অনলাইন ডেস্ক : যুক্তরাজ্যে সোমবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০ বছর আগে যে দেশে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেখানে কয়লা যুগের অবসান ঘটতে চলেছে। কয়লার বদলে দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ধনী দেশগুলোর বৈশ্বিক ক্লাবের মধ্যে ব্রিটেনই প্রথম কয়লা থেকে সরে আসছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, র‌্যাটক্লিফ-অন-সোয়ার পাওয়ার স্টেশনের ১২ তলা উচ্চতার বয়লারগুলোতে সোমবার নামবে শীতলতা। বাষ্প তৈরির জন্য কয়লার আগুনের যে গোলা এতদিন জ্বলেছে, সেখানে নামবে অন্ধকার। ৫০০ মেগাওয়াটের চারটি টারবাইন এতদিন ঘুরেছে বিরামহীন, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে ৫৭ বছর ধরে কয়লার যে পাহাড়সম স্তূপ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে চালিয়ে রেখেছে, তার অবশিষ্টাংশ এক সময় ধুলোয় মিশে যাবে।

১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়। ‘ধোঁয়াশা’ শব্দটিও সেখানে তৈরি হয়েছিল।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতি মন্থর করার চেষ্টায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম একটি মাইলফলকে পৌঁছাচ্ছে যুক্তরাজ্য। অন্য জি-সেভেন দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ২০২৫ সালের মধ্যে, কানাডা ২০৩০ সালের মধ্যে এবং জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশের তিন-চতুর্থাংশও ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রও কয়লা থেকে সরে যাচ্ছে, তবে সেই গতি পরিবেশবাদীদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীর। সিকি শতাব্দী আগে দেশটির অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো কয়লা থেকে; এখন এ হার প্রায় ১৮ শতাংশ।

ব্রিটেনে কেবল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে না, কয়লা উত্তোলনও হচ্ছে না বললেই চলে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নয়, ইস্পাত শিল্পের জন্য ৩০ বছরের বেশি সময় পর প্রথমবার গভীর কয়লা খনি খননের উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাজ্য; কিন্তু চলতি মাসেই হাইকোর্ট সে চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছে।

২০১৪ সাল থেকে র‌্যাটক্লিফ বিদ্যুৎকেন্দ্রে যত কয়লা ব্যবহার করা হয়েছে, তার সবই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া থেকে। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার বদলে কয়লা এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।

সিনিয়র ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ বেনেটের (৬৪) জীবনই কেটেছে র‌্যাটক্লিফ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তিনি বলেন, সত্যি বলতে কী, কেন্দ্র বন্ধ হওয়া দেখতে আমার খারাপই লাগবে। এটা শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল, এখনো সবকিছুই কয়লার ওপর নির্ভর করছে।

আগামী দুই বছরের মধ্যে কেন্দ্রটি ‘ডিকমিশনড’ করা হবে। তারপর ভেঙে ফেলা হবে। অবশিষ্ট ব্রাউনফিল্ডটি অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হবে; হয়ত সেখানে ‘শূন্যকার্বন প্রযুক্তি এবং শক্তি কেন্দ্র’ হবে। বিষয়টি নিয়ে এখনো পরিকল্পনা চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিক জার্মানভিত্তিক বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি ইউনিপার। যুক্তরাজ্যে এখন তারা প্রাকৃতিক গ্যাস চালিত পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করবে।

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ব্রিটেন যে কয়লা থেকে সরে আসবে, তা আগের প্রজন্ম, সরকার ও শিল্পপতিদের কাছেও ছিল অকল্পনীয়, যারা কয়লাভিত্তিক উদ্যোগে প্রচুর মূলধন ও শ্রম দিয়েছিলেন।

এক সময় যুক্তরাজ্য ছিল কয়লার দেশ, প্রায় ১০ লাখ শ্রমিককে কয়লা খননের কাজে লাগানো হয়েছিল, যাতে সস্তায় জ্বালানি তৈরি, তাপ উৎপাদন করা যায়। তারপর বাষ্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। কয়লা যেমন ঘর গরম করে, তেমনই ট্রেন চালানো এবং ইস্পাত ও সিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বেনেট বলেন, তিনি এমন একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন, যেখানে তিনটি কাজের সুযোগ ছিল- কয়লা খনিতে কাজ করা, রেললাইনে কাজ করা বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করা।

‘আমি খুশি যে আমি একটি পাওয়ার স্টেশন বেছে নিয়েছিলাম।’

বেনেট বলেন, তিনি যখন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ শুরু করেন, তখন কেউ গ্রিনহাউজ গ্যাসের কথা বলেনি। আগের দিনে জনসাধারণ ও দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রকরা সাধারণ দূষণ নিয়েই উদ্বিগ্ন থাকতেন; যেমন- সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড মিলে অ্যাসিড বৃষ্টি ঝরা।

বেনেটের মনে আছে, কয়েক বছর আগে কোম্পানির সাবেক নির্বাহী র‌্যাটক্লিফ বিদ্যুৎকেন্দ্রে এসে বায়ু বিদ্যুৎ নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি বলেছিলেন- তোমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখন ব্রিটেনের অর্ধেক বিদ্যুৎ আসে বায়ু ও সৌরশক্তি থেকে।