাগ করে নেন। আপনাকে তাদের বোঝাতে সক্ষম হতে হবে যে আপনি তাদের চাপ নিরসনে তাদের সাথেই আছেন। তাদের মতো আপনিও মানুষিক চাপে রয়েছেন। তাদের আরও বোঝাতে সক্ষম হতে হবে চাপ নিরসন করে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে ডেলিভারি করার জন্য তাদের সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। এই প্রকল্পের কাউকে মনে করিয়ে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই যে প্রকল্পটি ঝুঁকির মধ্যে আছে। আমরা যখন কোন সৃজনশীল এবং বাস্তব বাধার সম্মূখিন হোতাম আমার প্রধান দ্বায়িত্ব ছিল সকলকে আমাদের উচ্চাকাঙ্খার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং একটা সর্ব্বোত্তম উপায়ে সর্ব্বোত্তম সমাধান পেতে সাহায্য করা। অর্থাত কখনও কখনও আরও বাজেট বরাদ্দ করাকে নির্দেশ করে। কখনও কখনও স্ক্রিপ্টের নতুন খসড়ার প্রয়োজন হয়। অথবা অবিরাম দৈনিক সংবাদপত্র পাঠকে নির্দেশ করে। অথবা ফিল্মের অসংখ্য কাটাকাটি রাতদিন পর্যবেক্ষণ করা। অথবা নিরন্তর স্মরণ করা জে.জে. এবং ক্যাথি কেনেডি এবং অ্যালান হর্নের চেয়ে ভাল আর কোন চলচ্চিত্রকার নেই যিনি আমাদের সহযোগিতা করতে পারেন। আমি এই তিন জনকে ভীষণভাবে বিশ্বাস করতাম।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে শুরু থেকেই চলচিত্রটি নির্মাণের কাজ মসৃণ ছিল। ক্যাথি চলচিত্রটি নির্মাণের শুরুর দিকে জে.জে. এবং মাইকেল আর্ন্টকে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় জর্জের সাথে তার খামারে দেখা করতে নিয়ে গেলেন এবং চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে তাদের ধারণা ব্যাক্ত করলেন। যখন তারা সিনেমার প্লট বর্ণনা করতে শুরু করলেন সাথে সাথে জর্জ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কারণ আমরা তার জমা দেওয়া গল্পগুলির একটিও ব্যবহার করছি না।

কথা সত্য। ক্যাথি, জে.জে. অ্যালান এবং আমি আলোচনা করে ঠিক করেছি গল্পটি কোন দিকে গড়াবে। আমরা সবাই একমত ছিলাম জর্জের রূপরেখা অনুসারে এবার ছবি হচ্ছে না। জর্জ নিজেও জানতেন চুক্তিগতভাবে আমরা তার কাছে কোন কিছুর জন্য দ্বায়বদ্ধ ছিলাম না। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন যে আমারা যেহেতু তার গল্পের রূপরেখা কিনেছি তাই আমরা তার রূপরেখা অবলম্বনে ছবি নির্মাণ করবো। তিনি ধরে নিয়েছিলেন এটি একটা মৌন প্রতিশ্রুতি। তিনি হতাশ হলেন যখন তিনি দেখলেন তার গল্প বাতিল করা হয়েছে। আমি প্রথম কথোপকথন থেকেই বেশ সতর্ক ছিলাম তিনি যেন কোনোভাবেই বিভ্রান্ত না হন। আমি মনে করি না যে এ ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট মাত্রায় শতর্ক ছিলাম। তবে আমি এটি আরও ভালভাবে পরিচালনা করতে পারতাম। আমার উচিত ছিল জে. জে. আব্রামস আর মাইকেলকে জর্জের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত করা। সেটি কোন কারণে হয়ে উঠেনি। জর্জকে আমাদের কথোপকথন সম্পর্কে তাদের সাক্ষাতের আগেই কথা বলে নিলে ভালো হোত। ক্যাথি, জে.জে. অ্যালান এবং আমি অনুভব করেছি আসন্ন স্টার ওয়ার চলচ্চিত্রটি অন্য প্রেক্ষিতে নির্মাণ করাই ভাল। তার সাথে এ ভাবে আগেই কথা বলে নিলে সম্ভবত তার রাগ এড়াতে পারতাম। তিনি অবাকও হতেন না। স্টার ওয়ারসের ভবিষ্যত সম্পর্কে আলোচনা করতে যেয়ে তার সাথে দেখা হলো। জর্জ অনুভব করেছিলেন আমরা তার প্রতি অনুগত না। তিনি কখনও পুরো প্রক্রিয়াটি সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন না। অহেতুক একটা পাথুরে সম্পর্কের শুরু হল।

চলচ্চিত্র সম্পর্কে জর্জের অনুভূতির বাইরে কতকগুলো উদ্বেগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কোন ফলাফল ছাড়াই মাইকেল চিত্রনাট্য লিখতে মাস ব্যাপী তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে জে.জে. এবং ক্যাথি সিদ্ধান্ত নিয়ে মাইকেলের জায়গায় ল্যারি কাসদানকে নিয়োগ দিলেন। ল্যারি জর্জের সাথে যৌথভাবে লিখেছিলেন ‘দ্য এম্পায়ার স্ট্রাইকস ব্যাক’ এবং ‘রিটার্ন অফ দ্য জেডি’ (এ ছাড়াও ‘রাইডার্স অফ দ্য লস্ট আর্ক’ এবং ‘দ্য বিগ চিল’ এবং আরও অনেক) । ল্যারি এবং জে.জে. মোটামুটি দ্রুতার সাথে একটি খসড়া চিত্রনাট্য লিখে ফেললেন এবং আমরা ২০১৪ সালের বসন্তে শুটিং শুরু করলাম।

শুরুতে আমরা ২০১৫ সালের মে মাসে ছবিটি মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম কিন্তু স্ক্রিপ্ট তৈরিতে বিলম্ব ঘটল এবং আরও বেশকিছু কারণে পরবর্তীতে অন্যান্য জটিলতা দেখা দেওয়াই শেষ পর্যন্ত আমরা ডিসেম্বরেও ছবিটি মুক্তি দিতে পারলাম না। ২০১৫ অর্থবছরে পার করে ২০১৬ অর্থবছরে ছবিটি মুক্তি পেল । লুকাসফিল্ম অধিগ্রহণের আগে আমি বোর্ডে যে উপস্থাপনা করেছিলাম এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল ২০১৫ সালেই আমরা আমাদের বিনিয়োগ থেকে আয়ের মূখ দেখতে পাবো, তা আর হয়ে উঠল না। এক অর্থবছরের শত শত মিলিয়ন ডলারের খরচ পরবর্তী অর্থবছরে স্থানান্তর হয়ে গেল। এটি বিশাল কোন বিষয় না, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে।

ফিল্ম স্টুডিওগুলোর সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তারা ছবি রিলিজ হবার একটা নির্দিষ্ট তারিখ আগেভাগে ঠিক করে ফেলে এবং পরে সৃজনশীল সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করে। প্রায়শই মুভি পাড়ায় তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। নিজেরা প্রস্তুত না অথচ নির্দিষ্ট তারিখে ছবির নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ছবি মুক্তি পাবার দিনক্ষণ আগে থেকে নির্ধারণ না করতে, যাতে সৃজনশীল বিভাগ চাপে না পড়ে। ছবি মুক্তি পাবার তারিখ আগে থেকে চিন্তা না করে বরং ভাল সিনেমা নির্মাণে মনোনিবেশ করাই উত্তম। আমরা সবসময় অন্য সবকিছুর আগে ছবির গুণগতমান বজায় রাখার চেষ্টা করি। এমনকি যদি তা স্বল্পমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবুও। এই ক্ষেত্রে আমরা যে কৌশল অবলম্বন করেছিলাম সেটা হচ্ছে চলচ্চিত্রটি যদি স্টার ওয়ার ভক্তদের প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারে তবে অযথা সময়-অর্থ-সম্পদ খরচ বন্ধ করা জরুরী । স্টার ওয়ার্স ভক্তরা আবেগ প্রবণ। তাদের এমন কিছু দিতে হবে যেন তারা সেটা পছন্দ করে। তারা যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে তা গ্রহণ করে। যদি আমরা আমাদের প্রথম স্টার ওয়ার চলচ্চিত্র সঠিকভাবে নির্মাণ করতে না পারি তবে আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব। আর হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া কঠিন। (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version