রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
ছেচল্লিশ.
একাদশ অধ্যায়
স্টার ওয়ারস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) সাধারণত আমরা একটা নির্দিষ্ট সম্পদ ক্রয়ের জন্য যে মূল্য পরিশোধ করি আর সম্পদটির প্রকৃত মূল্য আমরা যা বিশ্বাস করি তার খুব একটা তারতম্য হয় না। কোন কিছু কেনার জন্য আমরা সব সময় কম মূল্য দিয় শুরু করি। সম্পদটির যে মূল্য ক্রেতা বললেন তার চেয়ে অনেক কম মূল্যে সম্পদটি ক্রয়ের আশা করেন। এই প্রক্রিয়াই আপনি বিক্রেতাকে বিপদে ঠেলে দেন। আমি জর্জকে বললাম, ‘ক্রয়ের বিষয়টি যখন সামনে আসে তখন আমি সবকিছু একসাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলি না।’ আমি বিশ্বাস করি আমরা এমন একটি সংখ্যায় দ্রুত পৌঁছাবো যেটি তার কোম্পানির প্রকৃত মূল্য হবে- এবং আমি আরও বিশ্বাস করি ডিজনি বোর্ড, শেয়ারহোল্ডারবৃন্দ এবং ওয়াল স্ট্রিট সকল পক্ষকে আমাদের নির্ধারিত মূল্যে রাজি করাতে সক্ষম হবো। নির্ধারিত মূল্যের সংখ্যাটি যাই হোক না কেন, কিচ্ছু যায় আসে না। আমি বললাম, ‘আমি একটা সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে আপনার সাথে দামদর করতে চাই না। স্টিভের সাথে পিক্সার ক্রয়ের সময় আমি যেভাবে কাজ করেছি আমি একই ভাবে আপনার সাথেও কাজ করতে যাচ্ছি।’
জর্জ আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের ব্যাবস্থা করলেন। কিন্তু প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত মূল্য নির্ধারণের জন্য বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত পেতে নিজেদেরকে সংগ্রাম করতে দেখলাম। দ্রæত ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করার উদ্বেগগুলোর বিপরীতে নিজস্ব ক্ষমতার মূল্যায়ন করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। আমরা একটা দীর্ঘমেয়াদী সৃজনশীল দর্শন কিছুতেই নির্মাণ করতে পারছিলাম না কারণ আমাদের আওতায় উপযুক্ত কোন সৃজনশীল মানুষ ছিলেন না যাকে এই গুরু দ্বায়িত্ব দেয়া যায়। আমরা হাতের নাগালে কাউকেই পাচ্ছিলাম না ফলে আমাদের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বিশাল সৃজনশীল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। এটি আমাদের নির্ধারিত পরিকল্পনার জন্য বিশাল আঘাত। এটির উপর ভিত্তি করে আমাদের আর্থিক বিশ্লেষণ নির্মাণ করতে হবে— ভয়ঙ্কর একটা সমস্যা এবং লুকাসফিল্মের মূল্য নিরূপন প্রায় অসম্ভব একটা কাজ হয়ে দাঁড়াল।
আমি অবশেষে জর্জকে ফোন করে বললাম আমরা মূল্য সীমাকে সংকুচিত করে এনেছি এবং একটা নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করতে আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। লুকাসফিল্মের মূল্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার হবে। জর্জের প্রত্যাশিত পিক্সার মূল্যের থেকে অনেক কম। কিন্তু পিক্সারের চেয়ে সামন্য কমও তিনি গ্রহণ করতে রাজি হবেন না। আমি কেভিন এবং তার দলের সাথে দেখা করলাম এবং আমরা আবার আমাদের মূল্য নির্ধারণী বিশ্লেষণটি খুঁতিয়ে দেখলাম। আমরা বক্স অফিসের আয়ের অনুমানগুলো মিথ্যাভাবে বৃদ্ধি করতে চাইনি। আমি জর্জকে যে সর্ব্বোচ্চ মূল্য বলেছিলাম সেখানে কিছু মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ ছিল কিন্তু এটি চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং মানুষের কর্মক্ষমতার উপর অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি করবে। আমরা কি ছয় বছরে তিনটি চলচ্চিত্র বানাতে পারবো? এগুলি সবই স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্র, এগুলি নির্মাণে আমদের খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত কেভিন এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে লুকাসফিল্মের জন্য ৪.০৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারবো যা মার্ভেলের ক্রয়মূল্যের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। জর্জ অবিলম্বে ৪.০৫ বিলিয়ন ডলারে সম্মত হয়ে গেলেন।
