লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র : প্রতারণার ফাঁদ পেতে ফেঁসে গেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার এক প্রবাসী বাংলাদেশি। তার নাম শওকত শামীম। তিনি বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি সংলগ্ন সান্তাক্লারায়। তথ্য-প্রযুক্তি জগতের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সিলিকন ভ্যালীতে ‘ইউপ্লাস’ নামক কোম্পানীর অফিস খুলে সেই কথিত সফ্টওয়্যারের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রেও ধান্দাবাজির আশ্রয় নেন তিনি।
কোকাকোলা, ক্রাফ্ট, নেটফিক্স’র মতো কোম্পানিগুলো ইউপ্লাসের শেয়ার উচ্চমূল্যে ক্রয় করেছে বলে গত বছরের আগস্টে প্রচার করেন শওকত শামীম (৪৯)। ব্যবসায় আগ্রহীদের ফাঁদে ফেলতে শেয়ার বিক্রির পক্ষে ব্যাংকের ভুয়া বিবরণীও প্রকাশ করা হয়। এভাবে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে শওকতের বিরুদ্ধে এফবিআই তদন্তের পর ক্যালিফোর্নিয়া ফেডারেল কোর্টে ১৭ জুলাই মামলা করেছে।
গত ২১ জুলাই শওকত আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সিকিউরিটি এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এর পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, শওকত শামীম কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ৭ বছরে অনেকবারই বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের অর্থ জালিয়াতি করেছেন।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়েছে, তার ক্রেতাদের মধ্যে ফরচুন ৫০০ কোম্পানিও রয়েছে বলে বিনিয়োগকারীদের মিথ্যা তথ্য দেন। এক পর্যায়ে একজন বিনিয়োগকারী যখন এসব দাবি প্রমাণে তথ্যের জন্য চাপ দেন, তখন শামীম জালিয়াতি গোপনের চেষ্টা হিসেবে ওই বিনিয়োগকারীকে ব্যাংকের ভুয়া বিবরণী প্রদর্শন করেন।
সানফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট ফেডারেল কোর্টে ১৭ জুলাই দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, শামীমের প্রতারণা কর্মের সহযোগী ছিলেন ভারতীয় কৃষ্ণাপ্রসাদ নাদিগ। তার নেতৃত্বে ভারতের ব্যাঙ্গালোরসহ কয়েকটি সিটিতে স্থাপিত অফিসে ১২০ জন লোক নিয়োগ করা হয়। তারাই কথিত সেই সফ্টওয়্যারের আড়ালে উদ্যোক্তাগণের ব্যবসার ভূত-ভবিষ্যত জানিয়ে দিতেন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে ইউপ্লাস প্রতিষ্ঠা করেন শওকত শামীম। ওই বছরের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার মূলধন জোগাড় করে ইউপ্লাস। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলার ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সংগ্রহ হয়। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে এসব তহবিল সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। এসব বিনিয়োগকারীর মধ্যে ব্যক্তি, ছোট তহবিল কিংবা প্রতিষ্ঠানও ছিল।
এসইসির সানফ্রান্সিসকো আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক এরিন ই স্নাইডার তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, শামীম ও ইউপ্লাস কোম্পানিতে বিনিয়োগে লাভের ফাঁপা গল্প ছড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে এর আর্থিক কর্মক্ষমতা এবং ক্রেতার ভিত্তিবিষয়ক মিথ্যা তথ্য। প্রাথমিক পর্যায়ের তহবিল সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির সময় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই সত্যি কথা বলতে হবে।
জানা গেছে, একটি আর্থিক তহবিল ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ইউপ্লাসে প্রায় ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিনিয়োগ করা হয় ছয় লাখ ডলার। ওই তহবিল বিনিয়োগ কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবেও ইউপ্লাসে হাজার হাজার ডলার বিনিয়োগ করেন বলে জানিয়েছে এসইসি।
লিংকডিন প্রোফাইল অনুযায়ী, শওকত শামীম ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করেছেন। এরপর ১৯৯৪ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
চাঞ্চল্যকর এই প্রতারণা ও ধাপ্পাবাজির মামলার বিস্তারিত তথ্য জানাতে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংকালে ইউএস এটর্নী ডেভিড এল এন্ডারসন এবং এফবিআই’র স্পেশাল এজেন্ট জন এল বেনেট উল্লেখ করেন, শওকতের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি প্রতারণার এবং জালিয়াতির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শওকত শামীমের কমপক্ষে ২০ বছরের জেল এবং কোয়ার্টার মিলিয়ন থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
এটর্নী এন্ডারসন বলেন, সিলিকন ভ্যালীর ইমেজ ধ্বংসের অভিপ্রায়ে শওকত এমন ফাঁদ পেতেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইনকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। আমরা সিলিকন ভ্যালির ঐতিহ্য অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর।
এফবিআই কর্মকর্তা জন বেনেট বলেন, কোন ধরনের জালিয়াতি অথবা প্রতারণাকে বরদাশত করা হয় না এই দেশে। আর এভাবেই আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে আমেরিকায়।
জানা গেছে, শওকত শামীম আরো চারটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিলিকন ভ্যালিতে। তার মধ্যে রিদম নিউমিডিয়া ক্রয় করেছে ব্লিনক্স এবং বাইসাইট কিনে নেয় এওএল। আরো জানা গেছে, দুবাই, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবসা সম্পর্কিত সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে শওকত শামীমকে বহুবার বক্তব্য উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। আর এভাবেই নতুন উদ্যোক্তারা তার টোপে পা বাড়ায়। বাণিজ্যে সফল হবার অভিপ্রায়ে শওকতের শেয়ার ক্রয়ের পর সকলেই পথে বসেছেন। অপরদিকে, সেই অর্থে দামী পোশাক আর গাড়ি ক্রয় করে বিলাসী জীবন-যাপন করেন শওকত।