রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

ত্রয়োদশ.
চতূর্থ অধ্যায়
ডিজনির সান্নিধ্য
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) দুই সপ্তাহ পরে অধিগ্রহণের বিষয়টি ঘোষণা করলাম। সেদিনই আমি সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর জন্য অ্যাসপেন উড়ে গেলাম, মাইকেল আর তাঁর স্ত্রী জেনের সাথে সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর জন্য তাঁদের বিলাসবহুল বাড়ি স্নোম্যাসে গেলাম। একটা বিশাল কাঠেরগুঁড়ি সদৃশ সৌন্দর্য মন্ডিত বিশাল বাংলো দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এটির নক্সা প্রস্তুত করেছেন বিখ্যাত আর্কিটেক্ট বব স্টার্ন, তিনি ডিজনি বোর্ডেরও সদস্য। অ্যাসপেনের ছোটবড় পাহাড় শৃঙ্গ বেষ্টিত উপত্যকায় যেন এক পাখির বাসা। চারিদিকে সৌন্দর্যের ঝর্ণাধারা বইছে। অন্য এক তৃপ্তি বোধ করছি।

ডিজনি তার নিরলস প্রচেষ্টা ও সতর্কতার সাথে বিশাল সম্পদের মালিকানা ক্রয় করেছে কিন্তু নতুন কোম্পানির জটিলতাগুলোর মালিকানা পর্যায়ক্রমে অর্জন করবে। আমি সাথে করে এনেছি অসংখ্য নথিপত্র যার প্রত্যেকটি ক্যাপিটাল সিটি আর এবিসি কোম্পানির অনেক বিচিত্র ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারিত বিবরণ ধারণ করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন স্টেশনসমূহ, ইএসপিএন, বিশাল এলাকা ব্যাপী বিস্তৃত অগোছালো রেডিও ব্যাবসা, একটা বিশাল প্রকাশনা সংস্থা যেখান থেকে খবরের কাগজ ও একাধিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়, তারের মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশনের সংযোগ প্রদান ব্যাবসা এবং বেশকিছু ছোট ব্যাবসা। আমি বললাম, ‘আপনার টিম খুব দ্রæত সম্পদের হিসাব-নিকাস সম্পন্ন করেছে। কাজেই অনেক কিছুই আপনার অজানা থাকা স্বাভাবিক।’

পরের দুই দিন আমি আমাদের কোম্পানির খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয় আলোচনা করলাম। তিনি হয়তো ভাবছেন আমরা কিনলাম টেলিভিশন কোম্পানি, এখন তো দেখি এটি এর চেয়েও অনেক বেশি জটিল। ইএসপিএনের অধিগ্রহণ চুক্তি থেকে শুরু করে আসন্ন এবিসি ও এনএফএল আলোচনার সমস্ত বিষয় আমাদের আলোচনার অন্তর্ভূক্ত ছিল। আমাদের সমস্যাপূর্ণ রেডিও ব্যাবসার খুঁটিনাটি তাঁর সামনে তুলে ধরলাম। এর নেটওয়ার্ক গ্রাম থেকে নিউ ইয়র্ক মেট্রপলিটন এলাকার সর্বত্র বিস্তিৃত ছিল। একজন রেডিও হোস্ট কিছু বিতর্কিত ও উত্তেজনা ছড়ায় এমন কথা-বার্তা স¤প্রচার করেছিলেন আমরা তাঁর বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থ নিয়েছিলাম সে গুলোও আলোচনা করলাম। বারবারা ওয়াল্টরের চুক্তিনামায় একটা সূ² সমস্যা ছিলো, যার মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চলেছে সেগুলো বললাম। টেলিভিশনে সংবাদ ব্যবসা পরিচালনার জটিলতাসমূহ তাঁর সাথে আলোচনা করলাম। আলোচনায় জটিলতার সংখ্যা বাড়তেই থাকল। আমি চাচ্ছিলাম মাইকেল যেন বাস্তবতা সঠিকভাবে বুঝতে পারেন। আর আমি যে এ সমস্ত বাস্তবতার সম্মূখ যোদ্ধা সেটাও তিনি যেন বুঝতে পারেন।
মাইকেলকে স্পষ্টভাবে নড়বড়া দেখাচ্ছিল। সে সময়ে মাইকেলের বয়স ছিল মাত্র বাহান্ন বছর। এক বছর আগে তাঁর হৃৎপিন্ডে বাইপাস অপারেশন হয়েছে। আর জেন তাঁর খাওয়া-দাওয়া, কাজের তালিকা আর নিয়মিত শরীর চর্চার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে চলেছেন। আমি তখনও জানতাম না তিনি কি পরিমান উদ্বিগ্ন ছিলেন তাঁর জীবন ব্যবস্থা পাল্টে দেবার জন্য বা নতুন অধিগ্রহণ তাঁকে কি পরিমাণ বিচলিত করেছিল। জেন চান তাঁর স্বামী যেন কম কাজ করেন, আর আমি কিনা তাঁর উপস্থিতিতেই তাঁর স্বামীকে বলছি, ‘আপনাকে অবহিত করার চেয়েও অতিব জরুরী কাজকর্ম রয়ে গেছে যেগুলো এখনই পদেক্ষেপ নিলে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

সাপ্তাহিক ছুটি শেষে মাইকেল আমাকে তাঁর নিজের গাড়িতে এয়ারপোর্টে পৌছে দিল। পথিমধ্যে আমরা খানিকক্ষণ যাত্রা বিরতি করলাম মাইকেল ওভিজ ও তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। তাঁদের বাসা জেন আর মাইকেলের বাসার কাছাকাছি। ওভিজের পরিবারের গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পরিকল্পনা ছিল। আমি জানতাম না দুটি পরিবার এত ঘনিষ্ঠ। সেই বিকেলে দেখলাম তাঁদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ মজার সম্পর্ক রয়েছে। ওভিজ সা¤প্রতিক কালে তঁর নিজের যৌথভাবে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি সিএএ ছেড়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাধর বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিষ্ঠানে যোগদানের চেষ্টায় নিমগ্ন ছিলেন, আশা করেছিলেন ইউনিভার্সাল ইস্টুডিও পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন। সেটা শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। বর্তমানে তিনি হলিউড ভিত্তিক পেশার সন্ধানে আছেন। আমি এয়ারপোর্টে যথা সময়ে পৌঁছালাম, বিমানটি যথারীতি নিউ ইয়র্কের মাটি স্পর্শ করল। মাইকেল মনে হচ্ছে তাঁকে ডিজনির দুই নম্বর পদটি দিতে যাচ্ছেন- এ কথা ভেবে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।
এক সপ্তাহ পরে আমার অনুমানটা সত্য হয়ে ধরা দিল। মাইকেল আমার সাথে ফোনে কথা বলল। বলল, ‘আপনার দেয়া তথ্যগুলো আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি নিশ্চিৎ এই নতুন কোম্পানি পরিচালনা করা খুব সহজ হবে না। জেনও ভিষণ উদ্বিগ্ন’। তারপর সে সরাসরি ওভিজের প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল, ‘যখন আমরা নতুন কোম্পানিটি কেনার জন্য কথা বলছিলাম তখন আমি আমাদের দুজনের মাঝে একজনকে নিয়ে আসার কথা বলেছিলাম, আপনার নিশ্চয় মনে আছে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি যদিও জানতাম ভবিষ্যতের কথা নিশ্চিৎ করে কেউ কিছু বলতে পারে না।’ তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আমি মাইকেল ওভিজকে নিয়োগ দিচ্ছি, আর তিনি আপনার অধিকর্তা হবেন।’

ওভিজ দ্যা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা নয়। প্রতিষ্ঠানের কাঠামো অনুসারে তিনি আমার বস, তবে তিনি নিশ্চিৎভাবে মাইকেলের উত্তরাধিকারী নন। এক মূহূর্তের জন্য মনোভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও, আমি মাইকেলকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না কারণ তিনি আমাকে সরাসরি বলেছিলেন আমাদের দুজনের মাঝে একজন প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। কোন লুকোচুরির আশ্রয় নেননি বা কোন ভন্ডামির আশ্রয় নেননি। সে সময়ে আমি চুয়াল্লিশে পা দিয়েছি। আমার এখনও অনেককিছু শেখার আছে। তঁদের কারও সাথে খারাপ সম্পর্ক দিয়ে শুরু করার কোন মানেই হয় না। ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। আমি চাচ্ছিলাম ভালই ভালই কাজ শুরু হোক। মাইকেল ওভিজের নাম ঘোষণার পর আমি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলাম, ‘যদি মাইক এইজনার কোম্পানির জন্য এটিই মঙ্গোলজনক মনে করেন, তবে তাঁর মনোবৃত্তির প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।’ যখন আমার উক্তিটি খবরের কাগজে প্রকাশ পেল তখন ডিজনির একজন নির্বাহী আমাকে ফোন করে বললেন মাইকেল অসন্তোষ্ট হয়েছেন খবরের কাগজে আপনার উক্তিটি পড়ে। তিনি চান না কেউ তাঁকে ‘মাইক’ বলুক। কাজ শুরু না করতেই একটা বেফাঁস, বিব্রতকর আচরণ করে বসলাম।

দ্রæতই শুনতে পেলাম ওভিজের নিয়োগের বিষয়ে আরও অনেকে আমার চেয়েও অনেক কঠিন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। আমার কানে এসেছিল স্টুডিওর চেয়ারম্যান জো রথ তাঁর নিয়োগে বিরক্ত হয়েছিলেন। স্যান্ডি লিটভ্যাক ও স্টিভ বোলেনব্যাচ অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছিলেন। ডিজনির চিফ ফাইনানসিয়াল অফিসারও কোম্পানির নতুন কাঠামো দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ওভিজকে রিপোর্ট করতে অস্বীকার করেন। ডিজনির প্রধান কার্যালয়ে যে বিরক্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল তা আমি তিন হাজার কিলোমিটার দূরে নিউ ইয়র্কে বসেই টের পাচ্ছিলাম। মাইকেল ওভিজের নিয়োগ সংক্রান্ত ঘোষণা আসার সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব কলোহের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এটি কতদূর গড়াবে সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।

পরবর্তী কয়েক মাস যখন আমরা ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষা করছিলাম তখন সপ্তাহে একবার লস অ্যঞ্জেলেসে যেতাম। উদ্দেশ্য ছিল ডিজনির নির্বাহীদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা, যারা অচিরেই আমার সহকর্মী হবেন। আমি আর উইল ভাল করেই জানতাম অনুমোদন আসার পর আমাদের হানিমুনে যাওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং আমরা আমাদের বিবাহের বাগ্দান প্রক্রিয়ায় ব্যাপক কাটছাঁট করে সংক্ষিপ্ত করে এনেছিলাম। আর ১৯৯৫ সালের অক্টোবরের শুরতে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।
আমাদের হানিমুনের দিনগুলো কেটেছিল দক্ষিণ ফ্রান্সে। সেখানে ‘পোশ গ্রান্ড-হোটেল ডু ক্যাপ-ফেরাট’ নামক হোটেলে আমরা ছিলাম। সেই হোটেলে আমাদের ঠিকানায় একটা বড় বাক্স আসল আর সেটা ছিল ডিজনির পণ্যসামগ্রীতে পরিপূর্ণ। মিকি মাউসের ম্যাচকরা পাজামা, বর-কণের মিকি হ্যাট, ডোনাল্ড ডাক চপ্পল। এতো বেশি পণ্যসামগ্রীতে পূর্ণ ছিল যে আমরা ভেবে ক‚ল-কিনারা করতে পারছিলাম না এতসব দিয়ে আমরা কি করবো। একবার চিন্তা করলাম আমরা এগুলো এখনে রেখে চলে যাবো। হয়তো কোন একজন অপ্রয়োজনীয় ভেবে লাথি মেরে ফেলে দেবে আবার কেউ হয়তো ছোটবাচ্চাদের কথা ভেবে যতœ করে বাসায় নিয়ে যাবে। আবার এটা ভেবে লজ্জ্বিত হই যে এখানে এগুলো ছেড়ে যাবার পর আবার আমাদের ঘরে দেখতে পাবো। মিকি মাউস এখন পরাশক্তি। এগুলো দেখে আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। আমি উইলকে বললাম, ‘আমি এখন এক অন্য ধরনের কোম্পানিতে কাজ করি।’ (বাস্তবে আমি যত বছর মাইকেল আইজনারের জন্য কাজ করেছি আমি কোনদিন তাঁকে মিকি টাই ছাড়া অন্য কোন টাই পরে থাকতে দেখিনি। এমনকি সমস্ত জেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মিকি টাই পরার জন্য উৎসাহিত করা হতো। আমি যদিও এদেরই একজন কিন্তু কখনও এ ধরনের কোন চিঠি পাইনি।)

বিখ্যাত এবং ব্যয়বহুল পোশাক পরিচ্ছদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য অনেক কিছু বলার আছে। ডিজনির পুরো সাংগঠনিক সংস্কৃতি ভিন্নভাবে পরিচালিত হোত। টম ও ড্যান উষ্ণ আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ছিলেন। তাঁদের দুয়ার সকলের জন্য অবারিত ছিল। আপনি যদি কখনও কোন সমস্যায় পড়েন, তবে আপনার জন্য তাঁদের দরজা সবসময় খুলে রাখতেন। আপনি যদি উপদেশ চান, তবে ব্যক্তিনিরপেক্ষ স্বার্থশূন্য উপদেশ পাবেন অবলীলায়। তাঁরা খরচ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সিদ্ধহস্ত, তদ্রæপ আয় বৃদ্বির বিষয়েও কোন ছাড় দিতেন না। কারণ তাঁরা জাত বেনিয়া ছিলেন। যে সকল নির্বাহী তাঁদের নীতি আদর্শ মেনে চলতেন সববসময় তাঁরা তাঁদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতেন। তাঁরা বিকেন্দ্রীভূত সাংগঠনিক কাঠামোতে বিশ্বাস করতেন। আপনি যদি প্রদত্ত বাজেটে আটকে যান এবং আপনি যদি তাঁদের সাথে নৈতিকতাপূর্ণ আচরণ করেন তবে টম ও ড্যান আপনাকে খরচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেবেন। চিফ ফাইনানসিয়াল অফিসার আর সাধারণ পরামর্শক ছাড়া আর কোন কর্পোরেট কর্মী তাঁদের কোম্পানিতে ছিলেন না। কোন ধরনের কেন্দ্রীয় শাসনের প্রথা তাঁরা অনুসরণ করতেন না। বিভাগীয় কাজে খুব নগন্য হস্তক্ষেপের মুখোমূখি হতে হোত।

এ সমস্ত কিছুর একেবারে বিপরীত সাংগঠনিক সংস্কৃতি ডিজনি অনুসরণ করত। শুরুর দিকে কোম্পানি পরিচালনার জন্য মাইকেল আর ফ্রাঙ্ক ওয়েল একটা কেন্দ্রীয় ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ছিল কৌশলগত পরিকল্পনা, এখানে নিয়োগ দিয়েছিলেন তুখোর আর উচ্চ শিক্ষিত নির্বাহীদের (তাঁদের সকলেই এমবিএ ডিগ্রী করা, অনেকেই হার্বার্ড আর স্ট্যামফোর্ড থেকে এমবিএ করা)। তঁদের ব্যাবসায়িক বিশ্লেষণ ছিলো অভেদ্য, প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদানে পটু। মাইকেল যে কোন বড় ধরনের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নিজে সঙ্কামুক্ত হতে চাইতেন যদিও সমস্ত সৃজনশীল সিদ্ধান্তসমূহ এককভাবে তিনি নিজেই নিতেন। সমস্ত কোম্পানির উপর তাঁদের লক্ষণীয় মাত্রায় প্রভাব বিরাজমান ছিল। তাঁদের উপর ন্যাস্ত ক্ষমতা নির্দিধায় ব্যবহার করতেন কোম্পানির সকল প্রবীন নেতাদের উপর, যারা ডিজনির বিভিন্ন বিভাগ পরিচালনা করতেন।

প্রধান নির্বাহী হিসেবে মাইকেলের একুশ বছরের রাজত্বের যখন অর্ধেক সময় পার করছেন তখন আমি ডিজনিতে পদার্পণ করলাম। তিনি কর্পোরেট আমেরিকার বিখ্যাত ও সফল প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে একজন ছিলেন। আর তাঁর প্রথম দশক ছিলো বিস্ময়কর সাফল্যে পরিপূর্ণ। তিনি অপ্রতিরোধ্যভাবে ডিজনির থিমপার্ক এবং রিসোর্টের স¤প্রসারণ ঘটান এবং অতি লাভজনক মূল্য নির্ধারণ কৌশলের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রমোদ তরী ব্যবসা শুরু করেন যা অন্যান্য ব্যবসার চেয়ে আকারে ছোট কিন্তু টেকসইভাবে লাভজনক ছিল। আশির দশকের শেষভাগ আর নব্বইয়ের শুরু পর্যন্ত ডিজনি অ্যানিমেশন একটার পর একটা জনপ্রিয় অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। দ্যা লিটিল মারমেইড, বিউটি এন্ড দ্যা বিস্ট, আলাদীন এবং দ্যা লিয়ন কিং উল্লেখযোগ্য। এগুলোই ডিজনির গ্রাহক-পণ্য ব্যবসায় বিষ্ময়কর সাফল্য এনে দেয়। আয় আসতে থাকে বিশ্বব্যাপী ডিজনি স্টোর চালু করা, এই ব্যবসাগুলোর লাইসেন্স দেয়া এবং সারা বিশ্বে পণ্যসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরা যে ডিজনি চ্যানেল শুর করেছিলেন সেটিও খুব দ্রুতই সফলতার মূখ দেখে। ডিজনি স্টুডিও, যারা লাইভ এ্যকশন চলচিত্র নির্মাণে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা একগুচ্ছ ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

আমরা যখন কোম্পানিটিতে যোগদান করলাম ঠিক তখনই ব্যাবসায়িক ফাটল ধরা পড়ল। ফ্র্যাঙ্ক ওয়েলসের মৃত্যুর পর শূণ্যতার সৃষ্টি হল। ফলস্বরূপ মাইকেলের সাথে জেফরি ক্যাটজেনবার্গের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে লাগল। মাইকেলের প্রথম দশকে অ্যানিমেশন ব্যবসায় যে প্রভূত সফলতা পেয়েছিলেন তার একচ্ছত্র দাবীদার জেফরি ক্যাটজেনবার্গ। মাইকেলের উপর জেফরি রাগান্বিত ছিলেন, কারণ ফ্র্যাঙ্ক ওয়েলসের মৃত্যুর পর তিনি তাঁকে ফ্র্যাঙ্কের জায়গায় পদোন্নতি দেননি। মইকেল জেফরির উপর ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয় ব্যক্ত করলেন কারণ তিনি পদোন্নতির জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। ১৯৯৪ সালে, মাইকেলের বাইপাস সার্জারির বেশিদিন হয়নি তিনি জেফরিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। অত্যন্ত তিক্ত সম্পর্কের বহিপ্রকাশ ঘটল। শুরু হল ব্যায়বহুল মামলা মোকদ্দমা। উপরন্ত ডিজনির অ্যানিমেশন বিভাগে নানান ধরণের ত্রæটি-বিচ্যুতি বেড়িয়ে আসল। পরবর্তী কয়েক বছর এ বিভাগের ব্যার্থতার বোঝা ক্রমাগতভাবে বাড়তে শুরু করল। হারকিউলিস, আটলান্টিস, ট্রেজার প্লানেট, ফ্যান্টাসিয়া ২০০০, ব্রিদার বিয়ার, হোম অন দ্যা রেঞ্জ, এবং চিকেন লিটিল এগুলো সবই ব্যার্থতার পাল্লা ভারী করে। দ্যা হাঞ্চব্যাক আব নটের ড্যাম, মুলান, ট্যারজেন এবং লিও এন্ড স্টিচ ছবিগুলো হালকা সফলতার মূখ দেখেছিল। কিন্তু কোনটিই আগের দশকের মতো সৃজনশীল সফলতা বা বাণিজ্যিক সফলতার কাছাকাছিও যেতে পারেনি। মাইকেলের জ্ঞান, সিদ্ভান্ত গ্রহণের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার কারনে পিক্সারের সাথে ডিজনির একধরণের সখ্যতার সৃষ্টি হয়, ফলে বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ অ্যনিমেশন সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়। (চলবে)