জর্জের সৃজনশীল সম্পৃক্ততা কি হবে তা নিয়ে শুরু হলো আরো কঠিন আলাপ-আলোচনা। পিক্সারের ক্ষেত্রে পুরো অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাপী পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল জন এবং এ্যাড শুধুমাত্র পিক্সারের সাথে নয়, ডিজনি অ্যানিমেশনের সাথে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করবেন। জন প্রধান সৃজনশীল কর্মকর্তা হয়ে ওঠেছেন কিন্তু তিনি এখনও আমাকে রিপোর্ট করেন। মার্ভেলের কেভিন ফেইজ এবং তাদের দলের বাকি অংশের সাথে দেখা করেছি এবং আমি জানি তারা বর্তমানে কোন কাজে ব্যাস্ত। তবে শুরুতে আমরা মার্ভেল চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত নির্ধারণ করার জন্য ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছি। লুকাসফিল্মে শুধুমাত্র একজন ছিলেন যিনি সৃজনশীল কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন – তিনি জর্জ। একজন কর্মচারী না হয়েও তিনি ধরে রাখতে চান এই সৃজনশীল কাজগুলোর নিয়ন্ত্রণ। ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরও আমাকে বলতে হবে লুকাসফিল্ম এখনও আপনার। এগিয়ে যান, আপনি যে সিনেমা নির্মাণ করতে চান তা করুন। সিনেমা নির্মাণ করতে আপনার খেয়াল খুশি মতো সময় নিন কোন সমস্যা নেই। এমনটি বলা আমার জন্য দায়িত্বে অবহেলার সামিল।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/04/Bk-5-1.jpg?resize=946%2C631&ssl=1)
ফিল্ম ব্যবসায়ে খুব কম লোকই পাওয়া যায় যিনি জর্জের মতো সম্মান পেয়েছিলেন। স্টার ওয়ার্স শুধুমাত্র তার ছিল। তিনি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কতটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি কোম্পানিটি বিক্রি করছেন। কোম্পানি বিক্রি করার পর তিনি কে ছিলেন এটি একটা পুরাণ। তিনি কিভাবে সৃজনশীল বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করবেন। তার সম্পূর্ণ স্বত্বা বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ পৌরাণিক কাহিনীর নায়ক ছিলেন। এ বিষয়টির প্রতি আমি গভীরভাবে সংবেদনশীল ছিলাম। শেষে আমি তাকে অপমান করতে চেয়েছিলাম।
আমি আরও জানতাম যে আমরা এই অর্থ ব্যয় করার পরও জর্জ যা চান তা করতে দিতে পারি না। এটি পুরো অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। যে কথা সেই কাজ। আমরা দ্রæত একটি মূল্যে অধিগ্রহণ করতে সম্মত হলাম, কিন্তু তার ভূমিকা কি হবে সে বিষয়ে কয়েক মাস ব্যাপী আলাপ-আলোচনা চলতে থাকল। চলমান স্টার ওয়ার্স কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে যাওয়া তার পক্ষে কঠিন। আমাদের কাছে লুকাসফিল্মের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটি ক্রয় করার কোন মানে নেই। আমরা বারবার জর্জের কাছে গেছিলাম বিষয়টি সামাধানের জন্য – জর্জ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি শুধুমাত্র উত্তরাধিকার হস্তান্তর করবেন, লিয়ন্ত্রণ ছাড়বেন না। আমি বলেছি আমরা এভাবে এটি কিনতে পারবো না। পরে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ করা হল। (আমরা ক্রয়ের জন্য প্রথমে দৌড়ঝাপ শুরু করি আর পরবর্তীতে জর্জ বিক্রি করার জন্য দৌড়ঝাপ করলেন ।)
