রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
আটত্রিশ.
দশম অধ্যায়
মার্ভেল এবং মার্ভেল সংশ্লিষ্ট বিশাল ঝুঁকি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আইক পার্লমুটার আমাদের কাছে একজন রহস্যময় ব্যক্তি, তিনি মার্ভেলের পরিচালক। আর এটিই মার্ভল অধিগ্রহণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল। আইক পৌরাণিকভাবে কঠোর চরিত্রের অধিকারী। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। প্রথম জীবনে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি কখনও জনসমক্ষে উপস্থিত হননি এবং নিজের ছবি তোলার অনুমতি দেননি। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিতেন এবং পরে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিজে নিয়ে নিতেন। এভাবেই তিনি নিজের ভাগ্য গড়ে তোলেন। অন্যদের চেয়ে কম বেতন নেয়ার জন্য তার খ্যাতি ছিল। (আইকের আবর্জনা স্তুপ থেকে ধাতব পাত্র সংগ্রহ এবং সেগুলো থেকে কাগজের ক্লিপ বের করার মিথ বাজারে চালু আছে।) এর বাইরে আমরা তার সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। আমাদের কোন ধারণা ছিল না তিনি আমাদের অধিগ্রহণ প্রস্তাবের বিপরীতে কিভাবে, কী প্রতিক্রিয়া জানাবেন বা আমরা যখন তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবো তখন তিনি আদৌ কোন প্রতিক্রিয়া জানাবেন কিনা আমাদের কাছে তা পরিষ্কার ছিল না।
মার্ভেল কমিক্সের সাথে আইকের যোগাযোগ ঘটে ৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ে। মার্ভেলের তৎকালীন মালিক ছিলেন রন পেরেলম্যান। আর এ্যভি অ্যারাড নামে একজন অংশীদারের সাথে আইকের মালিকানাধীন কোম্পানির নাম ছিল টয়বিজ। এক সময় রন পেরেলম্যান টয়বিজের অংশবিশেষ অধিগ্রহণ করেন। ৮০র দশকের শেষের দিকে এবং ৯০র দশকের শুরুর দিকে কমিক-সংগ্রহের রমরমা ব্যাবসা চলছিল। সে সময় মার্ভেল প্রচুর লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তারপর কমিকের ব্যাবসা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। দিনে দিনে লোকসান বাড়তে লাগল। কোম্পানিতে আর্থিক পুনর্গঠন করা হল। দেউলিয়াত্বের মামলাও করা হল। অবশেষে পেরেলম্যানের সাথে আইক, এ্যভি আর আইক্যানের ক্ষমতার দ্ব›দ্ব দীর্ঘায়িত হতে লাগল।
বিনিয়োগকারী কার্ল আইকান পরবর্তিতে মার্ভেলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৭ সালে আইক এবং অ্যারাড কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন এবং পেরেলম্যান এবং অ্যইক্যানকে দূরে সরিয়ে দেন। পরের বছর তারা সম্পূর্ণরূপে টয়বিজ এবং মার্ভেল একত্রিত করে মার্ভেল ইন্টারপ্রাইজ গঠন করেন, যা পরবর্তীতে মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্টে রূপান্তরিত হয়।
যদি তার বিশ্বস্ত কেউ আমাদের সাথে দেখ করার পক্ষে মত দেন শুধুমাত্র তবেই তিনি আমাদের সাথে দেখা করার জন্য সময় দেবেন। তার সাথে যোগাযোগের আমার পরিচিত সেরকম একজন ছিলেন। ডেভিড মাইসেল নামে একজন প্রাক্তন ডিজনি নির্বাহী তাদেরকে সিনেমা ব্যবসায় নামতে সাহায্য করার জন্য মার্ভেলে যোগ দিয়েছিলেন। ডিজনিতে থাকা কালীন সময়ে ডেভিড এবং আমি সবসময় এক পথে হাঁটতাম। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ভালো ছিল। এবং আমরা একসাথে কিছু করতে পারি কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য তিনি তাগাদা দিতেন। মার্ভেল যে সিনেমাগুলো নির্মাণ করছে সেগুলোর পরিবেশক হওয়ার কথা বিবেচনা করার জন্য তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার চাপ দিয়েছেন। কিন্তু আমি কেবল একজন পরিবেশক হতে আগ্রহী ছিলাম না। আমি ডেভিডকে বললাম যে আমি আইকের সাথে দেখা করতে চাই। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম এ বিষয়ে তার কোন পরামর্শ আছে কিনা। তিনি বললেন তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তিনি আরও বললেন এটা একটা দুর্দান্ত ধারণা। কিন্তু তিনি কোনও প্রতিশ্রæতি দিলেন না। তিনি বললেন, ধৈর্য ধরতে হবে।
এদিকে, কেভিন মায়ার আমরা মার্ভেল অধিগ্রহণ করলে ডিজনি সম্ভাব্য কী কী সুবিধাদি অর্জন করতে পারবে সেগুলো সম্পর্কে কল্পনা করা বন্ধ করতে পারেননি। কেভিন তার দ্বায়িত্ব সম্পর্কে তীব্রভাবে মনোযোগী ছিলেন এবং যে কোন কাজে একশতভাগ মনোসংযোগ করতে পারতেন। আমার পেশাগত জীবনে এরকম একনিষ্ঠ মানুষ শুধুমাত্র একজনকেই পেয়ছি, যার নাম কেভিন মায়ার। যখন তিনি মূল্যবান কিছুতে দৃষ্টিপাত করতেন তখন ‘ধৈর্য্য ধারন করুন’ আমার এ পরামর্শ গ্রহণ করা তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যেত। তিনি প্রায় প্রতিদিন আমাকে একই বিষয়ে তাগাদা দিতেন – বলতেন আইকের সাথে যোগাযোগের কোন একটা উপায় খুঁজে বের করুন। আর আমি তাকে বলতাম আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, এবং ডেভিড কী করতে পারেন তা দেখতে হবে।
মাস কেটে গেল। মাঝে মাঝে ডেভিড একই বার্তা দিতেন – এখনও কিছুই হয়নি, অপেক্ষা করুন। অবশেষে তিনি ২০০৯ সালের জুনে একদিন ফোন করলেন এবং বললেন আইক দেখা করতে রাজি হয়েছেন। ডেভিড কখনই ব্যাখ্যা করেননি কেন আইক নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। আমার সন্দেহ, তিনি আইককে আমাদের সম্ভাব্য মার্ভেল অধিগ্রহণের আগ্রহের কথা বলেছিলেন এবং এটিই তাকে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী করেছিল।
আমরা ডেভিডের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার কয়েকদিন পর, আমি মিডটাউন ম্যানহাটনের মার্ভেল অফিসে আইকের সাথে দেখা করতে গেলাম। পিক্সারের জন এবং এ্যাডের সাথে যেভাবে দেখা করেছিলাম, ঠিক একই ভাবে আমি তার সাথে একা দেখা করার জন্য নিউইয়র্কে গেলাম এবং ডিজনি এক্সিকিউটিভদের কেউই আমার সাথে ছিলেন না। আমি চেয়েছিলাম আমি মানুষকে সম্মান করতে পছন্দ করি তিনি তা অনুভব করুক। মার্ভেলের সদর দপ্তর আইকের খ্যাতির প্রমান বহণ করছে। অফিসগুলো প্রাচীন গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের মতো সুসজ্জিত ছিল। তার নিজের কক্ষটি অনেক ছোট্ট আর তেমন সাজানো-গোছানো ছিল না: একটা ছোট্ট ডেস্ক, কিছু চেয়ার, ছোট টেবিলের উপর একটা বাতি। কোন দামী আসবাবপত্র বা চোখ ধাঁধানো কোন দৃশ্য নেই, দেওয়াল স্বজ্জাও খুব কম। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না একজন বিনোদন সংস্থার সিইওর অফিস কক্ষ এমন হতে পারে।
