রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
সাতাশ.
সপ্তম অধ্যায়
ভবিষ্যতের কথা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ম্যাক্সকে বললাম আমার পেটে ব্যাথা। বাড়ির দিকে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। সেই বিকেলে বৃষ্টির সাথে প্রচন্ড গতির ঝড় প্রবাহিত হচ্ছিল। রাস্তার খুব সামান্যই আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। মনে হচ্ছে কে যেন আমার বুকের ভেতরে হৃদযন্ত্রটা চেপে ধরেছে। আমি জানতাম আমার এমন শারিরীক অবস্থায় ছেলেকে পিছনের সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করা বোকামী। চিন্তা করছিলাম আমি ভয়াবহ ভুল করে ফেলেছি। সেই মুহূর্তে আমার মাথায় আর একটা চিন্তা কাজ করছিল, আমার বাড়ি পৌঁছানো জরুরী। আমাদের ড্রাইভওয়েতে আমি গাড়ি থামালাম। ম্যাক্স লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আমি কাল বিলম্ব না করে আমার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডেনিস ইভাঞ্জেলাটোসকে ফোন করলাম। তারপর আমার এক বন্ধুকে ফোন করে ডাকলাম, যিনি আমাকে ডেনিসের বাসায় নিয়ে গেলেন। ডেনিস আমাকে ভালোভাবে চিনতেন আর আমি যে মানসিক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ সেটাও ভালোভাবে জানতেন। তিনি আমার প্রধান লক্ষণগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন, তারপর আমার চোখের মণির চারপাশ পরিক্ষা করে দেখলেন। বললেন, ‘বব, আপনি ভয়াবহ রকমের উদ্বেগে আক্রান্ত। আপনার বিশ্রাম দরকার।’
একটু স্বস্তি ফিরে পেলাম, আবার মনে মনে ভয়ও পাচ্ছিলাম। আমার নিজের সম্পর্কে ধারণা ছিল প্রচন্ড মানসিক চাপে আমি নির্বিকার থাকতে পারি, কাজে যথার্থ মনোযোগ দিতে পারি এবং উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারি। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আমাকে যে ক্ষতির সম্মূখিন করেছে তা বহণ করা আমার ক্ষমতার বাইরে। আমার পরিবার বা বন্ধুবান্ধব তেমন কিছু টেরই পায়নি। কিন্তু এর চেয়েও বড় ক্ষতি হয়ে যেত পারতো। আমি ডেনিসের বাড়ি থেকে বাসায় ফিরে আসলাম। কিছু সময় একান্তে কাটালাম। যা কিছু ঘটেছে সেগুলো পুরোটা আর একবার মনের চোখ দিয়ে দেখে নিলাম। আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি সেটি একটি বিশাল চাকুরী, বিশাল পদবী কিন্তু এটি আমার জীবনের সবকিছু নয়। আমার স্ত্রী উইলো আছে, ছেলেরা আছে। মেয়ে দুটো নিউ ইয়র্কে থাকে। আমার বাবা-মা আছেন, আমার বোন আছে। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছেন। এতোসব ধকল শুধুমাত্র একটা চাকুরীর জন্য। আমি নিজেকে বললাম, ‘এটি না হলে কি আমার চলবে না?’
একমাত্র সময় আমি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের সাথে দূরব্যবহার করেছিলাম, সেটি ছিল আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎকার। সারা মাস ব্যাপী সাক্ষাৎকার প্রদান এবং উপস্থাপনের পর তাঁরা আমাকে সর্বশেষ সাক্ষাৎকার দেবার জন্য একদিন রবিবার সন্ধায় হোটেল প্যাসেডনার কনফারেন্স কক্ষে ডাকলেন । সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থানে এসে আমি জানতে পারলাম যে তাঁরা সারা বিকেল একজন বোর্ড মেম্বারের বসায় ই-বে এর প্রধান নির্বাহী মেগ হুইটম্যানের সাক্ষাৎকার গ্রহনে ব্যয় করেছেন। তিনি অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী ছিলেন। অন্য চারজন সাক্ষাৎকার প্রদান থেকে বিরত ছিলেন অথবা তাঁরা বাদ পড়েছেন। ততোক্ষণে আমার কাছে পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। তাঁরা যে সমস্ত প্রশ্ন করেছেন তার সবগুলোরই উত্তর আমি অনেকবার বিস্তারিতভাবে প্রদান করেছি। কোম্পানিটি প্রায় ছয় মাস ব্যাপী একটা অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের মধ্যে রয়েছে। আমি এর পরিসমাপ্তি চাই। ছয় মাস অনেক লম্বা সময়, তাঁরা এ সমস্ত কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। যদি আপনি মাইকেলকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া আর সময় গণনা করেন তবে এটি অনেক লম্বা সময় হয়ে যাবে। বোার্ডের কিছু সদস্য এ বিষয়ে কিছুই টের পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি আমার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করেছি। আমি এর পরিসমাপ্তি চাই।
চুড়ান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণের শেষ পর্যায়ে গ্যারি উইলসন আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। তিনি সমস্ত বাছায় প্রক্রিয়া ব্যাপী মাইকেলকে অসম্মান করার জন্য আমাকে প্ররোচিত ও উত্তেজিত করার কাজে লিপ্ত ছিলেন। আমাকে আবার একই ধরনের একগুচ্ছ প্রশ্ন করলেন, ‘বলুন কেন আমাদের বিশ্বাস করতে হবে আপনি মাইকেল থেকে আলাদা? মাইকেলের ভুলগুলো কি ছিল? আপনি ব্যতিক্রম কি করবেন?’ মুহূর্তে রাগে প্রজ্জলিত হয়ে গেলাম, অন্যান্য বোর্ড মেম্বারদের সামনেই তাঁকে পাল্টা আঘাত করলাম। অনেক কষ্টে কন্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করে বললাম, ‘আপনি আমাকে একই ধরনের প্রশ্ন আগের তিনটি সাক্ষাৎকারে করেছেন। এটি ভীষণ আপত্তিকর। আমি এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবো না।’
রুমের সকলেই চুপ হয়ে গেল। সাক্ষাৎকারটি আকষ্মিকভাবে ওখানেই শেষ হয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম, কারও দিকে দৃষ্টি বিনিময় না করেই আমি কক্ষ ত্যাগ করলাম। আমি কারও সাথে করমর্দন করিনি। কাউকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিনি। স্বনির্ধারিত ফলাফল অর্জন করলাম। ধৈর্য ও সম্মানের সাথে তাঁরা আমাকে কিছু দেবে তার তোয়াক্কা না করেই আমি কক্ষ ত্যাগ করলাম। বাসাই পৌঁছানোর পর জর্জ মিশেল এবং আর একজন বোর্ডের সদস্য অ্যালউইন লিউইস আমার সাথে ফোনে কথা বললেন। জর্জ বললেন, ‘আপনি আপনার অপূরণীয় ক্ষতি করেননি। আবার আপনি এমন কিছু ভালো কাজও করেননি।’ অ্যালউইন অনেকটা রুক্ষভাবেই বললেন, ‘আপনি যে এতো মিষ্টি মনের মানুষ সেটা সবাইকে দেখানোর এটা উপযুক্ত সময় ছিলনা, বব।’
বোর্ডের সম্মানিত সদস্যদের সামনে এমন রুক্ষ আচরণ করে আমি খুশি হইনি। কারণ আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ। সেই মুহূর্তে আমি আমার রাগ ফিরিয়ে নিতে পারতাম না। তবে আমি মনে করি আমার রাগ করা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ছিল। জর্জের সাথে ফোনালাপ শেষে আমি বললাম, ‘দয়া করে আর দেড়ি না করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন। এ সমস্ত কিছুর জন্যই কোম্পানির ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না।’
