ভজন সরকার : নিজের মায়ের পেটের ভাই যে তাকে কিছু না বলেই চলে যাবে ঘুণাক্ষরেও তা ভাবতে পারেনি যুগল কাপালি। বরাবরের মতোই ক্লান্ত শরীর নিয়েই ঘুমাতে গেছে গতকাল রাতে। নিশিকান্দির মাঠ থেকে ফেরার পথেই অন্ধকার নেমে এসেছিল। মাথায় ঘাসের বোঝা। বাড়ি থেকে অনেকটাই পথ নিশিকান্দির মাঠ।

অন্ধকার রাত। পূর্ণিমা গেছে বুধে বুধে সাত দিন। ফাল্গুন মাস। শুকিয়ে থাকা মাটির চাকা সাদা হয়ে পড়ে আছে মাঠ জুড়ে। যে দিকে চোখ যায় চাষ করা মাটির ঢ্যালার সাদা রংয়ে পুরা মাঠকেই মনে হচ্ছে শুকনো সমুদ্র। তাই যুগল কাপালির এতোটুকু অসুবিধে হয় নি অন্ধকারে পা চালাতে। বরং অনেক তাড়াতাড়িই বাড়ি চলে এসেছে যুগল কাপালি।
সামনে পুকুরের এক পাশে ঘাসের বোঝা নামিয়ে প্রতিদিনের মতো পুকুর থেকে পা ধুয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকছে। ঘাস কাটার কাঁচি বাঁশের বেড়ার সাথে গুঁজে দিয়েছে বাড়ি এসেই। বাড়ির গরুগুলো মশার উত্পাতে অস্থির হয়ে সারাক্ষণ লেজ নাড়ছে। যুগল কাপালিকে দেখেই গরুগুলো হাম্বা হাম্বা ডাকছে। তাই গরুগুলোকে গোয়াল ঘরের মশারীর ভিতর ঢুকিয়ে দেবে এমন সময় মালতি কাছারি ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

মালতি যুগল কাপালির বউ। মালতির হাতে কেরোসিনের কুপি। যুগল কাপালি ভাবলো মাঠ থেকে ফিরতে দেরি দেখে আগুন জ্বালিয়ে মশা তাড়াতেই এসেছিল মালতি। তাই কাছে এসে বললো, “গরুগুলোকে একেবারে গোয়াল ঘরেই ঢুকিয়ে দিই। কি বলো?”

মালতি কোন উত্তর দিলো না। যুগল কাপালিকে অনেকটাই সমীহ করে চলে মালতি। বিশ বছর সংসার করেও একটা সন্তান জন্ম দিতে পারেনি মালতি। সে দুঃখবোধ তো আছেই।
এমনিতেও একটু চুপচাপ স্বভাবের মালতি। কথাও খুব কম বলে। মালতির উঁচু গলা শুনেছে এমন কথা পাড়া-পড়শিরা কেউ বলতে পারবে না। যুগল কাপালির সংসারে এসে মালতির কন্ঠ যেন আরও ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়ে গেছে।

যখন একান্নবর্তী সংসার ছিল, যখন শাশুড়ি বেঁচে ছিল, তখন এই বাজা বউ নিয়ে অনেকেই কথা বলতো। বছর দশেক হলো শাশুড়ি শরীর রেখেছে। দেবরও মায়ের মৃত্যুর পরে জমি-বাড়ি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। তাই সন্তান জন্মানোর অক্ষমতা নিয়ে কথা শোনানোর কেউ তেমন নেই। অনেক আগে যুগল কাপালি ঝগড়ার সময় রাগ করে মালতিকে খোটা দিয়ে অনেক কথা বলতো।

