রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবত কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহত মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

সাঁইত্রিশ.
নবম অধ্যায়
ডিজনি-পিক্সারের নতুন পথপরিক্রমা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ঘোষণার দিন, অ্যালান ব্র্যাভারম্যান, টম স্ট্যাগস, জেনিয়া মুচা এবং আমি পিক্সারের এমেরিভিলের সদর দফতরে উপস্থিত হলাম। স্টিভ, জন এবং এ্যাড সেখানে ছিলেন। প্যাসিফিক টাইম জোন অনুসারে দুপুর ১টায় স্টক মার্কেট বন্ধ হওয়ার ঠিক পরে পিক্সার অধিগ্রহণের ঘোষণাটি প্রকাশ করার পরিকল্পনা। তারপর পিক্সারের কর্মচারীদের সাথে একটা প্রেস কনফারেন্স আর একটা টাউন হল মিটিং করবো।

সূর্য যখন মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিমে একটুখানি ঢলে গেছে ঠিক তখন স্টিভ আমাকে খুঁজে বের করলেন। আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন। বললেন ‘চলুন একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি’। আমি জানি স্টিভ প্রায়শই বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথে দীর্ঘ হাঁটতে বের হন। এটি তাঁর একটা নিত্য নৈমিত্তিক এবং পছন্দনীয় কাজ। কিন্তু আমি ঘড়ির দিকে দেখে বেশ অবাক হলাম। তার অনুরোধে সন্দিহান হয়ে পড়লাম। আমি টমের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম স্টিভ কি ভাবছেন বা তিন কি চান। আমরা অনুমান করলাম তিনি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে ফিরে আসতে চান বা আরও কিছু চান।

আমি একবার স্টিভের দিকে তাকালাম আর একবার ঘড়ির দিকে। তারপর আমরা বিল্ডিং ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখন ১২টা ১৫ বাজে। আমরা কিছুক্ষণ হাঁটলাম এবং তারপরে পিক্সারের সুন্দর,পরিপাটি করা মাঠের মাঝখানে একটা বেঞ্চে বসলাম। স্টিভ আমার পিছনে তার হাত রাখলেন, যা একটা চমত্কার অপ্রত্যাশিত অঙ্গভঙ্গি। এরপর তিনি বললেন, ‘আমি আপনাকে এমন কিছু বলতে যাচ্ছি যা শুধুমাত্র লরেন্স’- তাঁর স্ত্রী – ‘আর আমার ডাক্তাররা জানেন’। তিনি সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষার জন্য অনুরোধ করলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন তাঁর আগের দূরারোগ্য ব্যাধিটা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কয়েক বছর আগে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের একটা বিরল ব্যাধি তাঁর শরীরে ধরা পরে। সেটা অপারেশনের পরে ডাক্তার ঘোষণা করেছিলেন তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ। কিন্তু এখন আবার সেটা দেখা দিয়েছে।
আমি বললাম, “স্টিভ আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন? আর এখনই বা কেন বলতে হবে?”

তিনি বললেন, ‘আমি আপনার সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার এবং আপনার বোর্ডের সদস্য হতে চলেছি। আমি এর জন্য আপনার কাছে ঋণী। আমি মনে করি এই তথ্য পাবার পর শুধুমাত্র আপনিই চুক্তি থেকে ফিরে আসার জন্য আমাকে সাহায্য করতে পারেন।’
আমি আবার আমার ঘড়িতে সময় দেখে নিলাম। এখন অপরাহ্ন ১২টা বেজে ৩০ মিনিট। আর মাত্র ত্রিশ মিনিট পরে আমাদের চুক্তিটা ঘোষণা করার কথা। আমি স্টিভকে কীভাবে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। নিজেকে জিজ্ঞেস করছিলাম আমি এখন যা জানলাম তা কোনভাবে আমার দ্বারা প্রকাশ হয়ে যায় কিনা। আমার কি এই মুহূর্তে ডিজনি বোর্ডকে কিছু জানান জরুরি? আমি কি আমাদের সাধারণ পরামর্শককে বিষয়টি বলতে পারি? কিন্তু স্টিভ তো সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করতে বলেছেন। আর এ কারণেই তাঁর নতুন প্রস্তাবে সাড়া দেয়া বা চুক্তি বাতিল করা ছাড়া আমি অন্য যে কোন কিছু করতে পারি। এ ধরনের অনুভূতি আমি তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম। অবশেষে আমি বললাম, ‘স্টিভ, ত্রিশ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে আমরা সাত বিলিয়ন ডলারের চুক্তি ঘোষণা করতে প্রস্তুত। আমি আমাদের বোর্ডকে কী বলবো? বলবো আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে?’ তিনি বললেন তাঁর উপর দোষ চাপিয়ে দিতে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ বিষয়ে আমার কি আরও কিছু জানার আছে? দয়াকরে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করুন।’
তিনি আমাকে বললেন যে ক্যান্সার এখন তার কলিজায় আস্তানা গেড়েছে এবং তিনি এটি দমন করার সম্ভাবনার কথা বললেন। তিনি তাঁর ছেলে রিডের উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা সম্পন্ন করার জন্য যাবতীয় করণীয়গুলো এখনই সম্পন্ন করে রাখছেন। যখন তিনি আমাকে বললেন এখনও চার বছর লাগবে তার হাই স্কুল পাশ করতে তখন নিজেকে খুব বিধ্বস্ত বোধ করছিলাম। স্টিভ তাঁর আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি এবং অধিগ্রহণ চুক্তি বন্ধ করা – একই সময়ে দুটি প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া আমার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল।