যখন আমি পিছন ফিরে সেই সময়টাকে অবলোকন করি তখন আমার কাছে মনে হয় আমি অনেক কষ্ট করে শিখেছি চারিত্রিক দৃঢ়তা আর অধ্যাবসায়ের মূল্য কত। তবে যে সমস্ত বিষয়ের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই কিন্তু সেগুলো আপনার স্বকীয়তাকে চ্যালেঞ্জ করছে এমতাবস্থায় নিজেকে রাগ ও উদ্বেগ থেকে দূরে রাখাও জরুরী। ব্যাক্তির অস্তিত্বের মধ্যে শিকড় গেড়ে থাকা অহংকারকে আঘাতে আঘাতে দূরে সরিয়ে রাখা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আর কষ্টসাধ্য তা বলে বোঝানো যাবে না। অহংকার মানুষের মনে অনেক বেশি জায়গা দখল করে অবস্থান করে, মনুষ্য শক্তির বেশির ভাগই ধ্বংষ করে ফেলে। আশাবাদী হয়ে উঠা অনেকটা সহয হয়ে যায় যখন প্রত্যেকে বলেন আপনি দূর্দান্ত কাজ করেছেন। কিন্তু যখন প্রতিনিয়ত জনসমক্ষে আপনার স্বকীয়তাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে তখন সেটি পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আবার সেটি পাবার জন্য মনের মধ্যে একটা জেদও কাজ করে।
আমার পেশাগত জীবনে এই প্রথম আমি এত উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মুখোমুখি হলাম। উত্তরাধিকার প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল ছিল। আমি কতটুকু অযোগ্য ছিলাম সে সম্পর্কে জনসমক্ষে এত বেশি কথার পেঁচাল চলছিল সে গুলোকে পরিশুদ্ধ করে আমার যেগ্যতাকে উদ্ভাসিত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। মর্মাহত হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে যে কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃংখোলাবোধ ও ভালোবাসা শিখেছি জীবনে এটি যে কত মূল্যবান তা আজ উপলব্ধি করতে পারছি। আমি কে, সেটি কোন বড় বিষয় নয়। আমি কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃংখোলাবোধ ও ভালোবাসাবোধকে নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পেরেছি। নিজের কর্মকান্ড ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বাকি সমস্ত কিছু আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সাধ্যমতো প্রতিটি মুহূর্তে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছি। ফলে কোন ধরণের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বা আচরণগত বিড়ম্বনা আমাকে খুব একটা কাহিল করতে পারেনি।
২০০৫ সালের মার্চ মাসের এক শনিবারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য বোর্ড মিটিং ডাকা হলো। বোর্ডের সকল সদস্যকে সভায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মাইকেল আর জর্জ মিশেল পাশাপাশি বসেছেন। নিউইয়র্কে এবিসি টেলিভিশনের এক সভা কক্ষে সভা চলছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথার মধ্যে চিন্তা আসল আমি মনে হয় বোর্ডের সদস্যদের যারা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি তাঁদের যথেষ্ট মাত্রায় বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে আমিই যোগ্যতম ব্যক্তি। কিন্তু যখন সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া আর এ প্রক্রিয়ার সমস্ত নাটকীয় ঘটনা চিন্তার মধ্যে আসল তখন মনে হচ্ছিল তাঁরা অন্য কাউকে বেছে নেবে। কিছু সংশয়বাদী হয়তো জোরপূর্বক নতুন কিছু করার পক্ষে যুক্তি দেখাবে এবং একজন বহিরাগতের নাম প্রস্তাব করবে।
সেদিন আমি আমার দুই ছেলের সাথে সময় কাটালাম। কোন বিশেষ দিকে গভীর মনোযোগ দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলাম। ম্যাক্স আর আমি বিক্ষিপ্তভাবে বল খেললাম। বাইরে দুপুরের খাবার খেলাম। বাসার কাছাকাছি ম্যাক্সের একটা প্রিয় পার্কে সময় কাটালাম। উইলোকে বললাম যদি খারাপ খবর আসে তাহলে সোজা আমার গাড়িতে উঠে পড়বো আর সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াবো। আমার বহুদিনের স্বপ্ন নিজে ড্রাইভ করে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়ানোর। একা একা আমেরিকার এক রাষ্ট্র থেকে আর এক রাষ্ট্রে নিজে ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়ানো স্বর্গে ঘুরে বেড়ানোর মতো মনে হয়।
সভা শেষ হবার সাথে সাথে জর্জ মিশেল আর মাইকেল আমাকে বাসায় ফোন করেছিলেন। বাসার যে অফিস কক্ষটা আমরা দুজনে শেয়ার করি সেই অফিস কক্ষে তখন আমার সাথে উইলো ছিল। তাঁরা দুজনেই বললেন ডিজনির প্রধান নির্বাহীর পদটি আপনার। আগামী কাল এটি ঘোষণা করা হবে। মাইকেলের প্রশংসা না করে উপায় নেই, তিনিও আমার সাথে এ বিষয়ে ফোনে কথা বললেন। আমি জানি এটি তাঁর জন্য অত্যন্ত কষ্টের। কোম্পানির কাজে তিনি নিজেকে পুরোটায় ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি এ চাকুরী ছেড়ে দেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন না। যদি তাঁকে পদ থেকে সরে যেতেই হয় তবে আমার বিশ্বাস তাঁর জায়গায় আমাকে দেখে তিনি খুশিই হবেন। (চলবে)
– টরন্টো, কানাডা