আইক লক্ষণীয়ভাবে আমার সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন, কিন্তু তিনি আমার প্রতি নির্লিপ্ত বা বিরাগভাজন ছিলেন না। তিনি হালকা-পাতলা গড়নের শারিরীক গঠনের অধিকারী ছিলেন কিন্তু তার সাথে করমর্দন করে বুঝলাম তিনি বেশ শক্তিশালী। আমি বসলে তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি আর একটা কলা দিলেন। বললেন, ‘কস্টকো থেকে কিনেছি। আমি এবং আমার স্ত্রী সপ্তাহান্তে সেখানে কেনাকাটা করি।’ আমার জানা ছিল না ডেভিড তাকে আমার সম্পর্কে কী বলেছেন বা আমি কী বিষয়ে কথা বলতে চাই। কিন্তু আপনি কোন একজনের সাথে দেখা করারই অনুমতি পাচ্ছিলেন আর যখন দেখা হলো, প্রথম সাক্ষাতেই আপনি তার কোম্পানি কিনতে চান এমন আলাপ আলোচনা করতে পারেন না। আমার সন্দেহ ছিল আইক বোধহয় জানতেন আমি তার অফিসে গেছিলাম তার একমাত্র কারণ আমরা তার কোম্পানিটা কিনতে চাই। তাই প্রথমে আমরা দুজন, কে কোথা থেকে এসেছি এবং আমাদের নিজ নিজ ব্যবসা সম্পর্কে আলোচনা করলাম। তিনি বিশেষভাবে পিক্সার ক্রয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি ডিজনিতে পিক্সারের একীভূত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বললাম। পিক্সার যাতে তাদের অনূন্য সংস্কৃতি বজায় রাখতে পারে সে বিষয়ে কথা বললাম। সেই সময়েই আমি আমার এখানে আসা আর তার সাথে সাক্ষাতের কারণ ব্যাখ্যা করলাম। এবং মার্ভেলের সাথে অনুরূপ কিছু করার ধারণা উপস্থাপন করলাম।
আইক আমার প্রস্তাবে লাফিয়ে পড়েননি, তবে তিনি এটি প্রত্যাখ্যানও করলেন না। আমরা আরও আধাঘণ্টা কথা বললাম এবং শেষে বললেন যে আমরা আজ রাতে ‘পোস্ট হাউস’ রেস্তরায় দেখা করব। রোড নম্বর ষাটের পূর্ব দিকে অবস্থিত তার পছন্দের একটা স্টেক হাউস। রাতের খাবারের টেবিলে আমাদের কথোপকথন অনেক দীর্ঘ এবং বিস্তৃত ছিল। আইক ইতিমধ্যে যে সমস্ত ব্যবসা পরিচালনা করেছিলেন এবং আমেরিকায় আসার আগে ইস্রায়েলে তার জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল সে সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম । তিনি বিজ্ঞাপনের ছবির মতো বলিষ্ঠ এবং গর্বিত ছিলেন। আমি সম্ভাব্য বিক্রয়ের ধারণা নিয়ে খুব বেশি চাপ দেইনি – মার্ভেল কীভাবে ডিজনিতে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অংশ হতে পারে এটি করার জন্য আমার দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি মাত্র। খাবারের শেষের দিকে তিনি আমাকে বললেন, ‘আমাকে আপনার প্রস্তাবটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে।’ আমি বললাম যে আমি আগামীকাল তার কাছ থেকে জেনে নেবো তিনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরের দিন যখন আমি ফোন করি, তখন আইক আমাকে বললেন যে তার এখনও সন্দেহ আছে তিনি মার্ভেল বিক্রি করবেন কিনা। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিলেন। আইক একজন ধূর্ত ব্যবসায়ী এবং ডিজনির কাছে মার্ভেল বিক্রি করে তিনি বিশাল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেবার জন্য সময় ক্ষেপণ করছেন মাত্র। কিন্তু যখন মার্ভেল সমস্যায় পড়েছিল তখন তিনি এর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন এবং এটির চাকা উল্ট দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় তিনি ভাবছিলেন যে একজন সিইও আসবেন আর এটি কিনে নেবেন। তার সাথে বসে কথা বলারও সুযোগ দেবেন না। তিনি জানতেন যে তিনি এটি বিক্রি করে নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে পারবেন। (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা