Home কলাম যেমন দেখে এলাম কিউবা

যেমন দেখে এলাম কিউবা

খুরশীদ শাম্মী : ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম দ্বীপ কিউবা, যার চারদিকে সমুদ্রের ফিরোজা-নীল নোনা জল। মূলত দু’টো কারণে কেন্দ্রীয় অ্যামেরিকার দেশটিকে দেখার বাসনা ছিল আমার দীর্ঘদিনের। প্রথম কারণ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিপ্লব এবং দ্বিতীয়টি দ্বীপের নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

জীবনের কৃত্রিম প্রয়োজনের চাপ সামলাতে অহেতুক ব্যস্ততা এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক গল্পের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে আমরা, আমি ও আমার জীবনসঙ্গী ম্যাক আজাদ কিউবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই ২০২২ সালের ২৮ জুন। ফ্লাইট বিলম্বের কারণে রাত নয়টার পরিবর্তে এগারোটা ত্রিশ মিনিটে আমরা জুয়ান জি. গোমেজ ভারাদেরো এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। ভারাদেরো কিউবার মাতানজাস প্রদেশের একটি উপক‚লীয় শহর, যেখানে বাইশ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। রাজধানী হাভানা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে ভারাদেরো সৈকতকে কেন্দ্র করেই এই শহর, যেখানে মাত্র দুই হাজার কিউবান বসবাস করে। মূলত সেখানে পর্যটকদের জন্য হোটেল ও রিজোর্ট গড়ে উঠেছে। ইমিগ্রেশন শেষে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ক্যাকটাস (কিউবান উচ্চারণে ক্যাকটুস) পর্যন্ত পৌঁছাতে রাত একটা ত্রিশ মিনিট অর্থাৎ জুন ২৯, ২০২২ সকাল দেড়টা।

এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে কখন পৌঁছালাম সেটা আলোচনার বিষয় নয়, বিষয়টি হচ্ছে গভীর রাতে দীর্ঘ দেড়ঘণ্টা যাত্রা কেমন ছিল? এক কথায় বলতে গেলে খুব কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। পুরোটা সময় আমাদের পর্যটক গাইড ম্যানুয়েলের বক্তব্যে কিউবার বর্তমান অবস্থা ও সরকারের বর্তমান চাহিদা গলাধঃকরণ করলাম। ম্যানুয়েল নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানাশোনা একজন দক্ষ পর্যটক গাইড। গভীর রাতে ঘন আঁধারে ঘুমঘুম চোখে এতটা পথ যেতে খারাপ লাগেনি কেবলমাত্র ম্যানুয়েলের তথ্যবাহী বক্তব্যের কারণে, বরং জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাদের দেশ ও জীবন সম্পর্কে এবং পরবর্তী ভোরের আলোয় যে বিষয়গুলোর মুখোমুখি হবো, সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে। তার ভাষ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ থেকেই তাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছিল, তবে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে তা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে এবং আমদানীকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অপ্রতুলতা লক্ষণীয়। তাদের সরকারের অন্যতম বর্তমান চাহিদা বৈদেশিক মুদ্রা। যেভাবেই হোক বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করার জন্য জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে সরকার। সুতরাং সে বাস ভর্তি পর্যকটদের বিদেশী মুদ্রা পরিবর্তন করে কিউবান পেসো ক্রয়ে শুধু নিরুৎসাহিত করেনি, উপরন্তু খুব প্রয়োজন হলে ব্যাংক থেকে মুদ্রা লেনদেনেও নিরুৎসাহিত করেছে এবং সে অধিক মূল্যে ডলার ক্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শিক্ষিত, হাসিখুশি ম্যানুয়েলের মুখে এমন নীতিবিরুদ্ধ আবদারে অবাক হলেও মূল ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি সেই রাতে।

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে অ্যান্টিক কনভারটেবল গাড়িতে চড়ে শহর ঘুরে দেখার নেশা চাপল আমাদের মনে। ইচ্ছে বলে কথা। সকাল সকাল মূল্যায়ন করলাম বিনাবাক্যে। আমাদের গাড়ির চালক রুমেন ভারাদেরো ঘুরে দেখালো মাত্র দুই-ঘণ্টায়। ছাদ খোলা গাড়িতে মুক্ত হাওয়ায় রোদের তেজ বিরক্ত লাগেনি, বরং উপভোগ করেছি প্রকৃতির সবুজ ও নীলের মেলবন্ধন। পথের দু’ধারের সারি সারি কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া, নারিকেল, আম, রঙ্গনসহ বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছগুলোকে মনে হয়েছে খুব আপন। সরু পাম গাছগুলোকে কখনো সুপারি গাছ মনে হয়েছে। ওখানে বেড়ে ওঠা বিশালাকার বিভিন্ন প্রকার ক্যাকটাস ও তাদের ফুল আমাকে অভিভূত করেছে। ঘুরতে ঘুরতে যখন পৌঁছালাম শহরের ডাউন-টাউনে, জনমানবশূন্য ডাউন-টাউন দেখে হৃদয় গহীনে বেহালার একাকিত্বের সুর বেজে উঠল। রেস্তরাঁগুলো ফাঁকা, শপিংমলগুলো নীরব। পরিষ্কার পথঘাট। ঠাঠা রোদ্দুরেও উন্মুক্ত শুঁড়িবাড়িগুলো। সেখানেও ক্রেতা নেই। নীরবতা বেধ করে গেলাম একটি শপিংমলে। তেরপলের ছাউনি দেওয়া মলটি অনেকটা এখানকার ফ্লি-মার্কেটের মতো। ফাঁকা মার্কেটে কিছুটা ঘোরাঘুরির পর এক দোকানির কাছে আমি একটি কাঠের মালার মূল্য জানতে চাইলাম। বিক্রেতা বলল, “দশ পেসো”। আমি অন্যকিছু যোগ করার উদ্দেশে নজর পাল্টালাম। একটি কাঠের মুখোশ পছন্দ হলো। আমি ওটার মূল্য জিজ্ঞেস করলাম। বিক্রেতা স্প্যানিশ ভাষায় তার পুরুষ সহকর্মীর সাথে আলাপ শেষে বলল, ‘পঁচাত্তর ক্যানাডিয়ান পেসো।’ ক্যানাডিয়ান পেসো- বিষয়টি আমাদের উভয়কে কৌতুহলি করে তুলল। পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমি মালার মূল্য পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম। সে এবার উত্তর দিলো, “দশ ক্যানাডিয়ান পেসো।” আমি প্রশ্ন করলাম, “আমি যদি কিউবান পেসোতে মূল্য দিতে চাই, তবে কত দিতে হবে?” সে আবারও পুরুষ সহকর্মীর সহযোগিতা নিয়ে বলল, “এক হাজার পেসো।” আমি কেন যেন হাসি সংবরণ করতে পারলাম না, বোকার মতো ফিক করে হেসে ফেলেছি। সাথে সাথে বিক্রেতা বলল, ‘সাত শত পেসো ফাইনাল’। বিষয়টি আমাদের দু’জনার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেলো যে তারা ক্যানাডিয়ান ডলারের বাজারদর সম্পর্কে অবগত নয়। এরপর ভিন্ন ধাঁচের প্রশ্ন করলাম, ‘আমি যদি অ্যামেরিকান পেসো দেই?’ বিক্রেতা যা উত্তর দিয়েছিল, তার সারমর্ম হচ্ছে যে ক্যানাডিয়ান, অ্যামেরিকান, ইউরোপিয়ান সকল মুদ্রায় মূল্য একই। আমরা খানিকটা নীরব থেকে চলে এলাম। এই অভিজ্ঞতা শেষ করে নিজেদের জন্য জল ও কিছু বৈকালিন নাস্তা ক্রয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করলাম আমাদের গাড়ির চালক রুমেনকে। সে আমাদের নিয়ে গেলো হারবার ফ্রন্টের একটি সুপার মার্কেটে। দোকানের ফাঁকা শেলফগুলো অভাবের প্রতীক হয়ে মনে দাগ কাটল। সেখানে ছিল কিছু কালোবিন, পাসতা, নুডুলস, চাল, কফি, তামাক ও শিশুদের ডাইপার জাতীয় দ্রব্যসামগ্রী। ওখান থেকে পানি কিনতে গিয়ে পড়লাম ভিন্ন সমস্যায়, মূল্য পরিশোধ করতে দরকার কিউবান কার্ড। সুতরাং রুমেনের সহযোগিতা প্রয়োজন হলো।

দুইঘণ্টা ঘোরাঘুরি শেষে রিজোর্টে ফিরে তপ্ত বালু পেরিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে ডুবিয়ে গোসল যতটা আরামদায়ক লেগেছে, তার থেকেও অধিক ভালো লেগেছে বাগানে আম ও নইল (অরবরই) গাছ দেখে। কিছুক্ষণের জন্য ফিরিয়ে আনলাম আমাদের শৈশব। লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁচা আম ও নইল ছিঁড়ে খেয়ে মনকে শুধালাম, এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?

রাজধানী হাভানা ভ্রমণ ছিল অনেকটা ভেলায় ভেসে দীর্ঘদিন বাদে নানা বাড়ির গ্রাম ঘুরে দেখার মতো। যা দেখি তা-ই মনে হয় অনেক চেনা-জানা, ধুলোপড়া স্মৃতির মাঝে চকচক আলোর ধারা। হ্যাঁ, কিউবার রাজধানী হাভানা ভ্রমণের দিনও আমাদের গাইড ছিল ম্যানুয়েল। পুরোটা পথ সে কিউবার ইতিহাস নিয়ে কথা বলছিল। ম্যানুয়েলের কিউবান ইতিহাস আলোচনায় যে বিষয়টি আমার ভালোলেগেছে, তা হলো, একদম গোড়াপত্তন থেকে অর্থাৎ ক্রিস্টোফার কলম্বাস কিউবা পৌঁছানোর পরপরই কিউবাকে স্পেনের অধীনস্থ এলাকা বলে দাবী করা ও গহিন সমুদ্রে বহু সংখ্যক আদিবাসীদের হত্যা করার ঘটনা থেকে শুরু করে বিপ্লবের বীজবপনকে জোরালো করে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। বিপ্লব আলোচনা সূচনায় তার প্রথম বাক্য ছিল, কিউবার ‘ফাদার অফ দ্যা হোমল্যান্ড’ কার্লোস ম্যানুয়েল দে সেসপেদেস ১৮৬৮ সালে তিনি তার ক্রীতদাসদের মুক্ত করে স্পেন শাসন থেকে কিউবাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিলেন এবং স্পেনের বিরুদ্ধে প্রথম দশ বছরের যুদ্ধ সূচনা করেছিলেন। তার আলোচনায় বাদ যায়নি অন্তত আমার জানা কোনো নেতার নাম, বরং যোগ হয়েছে কিছু নাম ও বিষয়। সবার অবদান সে উল্লেখ করেছে। বলতেই হয় যে ম্যানুয়েল আমার মনে আরেকবার গেঁথে দিয়েছে কিউবান ইতিহাস। হাভানার পুরানো বাড়িঘর, এপার্টমেন্ট দেখে মনে হয়েছে আমার শৈশবে দেখা ঢাকা শহর। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই, আছে কিছু অ্যান্টিক গাড়ি। তবে, ওগুলোর গায়ে ব্রান্ড-লোগো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চায়না-টাউন আছে, কিন্তু চাইনিজ নেই। দোকানপাটও কম, তবে পর্যটকদের জন্য কার্টে করে নারিকেল, আম বিক্রেতা আছে, আছে নকল সিগার বিক্রেতা। অধিকাংশ বাড়ির নীচের তলায় গড়ে উঠেছে হস্তশিল্প সমগ্রীর দোকান। নানান সাজে সেজে বিভিন্ন বয়সের নর-নারী ঘুরে বেড়ায়, ছবি তোলে পর্যটকদের সাথে, বিনিময়ে অর্থ দাবী করে কখনো। ক্যাপিটাল বিল্ডিং, মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং, সেন্ট্রালপার্ক, বিশিষ্টজনের ভাস্কর্য পরিদর্শন শেষে পৌঁছে যাই রেভলুশন স্কয়ারে, যেখানে কিউবার ইতিহাসের অন্যতম নেতা হোজে মার্টি’র ভাস্কর্য, চারদিক ঘিরে মন্ত্রণালয়, সরকারি অফিস, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, ইত্যাদি। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই নজর কেড়ে নেয় দু’টো ইস্পাতের ভাস্কর্য, যার একটি ক্যামিলো সিয়েনফুয়েগোস’র যা’তে লেখা ‘Vas bien Fidel’ শ্লোগান, অর্থাৎ ‘তুমি ভালো করছ, ফিদেল’ এবং অন্যটি চে গেভারা’র যা’তে আছে ফিদেল কাস্ত্রোকে তার লেখা এক চিঠির একটি লাইন, ‘Hasta La Victoria Siempre’, যার আভিধানিক অর্থ করা কঠিন; ভাবার্থ হবে হয়তো, জয় পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা। ওখানে দাঁড়িয়ে ম্যানুয়েল যখন বলল যে এই সেই স্থান যেখানে ফিদেল কাস্ত্রো দীর্ঘ পাঁচঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছেন এবং মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা শুনেছে, তখন আমার ভেতরটা কেন যেন শিহরিত হলো। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ওইদিনই আমার কিউবা ভ্রমণ সার্থক হলো। আরো কিছুক্ষণ ডাউন-টাউন ঘুরে ভাসমান রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ শেষে ফিরে এলাম হোটেলে।

দেখার নেশা অনেকটা প্রেমের মতো, একবার অন্তর ধরলে আর ছাড়ে না। পরেরদিন খুব ভোরে কিউবার গ্রাম ও খামার দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সেদিন আমাদের গাইড ছিল সিনডি। সে প্রকৃতি দেখাতে নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করেনি এক তোলাও। অবশ্য সুযোগও ছিল না, কেননা সে ছিল ভিন্ন গাড়িতে। তার গাড়ি অনুসরণ করে আমরা আমাদের নিজেদের গাড়ি চালিয়ে শহর, উপশহর, গ্রাম পারি দিয়েছিলাম। পথে বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে সমুদ্রের নোনা জলে স্নান, নৌকা ভ্রমণ, জল পান সেরেছি। গ্রামের পথের ধারে শিশু, কিশোরদের উপস্থিতি ও হাত নেড়ে চলন্ত গাড়ির যাত্রীদের অভিবাদন জানানো বিষয়টি আমাকে আরো একবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে। উড়োজাহাজের শব্দ পেলেই দলবেঁধে ছুটে যেতাম ঘরের বাহিরে, এছাড়াও আমাদের শহরে কোনো বিশেষ অতিথির আগমনে আমাদের স্কুল ইউনিফর্ম পরে রাস্তার দু’পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো এবং যখন অতিথিদের গাড়ি যেত, আমরা পতাকা ও হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতাম। ফার্মের গাছ থেকে পেড়ে আনা আম, আখ, কলা, নারিকেলের স্বাদ যতটা মিষ্টি ছিল, তার থেকেও সুস্বাদু ছিল ফার্মের খোলা রেস্তরাঁয় বসে দুপুরের খাবার গ্রহণ। রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে কালো-বিনের ভাত, ভাজা ডিম, খোসাসহ সেদ্ধ মিষ্টি-কুমড়ো অমৃত লেগেছে। তবে, গহিন গাঁ পর্যন্ত পৌঁছেও আবাদি জমিগুলো অলস পড়ে থাকতে দেখে মন খারাপ হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে।

নেতিয়ে পড়া সূর্যালোকে ভারাদেরো শহরের পথ ধরে আমাদের ঘোড়া চালিত ট্যাক্সি ভ্রমণ ছিল বেশ আনন্দদায়ক, যদিও চালক এলিয়াদের সাথে কথোকথপনে মন খারাপ হয়েছিল বেশ। আমার এক প্রশ্নের উত্তরে সে উল্লেখ করেছিল, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কথা বলার অধিকার নেই। অধিকাংশ নাগরিক সমাজতন্ত্র পছন্দ করে না আর। তার মতে সমাজতন্ত্রের কারণে দেশের ও জনগণের উন্নয়ন হচ্ছে না তেমন। তবে জীবন চলে যায় তা’তেই তারা খুশি।

হ্যাঁ, পাঁচদিন সেখানে অবস্থান কালে প্রতিটি বিষয়ের সাথে আমি প্রথম রাতে ম্যানুয়েলের বক্তব্য ও ট্যাক্সি চালক এলিয়াদের মন্তব্যের মিল পেয়েছি। সাম্যবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রেশন ভিত্তিক সাধারণ মানুষের জীবনযাপন আমাকেও আন্দোলিত করেনি। বরং কিছুটা হলেও আহত করেছে। সেখানে দরিদ্র সীমা চরম পর্যায়ে, একদম আকাশ ছোঁয়া। মনে হয়েছে, সাধারণ জনগণ এক একটি কাঠের পুতুল। মাসিক সাড়ে তিন হাজার পেসো ভাতার বিনিময়ে তারা সরকারের ইচ্ছার চাকর। তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে পর্যাপ্ত আয় না হওয়ায় অধিকাংশ নাগরিক সরকারের বাধ্যবাধকতার বাইরে অলস জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নিয়েছে এবং তারা তা’ উপভোগও করে।

কিউবায় পড়াশোনা ও চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। হাইস্কুল শেষে মিলিটারী ট্রেনিং বাধ্যতামূলক, বিশেষ করে পুরুষদের। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের গণিত, ইতিহাস ও ট্র্যাডিশনাল স্প্যানিশ পরীক্ষায় অবশ্যই উত্তীর্ণ হতে হয়। কিছুদিন পূর্বেও কিউবায় ইন্টারনেট ব্যবহার ছিল অত্যন্ত কম। কেবল সরকারি অফিস-আদালতেই ব্যবহৃত হতো ইন্টারনেট। বর্তমান সরকার জনগণের দাবীতে ইন্টারনেটসহ অন্যান্য কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে কিছুটা সহজ করে দিয়েছে তাদের জীবনযাপন ও আধুনিকায়ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারতের মতো কিউবায় গরু হত্যা মহা-অপরাধ। সেখানে গরু পালন ও খামার করার অনুমতি থাকলেও গরু জবাই করার অনুমতি নেই জনগণের। গরুর মালিক কেবলমাত্র গরুর দুধ বিক্রি করার অনুমতি পায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই ক্রেতা, কেননা সেখানে সাত বছর পর্যন্ত প্রতিটি শিশুকে দৈনিক বিনামূল্যে এক লিটার দুধ দেওয়া হয়। কেউ গরু জবাই করে চোরা বাজারে মাংস বিক্রি করে ধরা পড়ে গেলে তাকে পঁচিশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ সেখানে খুনির শাস্তি দশবছর কারাবাস। তবে খাদ্য চাহিদা মেটাতে গরু জবাই করে গরুর মাংস বিক্রি করার অধিকার কেবল সরকারের।

কিউবা নিকেল, জ্বালানি তেল, চিনি, তামাক, ইত্যাদি রফতানি করলেও তাদের আমদানি করতে হয় প্রধান খাদ্যের অধিকাংশই। যেমন চাল, আটাসহ অন্যান্য খাদ্য। অথচ সরকারের উৎসাহের অভাবে মাইলের পর মাইল ফসলী জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে রয়েছে। পরিশ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য আয়ের সুযোগ না থাকায় ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ চাষাবাদ করে না, এমনকি রাষ্ট্রের সাথে অংশীদারি চাষাবাদ বাণিজ্যেও জনগণ খুব একটা আগ্রহ দেখায় না।

কিউবার সাধারণ জনগণের অধিকাংশ নিরাহংকারী, নিরীহ, ভালো মানুষ। দরিদ্রতার সাথে তুলনা করলে অপরাধ সেখানে অনেক কম। কঠিন দরিদ্রতার সাথে লড়াই করতে অনিচ্ছুক নতুন প্রজন্মের মানুষেরা স্বপ্নের দেশ অ্যামেরিকায় পালিয়ে যাচ্ছে এবং কিউবার সাথে অ্যামেরিকার রাজনৈতিক জটিল সম্পর্ক উপেক্ষা করে তারা তাদের পরিবারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিউবান বর্তমান সরকার বিষয়টিকে ইতিবাচক ভেবে নাগরিকদের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাংক-একাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছে এবং তাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য শহরে শহরে বিশেষ প্রকারের দোকান খুলেছে, যেখানে বিদেশী পণ্য বিক্রি হয়; তবে সকল লেনদেন কেবলমাত্র কার্ডের মাধ্যমে করা হয় যেন সরকার প্রতিটি লেনদেনের হিসাব রাখতে পারে। এই সুযোগে নাগরিকেরাও সকল-পর্যায়ে পর্যটকদের সাথে সকল লেনদেন, এমনকি বকশিশেও বৈদেশিক মুদ্রা দাবী করে। কোথাও কোথাও পর্যটকদের জন্য পণ্যের মূল্য অ্যামেরিকান ডলারে নির্ধারিত থাকে। আমার দেখা কিউবা পর্যটন নির্ভর এমনই একটি দেশ, যে-দেশে সামান্য জলের বিনিময়েও স্বদেশের মুদ্রা পেসো প্রত্যাখিত হওয়ার ঘটনা আছে। ছোটছোট লেনদেনে স্বদেশের মুদ্রা প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতার মাঝে আমি দেশপ্রেম খুঁজে পাইনি, বরং অভাব ও লোভ দেখেছি। সরকারের কারণে নাগরিকদের কাছে যখন নিজ দেশের মুদ্রার মূল্য থাকে না, তখন পুরো বিষয়টিকে সরকারের ভণ্ডামি বলে মনে হয় আমার। যে অ্যামেরিকা তাদের চক্ষুশূল, সেই দেশের মুদ্রাই তাদের ঘরের প্রধান ল²ী- বিষয়টি কিছুটা হলেও রসাত্মক।
সর্বশেষে বলতেই হয়, কিউবার রিজোর্টগুলোতে পর্যটকদের জন্য খাবার ও পানীয়তে ভরপুর থাকলেও রিজোর্টের বাহিরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার নাগরিকদের মৌলক চাহিদাগুলো মেটালেও অলস করে তুলেছে তাদের, একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করেছে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্বপ্নগুলোর ডানা ভেঙে নির্ভরশীল করে তুলেছে। ওইদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন চে গেভারা’র মতো একজন ভিনদেশী নাগরিক এসে কিউবায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো কিউবান কোনো সাহসী যুবকের খোঁজ করবে।

Exit mobile version