ডিজনির প্রধান নির্বাহী মাইকেল আইজনারের সাথে আমি। ছবি আগষ্ট ১৯৯৫।

আমি তাঁর চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এমনকি আমি যদি তাঁর নতুন প্রস্তাবে রাজি হই, আমি আমাদের বোর্ডকে বুঝাতে পারবো না কেন আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। তারা শুধুমাত্র পিক্সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদনই করেননি, বরং এটি করার জন্য আমার মাস ব্যাপী ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করেছে। আমাদের অধিগ্রহণ ঘোষণার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। আমি কি সঠিক কাজটি করছি কিনা সে সম্পর্কে আমি নিশ্চত নই। আমি দ্রুত চিন্তা করে বের করলাম স্টিভ নিজে চুক্তির জন্য অপরিহার্য ব্যক্তি ছিলেন না, কিন্তু তিনি অবশ্যই আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। স্টিভ এবং আমি নিঃশব্দে পিক্সারের মঞ্চে, ঘোষণা স্থলে ফিরে এলাম। সেই দিন পরে আমি অ্যালান ব্রেভারম্যানের সাথে কথা বললাম, যাকে আমি আমার ভাইয়ের মতো বিশ্বাস করি এবং স্টিভ আমাকে যা বলেছিলেন তা তাকে বললাম। তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেন, যা আমাকে দুর্দান্ত রকমের স্বস্তি দিলো। সেই রাতে আমি উইলোকেও আমার সিদ্ধান্তের পক্ষে পেলাম। স্টিভের সাথে আমার জানাশোনার অনেক আগে থেকেই উইলো বছরের পর বছর ধরে তাঁকে চিনত। সিইও হিসাবে আমার প্রথম দিনগুলিতে এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। উইলো আমকে নিরাশ করেনি বরং স্টিভের এ দুঃখজনক খবরে আমরা একসাথে কাঁদলাম। তাঁর মরণব্যাধি সম্পর্কে তিনি আমাকে যত যাই বলুন না কেন। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ায়ে জেতার জন্য যতই সংকল্পবদ্ধ থাকুন না কেন, আমরা আশাবাদী হতে পারিনি।

তাঁর সামনের দিনগুলো নিয়ে আমরা হতাশ হয়েছিলাম, ভয় পেয়েছিলাম।
পিক্সার চুক্তিটি প্যাসিফিক অঞ্চরের সময় অনুসারে দুপুর ঠিক ১টা ৫মিনিটে ঘোষণা করা হল। স্টিভ এবং আমি সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য রাখলাম। পরে আমরা দুজনেই পিক্সারের গুহা সদৃশ অট্টালিকার একটা মঞ্চে দাঁড়ালাম, জন এবং এ্যাড আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন, প্রায় এক হাজার পিক্সারের কর্মীবৃন্দ আমাদের সামনে বসে আছেন। আমি কথা বলার আগে, সেই মুহূর্তটিকে স্মরণ করার জন্য কেউ একজন আমাকে উপহার হিসেবে একট লাক্সো-ল্যাম্প দিলেন। আমি গ্রুপটিকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তাদের অপ্রত্যাশিতভাবে বললাম যে আমি আমাদের দুর্গকে আলোকিত করার জন্য এটি ব্যবহার করবো। তখন থেকেই আমি তাদের হয়ে গেলাম।

