অনলাইন ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের হার বেশি থাকার বিষয়টিকে অনেক অ্যামেরিকানই সহজভাবে নিয়েছেন।
শিকাগো, নিউ অরলিন্স, লাস ভেগাস শহর এবং ম্যারিল্যান্ড ও সাউথ ক্যারোলাইনা শহরে এখন জাতিসত্বার ভিত্তিতে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য আলাদা করে প্রকাশ কো হচ্ছে। এসব জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গদের আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার হার অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে বহুকাল ধরে চলে আসা বৈষম্য এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। কিন্তু তার বাইরেও সম্ভাব্য কিছু কারণে কৃষ্ণাঙ্গরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া তিনজনের ঘটনা তুলে ধরা হলো:
শিকাগোর এক গির্জার রেভারেন্ড মার্শাল হ্যাচের ৭৩ বছর বয়সী বড় বোন রোডা হ্যাচ ৪ঠা এপ্রিল আটদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যান। এর দুইদিন আগে রেভারেন্ড হ্যাচের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ল্যারি হ্যাচও মারা যান কোভিড-১৯ এ। তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
গত কয়েকদিনে রেভারেন্ড হ্যাচের খুব কাছের চারজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার বাড়ি ওয়েস্ট গারফিল্ড পার্ক, যেখানে মূলত আফ্রিকান অ্যামেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের বসবাস। সেখানকার অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।
রেভারেন্ড হ্যাচ বলেন, ‘আমার বোনকে কবর দেয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল যে, কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হলে আমরা যারা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে আছি, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবো।’
আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী ওয়েস্ট গারফিল্ড পার্কের মানুষের গড় আয়ু মাত্র তিন মাইল দূরত্বে থাকা শ্বেতাঙ্গ এলাকার মানুষের গড় আয়ুর তুলনায় পুরো ১৬ বছর কম। প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে, শিকাগো শহরে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের ৬৮% আফ্রিকান অ্যামেরিকান, যেখানে পুরো শহরের জনসংখ্যার মাত্র ৩০% তারা।
তার উপর দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কারণে ওয়েস্ট গারফিল্ড পার্কের অনেকেরই স্বাস্থ্য বীমা নেই এবং তাদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর বাসস্থানে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই কঠিন।
নিউ অরলিন্সের ২৪ বছর বয়সী ক্ল্যারিওন্টা জোনস প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা হয়, এমন একটি দোকানে কাজ করেন। তাই চাইলেও কাজ থেকে ছুটি নিতে পারছেন না তিনি।
ক্ল্যারিওন্টা বলেন, ‘দোকানে যেসব ক্রেতা আসেন, তাদের কারো মধ্যে কোনো ধরণের রোগ আছে কিনা, আপনি জানেন না। আমার পরিবারে একমাত্র আমিই উপার্জনকারী সদস্য। তার উপর যখন আশেপাশের অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন, আমার বাড়িতে এপ্রিলের ভাড়া দেয়ার জন্য তাগাদা দেয়া শুরু করেছেন বাড়িওয়ালা। এই পরিস্থিতিতে আমি যদি অসুস্থও হই, আমি কোনো একটা ওষুধ খেয়ে কাজ চালিয়ে যাবো। আমার দু’টি সন্তান আছে। আমি এই পরিস্থিতিতে বেতন হারাতে চাই না।’
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় চাকরি হারাতে হচ্ছে – সারা বিশ্বের সব জায়গাতেই নিম্ন আয়ের এরকম অনেক মানুষ রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিম্ন আয়ে’র মানুষের সংজ্ঞায় ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ বা ‘তামাটে’ বর্ণের মানুষের হার অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি।
ক্লারিওন্টা শুরুতে ধারণা করেছিলেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। শুধু নিউ অরলিন্সেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জায়গাতেই এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, যা বিশ্বাস করেছিলেন আফ্রিকান অ্যামেরিকানদের অনেকেই।
কৃষ্ণাঙ্গরা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন না, এই গুজব ছড়িয়ে পড়ায় ভয়াবহ বিপদে পড়েন উইসকনসিন রাজ্যের মিলওয়াকি শহরের স্বাস্থ্য কমিশনার ডক্টর জিনেট কোয়ালিক।
ঐ শহরের প্রায় ৪০% বাসিন্দাই কৃষ্ণাঙ্গ। শহরের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যবস্থা নেয়ার আগেই শহরে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ শুরু হয়।
ডক্টর কোয়ালিক বলেন, ‘প্রথম সপ্তাহে শহরে হয়তো ৮০টির মতো ঘটনা ছিল, যাদের ৭০% ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। যেসব আফ্রিকান অ্যামেরিকান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশেরই হৃদরোগ, ডায়বেটিস, শ্বাসকষ্ট বা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা ছিল।’
ডাক্তার কোয়ালিক মনে করেন আফ্রিকান অ্যামেরিকানদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি মাত্রায় স্বাস্থ্য সমস্যা থাকার পরোক্ষ কারণ বহুকাল ধরে চলে আসা বৈষম্যমূলক নীতি।
মেডিকেল গবেষণার উল্লেখ করে তিনি জানান, টানা মানসিক চাপের মধ্যে থাকার কারণে যেই হরমোন নি:সৃত হয়, তা মানুষকে দ্রুত বার্ধক্যে নিয়ে যায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত কমিয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, ‘এইসব বিষয়কে কাঠামোগত বৈষম্যের সাথে তুলনা করা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে এদেশে এরকম নীতি এবং এর অনুশীলন করা হয়ে আসছে। এখনো নিম্ন আয়ের আফ্রিকান অ্যামেরিকানদের যথেষ্ট পরিমাণ করোনাভাইরাস পরীক্ষা হচ্ছে না। এর ফলে তারা আরো বেশি অবহেলিত অনুভব করছে।’
কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয় না- এই গুজব কীভাবে ছড়ালো?
জানুয়ারির শেষদিক থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই গুজব ছড়ায় যে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। শুরুর দিকে আফ্রিকায় কোনো দেশে করোনাভঅইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত না হওয়ায় এই গুজব ভিত্তি পায়।
এছাড়া সেসময় চীনে ক্যামেরুনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এক ছাত্রের সুস্থ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ঐ গুজব আরো শক্ত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি যে গায়ের রং বা জাতিস্বত্ত্বার ভিত্তিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ভিন্নভাবে হয়।
কিন্তু তা স্বত্ত্বেও বেশ কয়েকটি ইংরেজি ওয়েবসাইটে এই খবরটি প্রকাশিত হয় এবং নাইজেরিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও জাম্বিয়ার বেশকিছু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান অ্যামেরিকান কমিউনিটির মধ্যেও এই গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়ায়। সূত্র : বিবিসি