“যে মাগির সন্তান পেটে নেবার খেমতা নেই, সেই অপয়ার সাথে সংসার করলে তো সংসারে আয় উন্নতি হবেই না।” এরকম কথা এক সময় খুবই স্বাভাবিক ছিল যুগল কাপালির মুখে।
প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো মালতির। একবার অভিমানে ধানের পোকা মারার বিষ খেয়েও ফেলেছিল। গলায় কলার থোর ঢুকিয়ে তেঁতুল গোলা জল দিয়ে বমি করিয়ে রক্ষা পেয়েছিল সে যাত্রায়। মরতেও যে এতো কষ্ট তা ভেবে পরে আর মরার ইচ্ছে জাগেনি মালতির। আশ্চর্য হয়ে মালতি দেখেছে, বিষ খাওয়ার পর থেকে যেন যুগল কাপালি বদলে গেছে। মানুষটা আর কোনোদিন মালতিকে সন্তান জন্মাতে না পারার জন্য খোটা দেয়নি ।

যুগল কাপালির এই পরিবর্তন তখন অনেক চিন্তায় ফেলেছিল মালতিকে। তবে কি মানুষটা অন্য কোনো ধান্ধা করছে? আবার বিয়ে করবে? নাকি অন্য কোনো মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়েছে যুগল কাপালি? এই দশ বছরে অন্তত মাসে একবার করে যে মানুষ গায়ে হাত দিতো,চড়-ত্থাপর তো ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা, সেই মানুষ এতো ভালো হয়ে গেল? মালতির প্রায় এক বছর লেগেছিল যুগল কাপালির এই পরিবর্তন বুঝতে।

স্পষ্ট মনে আছে । বুধবার থানা সদরের হাট থেকে সেদিন বিকেল থাকতেই ফিরে এলো যুগল কাপালি। থানা সদরের হাসপাতালে জ্ঞাতিবংশের এক ডাক্তার বদলি হয়ে এসেছে মাস ছয়েক হলো। সেই ডাক্তারের কাছেই মালতির সন্তান না-হওয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছিল দু’জনেই। মাস দুয়েক ডাক্তার বাবুর পরামর্শে মাসে নির্দিষ্ট দিনে স্বামীর সাথে থেকেছে মালতি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

ডাক্তার বাবু জেলা সদরে দুজনকেই কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক আগে করা সেই টেস্ট নিয়ে কথা বলবে বলেই তো সকালে যুগল কাপালি বলে গেল। কী এমন হলো যে বিকেলে বাড়ি ফিরেই যুগল কাপালি থ মেরে বসে আছে? কিছুই বলছে না। মালতি সাপ্তাহিক হাট থেকে অনেক কিছু কিনে আনতে বলেছিল। সে সব জিনিসের কিছুই আনে নাই। বেশ ক’বার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায় নি মালতি। পরে আর কথা বাড়ায় নি।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে রান্না ঘরে খাওয়ার সময়েও কিছু বললো না যুগল কাপালি। পা ধুয়ে একটু আগেই বিছানায় চলে গেল। মালতিও বাসনপত্র হাড়ি পাতিল মেজে গুছিয়ে শোবার ঘরে গেল।
কেরোসিনের কুপি নিভিয়ে গা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বুঝলো যে যুগল কাপালি তখনও ঘুমায়নি।
অন্যদিন হলে মালতিকে হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকের উপর উঠিয়ে নিতো। শক্ত সামর্থ হাতের শক্তিতে মালতির কোন আপত্তি টিকতো না।
আজকে যুগল কাপালি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতায় কিছুটা ভয় পেয়েই গেল মালতি। নিজেই আগ বাড়িয়ে যুগল কাপালির শরীরের উপর হাত রেখে বললো, “কী হয়েছে তোমার? হাট থেকে এসেই এমন ধুম মেরে আছো? ডাক্তারবাবু কিছু বলেছে?”

হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলছে না যুগল কাপালি। আবারও মালতি একই কথা জিজ্ঞেস করলো, “আমার কোন অসুবিধে? আমি আর মা হতে পারবো না? ডাক্তারবাবু তাই বলেছে? আমি জানতাম আমারই পেটের দোষ। এই পেটে আমি কোনোদিনই সন্তান রাখতে পারব না। আমি জানি, তুমি এই কথাটিই বলতে পারছো না। বলো, আমাকে না রাখলে আমি কোথাও চলে যাব। আর না হলে মরে যাব। এই মুখ আর কাউকেই দেখাবো না।”

মালতির কথা থামতেই হঠাত শুনতে পেল যুগল কাপালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মালতির আর বুঝতে বাকী রইল না যে, ডাক্তারবাবু খুবই খারাপ রিপোর্টের কথা বলেছে। মালতি নিজেই যুগল কাপালির গা থেকে হাত সরিয়ে নিল।
একটু পরেই যুগল কাপালি মালতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগালো, “বউ আমাকে মাফ করে দাও। আমি বছরের পর বছর অন্যায় করেছি। তোমার শরীরে হাত তুলেছি, তোমাকে বকাবকি করেছি। কিন্তু সব দোষ আমার। ডাক্তারবাবু বললেন, আমার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই।”
ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল মালতি। যুগল কাপালির কান্না ছাড়া আর কোন শব্দ নেই ঘরে। সমস্ত নিরবতা ভেদ করে মালতির বুকের ধকধকানির শব্দ শোনা গেল।

অনেকক্ষণ পরে মালতি বললো, “তুমি এমন করছো কেন? সমস্যা তো আমারও হতে পারতো। আমার সমস্যা ধরা পড়লে তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে? শুধু তুমি থাকলেই হলো। এই পৃথিবীতে আমি আর কাউকেই চাই না।”

সে রাতে অনেকক্ষণ যুগল কাপালি আর মালতির ফিসফিসানির শব্দ শোনা গেল। তারপরে অনেক রাতে যুগল কাপালির ঘর থেকে নানা আওয়াজ আসতে লাগালো। বোঝা গেল মালতিই আজ মুখ্য ভূমিকায়।
সে রাতের পর থেকেই যুগল কাপালি বদলে গেল। পাড়াপড়শিরা কেউ আর মালতিকে মারধরের আওয়াজ শুনতে পায় না। মালতি যেন যুগল কাপালির অন্তরাত্মা হয়ে গেল ডাক্তারবাবুর সেই রিপোর্টের পরেই।

যুগল কাপালির আসল চেহারা ভাবে আর মালতি মনে মনে হাসে। আজ যদি মালতির দোষেই সন্তান না হতো , তবে এ বাড়িতে থাকা সম্ভব হতো কি? মানুষ বড় আজব জীব। নিজের দোষ ধরা পড়লেই মানুষ যেন ভেজা বেড়ালের মতো শান্ত-সুবোধ হয়ে যায়। আর অন্য সময়ে যেন বনের রাজা সিংহ।
এতো বছর পরে মালতি সব ভুলে গেছে। দেবর অমূল্যর ঘরে দু’টো সন্তান এসেছে। প্রচন্ড মন খারাপে ওদের সাথেই সময় কাটায় মালতি। যুগল কাপালিও ভাইয়ের সন্তান দু’টোকেই আদর যত্ন করে। পূজা-পার্বনে জামা-কাপড় কিনে দেয়। বাড়িতে ভালো রান্না হলে অমূল্যর পরিবারকেও বলে।

যুগল কাপালির ভাইয়ের প্রতি অসীম দরদ। অমূল্য আর তার বউ নমিতার যেন ঠিক বিপরীত। বিশেষ প্রয়োজন না হলে দাদা-বৌদির খবর নেয় না। একান্নবর্তী পরিবার থেকে দুই ভাই যখন পৃথক হয়ে গেল, সে সময়েও ভাগাভাগির সময়ে বাড়ির ভালো ঘরগুলো অমূল্যই নিয়েছে। জমি বাটোয়ারার সময়েও ভালো জমিগুলো অমূল্যর চাই। সবারই এক কথা যুগল কাপালির সন্তান-সন্ততি নেই। যুগল কাপালি মরে গেলে বারো ভুতে খাবে সহায়-সম্পত্তি।