দশম অধ্যায়
মার্ভেল এবং মার্ভেল সংশ্লিষ্ট বিশাল ঝুঁকি
পিক্সার অধিগ্রহণ ডিজনি অ্যানিমেশনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমাদের জরুরি প্রয়োজন পূরণ করেছে। কিন্তু এটি আমাদের বৃহত্তর কৌশলের প্রথম পদক্ষেপ ছিল। শ্রেষ্ঠ মানের ব্র্যান্ডেড সামগ্রী উত্পাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি আকর্ষণীয় মানের পণ্য উত্পাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ভোক্তাদের কাছে সেই পণ্যগুলির সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আমাদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখা আমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য আমাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

‘লক্ষ্যিত অধিগ্রহণের’ একটা তালিকা টম স্ট্যাগস, কেভিন মায়ার, এবং আমার কাছে ছিল। আমরা বিশ্বাস করতাম লক্ষ্যিত কোম্পানিগুলোর অধিগ্রহণ আমরা সম্পন্ন করতে পারলে আমাদের কোম্পানির কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলি পূরণে সহায়ক হবে। আমরা প্রথমে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অধিগ্রহণের উপর জোড় দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারা সেই দুর্দান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মালিক যা আমাদের ব্যবসার সম্পূর্ণ পরিসর জুড়ে প্রয়োগ করা যাবে। এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই যে দুটি কোম্পানির নাম অবিলম্বে মাথায় আসে তা হচ্ছে এক. মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট এবং দুই. লুকাসফিল্ম। কিন্তু এ কোম্পানি দুটির কোনটি বিক্রয় হতে পারে কিনা সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। বিভিন্ন কারণে (আমি বিশ্বাস করি জর্জ লুকাসকে রাজি করানো খুব কঠিন হবে। কারণ তিনি নিজেই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের কোম্পানির প্রতি ভালোবাসার কারণে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্টার ওয়ার্স কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেন) আমরা আমাদের তালিকার শীর্ষে মার্ভেলকে রাখি। আমি মার্ভেলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে কখনও প্লাবিত হইনি। মার্ভেল বুঝতে হলে আপনাকে কৌতুকের আজীবন পাঠক হতে হবে না। মার্ভেল হচ্ছে মূল্যবান, আনন্দঘন চরিত্র ও গল্পের ভান্ডার এবং যা আমাদের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, থিম-পার্ক এবং ভোক্তাদের সাথে সহজেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আমাদের অধিগ্রহণ তালিকায় অন্যান্য অনেক কোম্পানি ছিল, কিন্তু মার্ভেল এবং স্টার ওয়ার্সের মতো মূল্যবান কোনটিই ছিল না।

মার্ভেল অধিগ্রহণের পথটা জটিলতায় পূর্ণ ছিল। মার্ভেল ইতিমধ্যে অন্যান্য স্টুডিওর সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল। একাধিক আসন্ন চলচ্চিত্রের জন্য প্যারামাউন্টের সাথে তাদের বিতরণ চুক্তি ছিল। তারা কলম্বিয়া পিকচার্সের কাছে স্পাইডার-ম্যানের স্বত্ব বিক্রি করেছেন (কলম্বিয়া পিকচার্স পরবর্তীতে সনি নাম ধারন করে)। ’দ্যা ইনক্রাডেবল হাল্ক’ নিয়ন্ত্রণ করছিল ইউনিভার্সাল । ফক্সের মালিকানায় ছিল ‘এক্স-মেন’ এবং ‘দ্যা ফ্যান্টাস্টিক ফোর’। তাই আমরা সেই সকল কিছু অধিগ্রহণের কথা চিন্তা করছিলাম যেগুলো অন্যান্য স্টুডিওগুলির সাথে চুক্তিবদ্ধ নয়। এটা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অধিগ্রহণের মতো খাঁটি অধিগ্রহণ হবে না, যা আমরা আদর্শগতভাবে পছন্দ করি। আমরা এক ছাতার নীচে সমস্ত গল্প আর চরিত্রগুলে পাবো না। ফলে ব্র্যান্ড বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতাও সৃষ্টি হতে পারে। (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা