মণিজিঞ্জির সান্যাল : যে কোনো সম্পর্কে ছোট ছোট জিনিসেই খুশির বীজ লুকিয়ে থাকে। কথাটা একশ শতাংশ সত্যি। আর আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অজান্তেই এই মুহূর্তরা আমাদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। শুধু একটু বুঝে নিতে হয় বা অনুভব করতে হয়। সত্যিকারের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে মূলত সততার ওপর নির্ভর করে। ভালোবাসা শব্দটি বড্ড নরম, বড্ড স্নেহে ভরপুর। একে তুলতুল করে যত্নে এবং আদরে ধরে রাখতে হয়, আবার মায়ের মতো মাঝে মাঝে শাসনও করতে হয়। আর এই নরম অথচ মূল্যবান বিষয়টিকে যত্নে লালন করার জন্য প্রয়োজন সততা। ভালোবাসার এই নরম আবেগী বিষয়টিকে অনেকেই বলেন “সম্পর্ক…”

আর “স্বচ্ছতা” সব সময়েই এই সম্পর্ককে ভাল ও মজবুত রাখতে সহায়তা করে। দূরে থাকলে সেই স্বচ্ছতা বজায় রাখার দায়িত্বটা আরও দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়ে যায়। সম্পর্ক হলো তুলতুলে আবেগী যা একে অপরকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। এই সম্পর্কের অস্তিত্ব সারা পৃথিবী জুড়ে। সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এটি লক্ষ্য করা যায়। আমরা এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একটা সূ² সম্পর্কের মধ্যে চলাফেরা করি। প্রকৃতির সঙ্গে যেমন আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আমাদের অজান্তেই তৈরী হয়, তেমনি প্রকৃতি সবসময় তার কোলে আমাদের স্থান দিয়ে তার স্নেহ আদরে আমাদের মনকে ভরিয়ে রাখে, আমাদের প্রাণে স্নিগ্ধতা জোগায়, আর সেটা হয় খুবই নিশ্চুপে। মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তার রক্ত মাংস দিয়ে গড়ে তোলে এক জ্যান্ত মানুষকে, যা একটি সুন্দর সম্পর্কের ফলেই গড়ে ওঠে। বাবা আমাদের তার আঙ্গুল ধরেই এক-পা দু-পা করে হাঁটতে শেখায়, প্রথম কথা বলতে শেখায়, যার নিটোল রূপই হল এই সম্পর্ক। প্রাণের কথা খুলে বলার জন্য আর এক প্রাণের খোঁজ চলে এবং যে হাত বাড়ায় তা হল “বন্ধুত্ব” নামক একটি অটুট সম্পর্ক।

নিজের সবকিছু উজার করে দিয়ে একে অপরের কাছে নিজেকে নিবেদন হল “প্রেমের” সম্পর্ক। সেই ভালোবাসার মানুষটির নাম নিভৃত যতনে লিখে রাখা, এরই নাম-ই হল প্রেম। যেমন, অকারণ খুনসুটি, চুল টানাটানি, একে অপরকে দোষারোপ করার সেই মিষ্টি সম্পর্ক হল ভাই-বোনের সম্পর্ক। কিন্তু কেন এই সম্পর্কগুলির মধ্যে ছেদ ঘটে অকারণে? তার কারণগুলি কি হতে পারে? আসলে মানুষ একে অপরের কাছে তেমন বড় কিছু আশা করে না, ছোট ছোট জিনিসেই খুশির বীজ লুকিয়ে থাকে। আমরা অনেক সময় ছোট ছোট জিনিসগুলি অগ্রাহ্য করে থাকি, ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুমধুর সম্পর্কগুলি ভেঙে যাওয়ার দিকে এগোতে থাকে। কয়েকটি বিশেষ দিকের প্রতি আমরা যদি নজর দেই, তাহলে হয়তো সম্পর্কের ভীত মজবুত হবে।

প্রথমেই ধরা যাক সততার কথা :
যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে সততার ওপর নির্ভর করে। আমরা কখনোই চাই না যে কেউ আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করুক। তাই আমাদেরও উচিত অন্যের বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়া। কোনো সম্পর্কের মধ্যে যখন সততা নিয়ে টানাপোড়েন দেখা যায় তখন সম্পর্কের মধ্যে ছেদ পড়তে শুরু হয়। তাই আমাদের সততা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে, তাতেই সম্পর্ক সুন্দর হবে।
তাছাড়া মাঝে মাঝে অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত।

আমরা অনেক সময় মনের কথা মনের ভেতরে-ই রেখে দেই। আমরা ভাবি আমাদের উল্টো দিকের মানুষটি হয়তো এমনিতেই সব বুঝবে। ফলে অনেক সময় দেখা যায় আমরা সামনের জনের থেকে বা আমাদের উল্টোদিকের মানুষটির থেকে যা আশা করছি শোনার জন্য তা আর শোনা বা না বলাই থেকে যায়। আমাদের উচিত দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ভেতরের অনুভূতিগুলিকে প্রকাশ করা। বাবা-মা’কে বলা তাদের জন্য আমাদের হৃদয়ের অনুভূতি কী? সন্তান, স্বামী-স্ত্রী সকলের সামনে আমার হৃদয়ে তাদের স্থান কী, আমি কতটা তাদের জন্য ভাবি, কতটা স্নেহ বা সন্মান করি তাদের, রোজ সেটা বলা উচিত। কারণ আমরা সকলেই অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চাই। এই প্রবণতা ছোট বড় সকলের মধ্যেই দেখা যায়। তাই প্রত্যেকে প্রত্যেকের জীবনে তাদের গুরুত্বের কথা স্বীকার করা উচিত, রোজ তাদের সাথে সেই সুন্দর অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়া উচিত।

তৃতীয়ত, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সুন্দর মুহুর্ত কাটানো। আমাদের এই জীবন আর কিছুই না, শুধু সুন্দর কিছু মুগ্ধকর ও মধুর স্মৃতির সমাবেশ মাত্র। প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যেই একসঙ্গে সুন্দর মুহূর্ত কাটানো খুবই প্রয়োজন। আজকালকার ব্যস্ত ডিজিটাল যুগে সবাই পাশে থেকেও পাশে নেই। প্রযুক্তির কারণে বেশিরভাগ মানুষ ভার্চুয়াল দুনিয়াতে নিজের জায়গা করে নিতে ব্যস্ত। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই যাদের সঙ্গে কাটাচ্ছেন তাদের ভাল করে জানেন-ই না। অথচ নিজেদের প্রিয়জনরা যারা সব সময় পাশে রয়েছে, তাদের জন্য সময় বের করার কথা অনেক সময় ভাবতে ভুলে যান। ফলে সম্পর্ক গুলি আলগা হতে শুরু করে। রোজ যদি আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সাথে কিছুটা সময় কাটাই, একে অপরের সাথে গভীরভাবে ও খোলাখুলিভাবে যুক্ত থাকি, তাহলে আমাদের সম্পর্কগুলি পুনরায় সতেজ হবে, তাতে প্রাণ ফিরে আসবে। কারণ এই সুখের মুহূর্তগুলি আমাদের জীবনে এতটাই শান্তি দেয় যা জীবনের অন্যতম সফল ক্রিয়া হিসাবে স্মৃতিতে থেকে যায়।

এছাড়া সহানুভূতিশীল হওয়া ভীষণ প্রয়োজন।
আমরা প্রত্যেকেই চাই আমাদের মনের অবস্থা আমাদের প্রিয়জনেরা বুঝুক। আমরা কী চাই, কোনটা আমাদের সত্যিকারের প্রয়োজন? সেটা তারাও অনুভব করুক। যখন দেখি আমাদের ভেতরের অবস্থা তারা বুঝেও বুঝতে চাইছে না বা আমরা বোঝাতে পারছি না, তখন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্ধ তৈরী হয়। তার থেকে শুরু হয় হতাশা, একাকীত্ত। যদি আমরা সম্পর্কের প্রতি নমনীয়তা পোষণ করি, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই, আন্তরিকভাবে অনুভব করতে পারি সামনের জনের পরিস্থিতি এবং তার দিকে আমাদের হাত বাড়িয়ে দেই তাহলে আমাদের মধ্যে একটা ভরসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরী হবে ।

এই সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্বাস বা ভরসা রাখাটাও প্রয়োজন। সম্পর্ক টিকে থাকে বিশ্বাসের বুনন এর ওপর। বিশ্বাস এর সুতো টান লেগে ছিঁড়ে গেলে সম্পর্কের ভাঙন অনিবার্য। তাই সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে একে অপরের বিশ্বাস বা ভরসা রাখা খুবই জরুরি। বিশ্বাসের সত্যিই অসীম ক্ষমতা রয়েছে, বিশ্বাসই পারে একটা সাধারণ সম্পর্কে অসাধারণ সম্পর্কে রূপ দিতে। তাই বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে হবে প্রিয়জনের প্রতি।

পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া। সম্পর্কের উন্নতিকরণের আরেকটি ধাপ হল একে অপরকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রত্যেকের স্বপ্ন বা বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়া। আমরা অনেক সময় দেখে থাকি আমাদের প্রিয়জনদের কিছু স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করি। ফলে তার ভেতরের আঘাত আমরা দেখতে পাই না। এভাবেই সম্পর্কগুলি ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে হৃদয় থেকে। তাই সামনের জনের কোনো বক্তব্য থাকলে মনযোগ সহকারে শুনে তার আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তাহলে সম্পর্কের বাঁধন দৃঢ় হবে।

এছাড়া প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা প্রয়োজন। কখনো কাউকে বন্ধনে বা খাঁচায় বন্দী করে রাখা যায় না, যদি না সে থাকতে চায়। জোর করলে কোন সম্পর্কই টিকে থাকে না। প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যেই একে অপরকে স্পেস বা স্বাধীনতা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। জোর করে নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার ফলে অনেক সম্পর্কেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই সুস্থ সম্পর্কের জন্য পরস্পরের একটু স্পেস প্রয়োজন।

আরো একটা বিষয় সম্পর্ক সুন্দর করার জন্য ভীষণ রকম প্রয়োজন। একে অপরের প্রশংসা করা। আমরা সকলেই নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসি, এটা সত্যিই। আমাদের প্রিয়জনদের মধ্যে যদি কেউ কোন কাজ শ্রদ্ধার সঙ্গে করার চেষ্টা করছে, হয়তো সে সফলতার চূড়ায় এখনও পৌঁছতে পারেনি, কিন্তু তার প্রতিটা পদক্ষেপে যদি আমরা তার প্রশংসা করি তাহলে তার কর্মক্ষমতা দ্বিগুন বেড়ে যাবে এবং তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিশ্বস্ততা আরও বেড়ে যাবে।

এছাড়াও উপহার দেওয়া। ছোট থেকে বড় কে না ভালোবাসে উপহার পেতে। উপহার বলতে বড় বড় সামগ্রী বা বস্তুর কথা বলা হচ্ছে না।

ছোট ছোট জিনিস, ছোট ছোট ক্রিয়াকলাপ একে অপরকে দিলে সকলেই খুশি থাকে। তাই প্রিয়জনদের উপহার দিলে তার মন যেমন খুশিতে ভরে উঠবে, পাশাপাশি কাউকে কিছু দিলে নিজের মনও কিন্তু আনন্দে ভরে উঠবে।

রাল্ফ ওয়ালডো এমারমন বলেছেন, জীবনের সুন্দরতম প্রাপ্তি হচ্ছে আন্তরিকভাবে অপরকে সাহায্য করা। ফলে প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরই সাহায্য করি ।

আরো একটি গুণ আয়ত্ত করলে সম্পর্কগুলো সুন্দর হয়ে ওঠে, তা হলো ক্ষমা করা। সবচেয়ে বড় ধর্ম হল ক্ষমার ধর্ম। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে অনেকেই দীর্ঘদিন যাবত সম্পর্কের প্রাচীরকে করাঘাত করে। অতীতের কোন এক ভুলকে সামনে রেখে বর্তমানের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে নষ্ট করে তোলে। একটা ছোট্ট ক্ষমাই পারে সম্পর্কের যাবতীয় মলিনতা মুছে দিয়ে সেখানে সূর্যের প্রখর রশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটাতে। যা সমস্ত অন্ধকারকে কাটিয়ে প্রাণে আলোর সঞ্চার করতে পারে। তাই এসো ক্ষমা করি একে অপরকে এবং আবার নতুন ভাবে জীবনে পথ চলা শুরু করি। কে জানে কাল আমাদের প্রিয়জনদের ক্ষমা করার সময় পাবো কি না।

আর? আর যত্ন নেওয়া। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সম্পর্ক রক্ষা ও সুন্দর করতে একে অপরকে যত্ন করা কতোটা প্রয়োজন। একটা গাছ সঠিক যত্নের ফলে সুগন্ধ ছড়িয়ে ফুলে ফলে যেমন সুশোভিত করতে পারে, তেমনি সম্পর্কের ভীত মজবুত করতেও যত্নের প্রয়োজন।

সবশেষে একটা শব্দ না বললেই নয়, ত্যাগ করা। এখানে ত্যাগ মানে কোনো কিছু বিসর্জন দেওয়া নয়। Sacrifice কথাটি প্রায়সই ব্যবহার করি সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে। ছোট ছোট Sacrifice বা ত্যাগ আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করে এবং অপরের শ্রদ্ধা ও ভরসা আদায় করে থাকে। সামান্য ত্যাগও সুমধুর সম্পর্কের বৃহত্তর উপহার হয়ে উঠতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে সেই ত্যাগ হবে আন্তরিক, কখনোই তা যেন অহংকারের বিষয় না হয়ে ওঠে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