বছর খানিক আগে অমূল্যর শ্বশুরবাড়ির সবাই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। পাশের গ্রামের অনেকেই চলে যাচ্ছে। কী এক আজব দুনিয়া, যুগল কাপালি ভাবে।
নিজের জন্মভিটে ছেড়ে কাউকে না বলে এমন করে চলে যাওয়া যায়? আগের দিন মানুষটার সাথে দেখা। স্বাভাবিকভাবেই কথা-বার্তা হলো। পরের দিন ভোরে জানা গেল মানুষটা দেশত্যাগ করেছে। পাশের গ্রামের এক মুসলমান পরিবারসহ সেই ঘর-বাড়িতে চলে এসেছে। তিন মাস আগেই নাকি বায়না-বিক্রি হয়ে গেছে। অথচ কাক-পক্ষীও টের পায়নি।

এসব দেখে মালতি আগেই যুগল কাপালিকে বলেছিল, “ অমূল্যর হাব-ভাব কিন্তু ভালো ঠেকছে না। পাশের গ্রামের হিকমত শেখেরে অনেকদিন ওবাড়িতে দেখেছি। আমাকে দেখেই কেমন ফিসফিস করে চোরের মতো কথা বলে।“
যুগল কাপালি পাত্তা দেয়নি মালতির কথায়। “ অমূল্য এমন কাজ করতেই পারে না। অন্তত দেশ ছাড়ার আগে আমাকে বলবে, দাদা চলো আমরা এক্ সাথেই চলে যাই। তাছাড়া জমি বিক্রি করে রেজিষ্ট্রি করতে আমাকে লাগবে ।“
মালতি আর কথা বাড়ায়নি। শুধু বলেছে, “ যে অনাচারের যুগ পড়েছ। ঘুষ দিলে বাঘের দুধ মেলে। আর জমি রেজিস্ট্রি করতে তোমাকে লাগবে? নারায়ণ মুহুরীরে টাকা দিলে নাকি রেজিষ্ট্রি অফিসেও যাওয়া লাগে না, জমির দলিল হয়ে যায়।“
মালতির কথাই ঠিক হলো। আজ সকালে ঘর থেকে দরজা খুলতেই দেখে হিকমত শেখ বউ-বাচ্চা নিয়ে অমূল্যর বাড়িতে উঠছে। যুগল কাপালির নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না।
হিকমত শেখ যুগল কাপালিকে দেখেই বললো, “ দাদা, ভোর রাতে আরিচা ঘাট পার করে অমূল্যকে বেনাপোলের বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসলাম। বাচ্চা দু’টো জেঠা-জেঠি করে কান্না করছিল। আমি অমূল্যকে বলেছিলাম যুগলদাকে ডাক দিয়ে একটু আশীর্বাদ নিয়ে যাও। কিন্তু অমূল্য কথা শুনলো না। সমস্যা নেই দাদা। আমরা দুই ভাইয়ের মতোই পাশাপাশি থাকবো এখন থেকে।

ভোরের আলো তখনো স্পষ্ট ফুটে উঠেনি। হিকমতের শেখের কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেলো না যুগল কাপালি। বারান্দার বাঁশের পাটাতনে বসে পড়ল। সব কিছু ছাপিয়ে তখন অমূল্যর সন্তান দু’টোর কথাই মনে পড়ছিল। মালতি তখনও ঘুমে। যুগল কাপালি ভাবছিল সে কেমন করে মালতিকে বলবে যে, গতকাল রাতে অমূল্য তার পরিবার নিয়ে দেশত্যাগ করেছে।
আজ সন্ধ্যায় নিশিকান্দি মাঠ থেকে ফিরে মালতির ভারী মুখ দেখে যুগল কাপালির বুঝতে আর বাকী রইল না মালতি সব জেনে গেছে।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)