প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে জর্জ আমাকে বললেন যে তিনি তিনটি নতুন সিনেমার রূপরেখা প্রস্তুত করেছেন। তিনি আমাদের রূপরেখা তিনটির কপি পাঠাতে সম্মত হলেন। রূপরেখাগুলোর এক কপি আমার কাছে, এক কপি অ্যালান ব্রেভারম্যান এবং এক কপি অ্যালান হর্নের কাছে পাঠালেন। কিছু দিন আগে অ্যালান হর্নকে আমাদের স্টুডিও পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অ্যালান হর্ন এবং আমি জর্জের পাঠানো রূপরেখাগুলো পড়লাম এবং আমরা সেগুলো ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্রয় চুক্তিতে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে যে আমরা চুক্তিবদ্ধভাবে সিনেমার রূপরেখা হুবহু মেনে চলতে বাধ্য।
মূলধন লাভ আইনে একটি পরিবর্তন আসন্ন ছিল যা অবশেষে আমাদের অধিগ্রহণ চুক্তিকে উদ্ধার করে। যদি আমরা ২০১২ সালের শেষ নাগাদ লুকাসফিল্ম না কিনতাম তবে জর্জ, লুকাসফিল্মের মালিকের ৫০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতো। আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্রæত সম্মত হওয়া তার জন্য জরুরি হয়ে পড়ল। তিনি জানতেন যে আমি সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দৃঢ?ভাবে দাঁড়াতে প্রস্তুত। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সহজ ছিল না। অগত্যা তিনি আমাদের অনুরোধে সাড়া দিতে রাজি হলেন। আমাদের সাথে পরামর্শ করার বিষয়টি উপলব্ধি করলেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম যে আমরা তার সৃজনশীল ধারণাগুলির জন্য উন্মুক্ত থাকব (এটি কঠিন প্রতিশ্রুতি ছিল না; অবশ্যই আমরা জর্জ লুকাসের ধারণার জন্য উন্মুক্ত থাকব)। কিন্তু সিনেমার রূপরেখার বিষয়ে আমরা কোন বাধ্যবাধকতা মেনে নেব না।
অক্টোবর ৩০, ২০১২ জর্জ আমার অফিসে আসলেন এবং আমরা ডেস্কে বসে ডিজনির পক্ষে লুকাসফিল্ম কেনার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলাম। তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনে আর চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে বাকী থাকল না তিনি কতটা আবেগঘন হয়ে পড়েছেন। অবশেষে তিনি চুক্তিপত্রে সই করলেন এবং স্টার ওয়ার্স থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন।
অধিগ্রহণ চুক্তিটি সম্পন্ন হবার কয়েক মাস আগে জর্জ লুকাসফিল্ম পরিচালনার জন্য প্রযোজক ক্যাথি কেনেডিকে নিয়োগ দিলেন। ক্যাথি আর তার স্বামী ফ্রাঙ্ক মার্শাল যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যাম্বলিন এন্টারটেইনমেন্ট। তারা দুজন এবং স্টিভেন স্পিলবার্গ যৌথভাবে প্রযোজনা করেছিলেন ‘ই.টি.’ এবং ‘জুরাসিক পার্ক’ এবং কয়েক ডজন সমালোচনামূলক এবং বাণিজ্যিকভাবে হিট ছায়াছবি। জর্জের এটি একটা আকর্ষণীয় চমকপ্রদ পদক্ষেপ ছিল। আমরা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার কিনারায় হাবুডুবু খাচ্ছিলাম আর অন্য দিকে জর্জ চিন্তা করছিলেন লুকাসফিল্ম কে চালাবে, কে আসন্ন চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করবেন। এই নিয়োগ আমাদের বিচলিত করেনি বরং আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম, ক্যাথিও ঠিক আমাদের মতোই অবাক হয়েছিলেন। তিনি যে কোম্পানি পরিচালনা করতে রাজি হলেন তা তো বিক্রি হতে চলেছে! ক্যাথি একজন কিংবদন্তি প্রযোজক এবং তিনি লুকাসফিল্মের মহান অংশীদার হয়ে গেলেন। জর্জের এটা একটা চূড়ান্ত সর্ব্বোত্তম সিদ্ধান্ত। তিনি বিশ্বাস করেন ক্যাথিই তার সর্ব্বোত্তম উত্তরাধিকার এবং কোম্পানির যুতসই সেবক হতে পারবেন। (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা