বিদ্যুত্ রঞ্জন দে : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ যাদের রক্তের বন্যায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকাকে নর্দমায় নিক্ষেপ করে এক রক্ত ভেজা লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনতে উত্সর্গ করেছিলেন মহত জীবন তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক ও জগন্নাথ হল ছাত্রাবাসের গৃহ-শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য। মোম যেভাবে নিজে দগ্ধ হয়ে আলো ছড়ায় এবং ধুপ সৌরভ ছড়ায়, ঠিক একইভাবে ঐ কীর্তিমান শিক্ষকেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার উষালগ্নে যে ইতিহাসের সূচনা করে গিয়েছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় ৯ মাসে এক নদী রক্ত ঝরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে ৭ কোটি জনতা। তারা শুধু রক্ত দিয়ে ইতিহাস হয়ে যাননি নব জাতকদেরকে আশীর্বাদ ও করে গেছেন যাতে করে তারা বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীনতার সাথে সাথে মুক্তির সাধ পৌঁছে দিতে পারে। নব প্রজন্ম তাদের অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হয়নি, তারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, গণজাগরন মঞ্চের আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত যুগান্তকারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে তাদের সক্ষমতার বার্তা। ভবিষ্যত তাদের ছোঁয়া পেতে উদগ্রীব হয়ে আছে কারণ তারাই পারবে বাংলাদেশকে একটি শোষনহীন সুখী সমৃদ্ধশালী দেশে পরিনত করতে। জয় তাদের হবেই।
এবার আমি যাকে নিয়ে গর্বের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে চাই উনি আমার বন্ধু ও শিক্ষক শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে প্রিলিমিনারী ক্লাশে যখন ভর্তি হই তখন অনুদ্বৈপায়ন দা ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। একই হলে (জগন্নাথ হল) আবাসিক ছাত্র হিসাবে বসাবসের কারণে আমার বন্ধু অংক শাস্ত্রের ছাত্র মৃনাল দে (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) দ্বৈপায়ন দার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর থেকে প্রতিদিন সকাল বিকাল সুধীর দার কেন্টিনে উনার সাথে দেখা হত এবং একসাথে বসে নাস্তা করতাম। যেহেতু আমি ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম তাই উনার প্রশ্রয়ে উনার সামনেই সিগারেট খেতাম। উনার মধ্যে এই বদঅভ্যাসটি ছিল না।
অনুদ্বৈপায়ন দার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম কারণ একদিকে উনি ছিলেন মেধাবী অন্যদিকে অমায়িক, স্পষ্টভাষী, দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন এবং মৃদু হাসি উনার মুখে সবসময় লেগে থাকত। ১৯৬৮ সালের ১৪ই মার্চ অনুদ্বৈপায়ন দা প্রভাষক হিসাবে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। আমি উনার প্রত্যক্ষ ছাত্র হয়ে যাই। আমার মধ্যে আগের অনুভূতিগুলি আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে কিন্তু দ্বৈপায়ন দা আমাকে কাছে টেনে নিতেন। ডিপার্টমেন্ট থেকে আসা যাওয়ার পথে রিক্সা থামিয়ে আমাকে রিক্সায় বসিয়ে রাজনীতি, পারিবারিক এবং পড়াশুনার খবর নিতেন এবং ভবিষ্যত কিভাবে উজ্জল করা যায় সেই উপদেশ দিতেন। উনি প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক ছিলেন কিন্তু মিটিং মিছিলে যোগদান থেকে বিরত থাকতেন। উনি আমাকেও ভবিষ্যত যাতে বিঘ্নিত না করি সেদিকে খেয়াল রাখতে উপদেশ দিতেন। ১৯৭০ এর প্রথম দিকে মাস্টার্স এর শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে ফেরার আগে উনার সাথে যখন দেখা করি উনি যে উপদেশটি দিয়েছিলেন তা খুবই মনে পড়ে “যান বাড়ীতে কিন্তু ফল প্রকাশের পরই ঢাকায় চলে আসবেন কারন ভবিষ্যত গড়তে হলে ঢাকা থেকেই চেষ্টা করতে হবে।” এটাই ছিল উনার সাথে আমার শেষ দেখা।
অনুদ্বৈপায়ন দার জন্ম ১৯৪১ সালের ৩১শে জানুয়ারী তদানীন্তন সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমাধীন নবীগঞ্জের জন্তরী গ্রামের এক মধ্য়বিত্ত পরিবারে। বাবা দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ও মা রাজলক্ষী ভট্টাচার্য্যের ছয় সন্তানের মধ্যে উনি ছিলেন সকলের বড়। পিতা দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ছিলেন ঐ এলাকার একজন বিদ্যোত্সাহী এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিত্ব। স্থানীয় লোকজন উনাকে পন্ডিত মহাশয় বলে শ্রদ্ধাভরে ডাকত। উনার বড় ছেলে শহীদ অনুদ্বৈপায়ন দা আগাগোড়াই প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৬১ সালে নবীগঞ্জের একটি অজো পাড়াগায়ের হাই স্কুল (জে, কে) থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন। ১৯৬৩ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ (M.C. College) কলেজ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে এইচ. এস. সি. পরীক্ষায় অসামান্য সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে বি.এস.সি. অনার্সে প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান এবং ১৯৬৭ সালে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এম.এস.সি. শেষ পর্বে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
অনুদ্বৈপায়ন দা ছাত্র হিসাবে যেমন ছিলেন মেধাবী ও বিনয়ী, তেমনি কি অধ্যাপনায়, কি আবাসিক শিক্ষকতায় দক্ষতা ও নীতি নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার সম্পর্কে তার সহকর্মী এবং বিজ্ঞ শিক্ষকদের মতামত নিচে তুলে ধরলাম।
বিভাগীয় অধ্যক্ষ এস এম ফজলুর রহমান “As a student he was found to be very hard working, enthusiastic and intelligent.”
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ জি. সি. দেব “During his stay in hall nothing adverse came to the notice against him.”
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অজয় রায় “ও কম কথা বলত, স্বভাবে বিনয়ী কিন্তু যা বলত ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে দৃঢ়তা নিয়ে। উচ্চারণে সিলেটের আঞ্চলিক টান ধরা পড়ত।”
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক হিরণময় সেনগুপ্ত “শ্যামলা হালকা গড়নের- উজ্জল চোখের এই শান্ত ছেলেটি ছিল মিতবাক, কিন্তু প্রশ্ন করলে বেশ স্পষ্টভাবে জবাব দিত কনফিডেন্স নিয়ে।”
ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তার শিক্ষক ও সহকর্মী অধ্যাপক আলী জাফর “কোমল স্বভাবের ঐ ধীমান ছাত্রটিকে আমি ভুলিনি। ও মেধাবী ছিল, ভাল শিক্ষক ছিল, কালে যে একজন নিষ্ঠাবান গবেষকে পরিণত হত, এতে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সে সম্ভাবনা তো অঙ্করেই বিনষ্ট হলো।
অধ্যাপক ডঃ রংগলাল সেন তার সহকর্মী হিসাবে স্মৃতিচারণ- অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতেন। দাবা খেলার প্রতি ছিল তার প্রাল ঝোঁক। তিনি আবার সকলের সাথে খেলতে বসতেন না। তার খেলার সাথী ছিলেন আরেক শহীদ ডাঃ মোর্তুজা যিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক। ডাঃ মোর্তুজা শুধু ভাল চিকিত্সক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতন ব্যাক্তি ও প্রগতিশীল ভাবধারার অধিকারী। তাকে ও ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ইং চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে হত্যা করে, তার লাশ ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ইং তারিখে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।
অধ্যাপক জালালুর রহমান- উনার শিক্ষক ও সহকর্মী বলেন “২৫শে মার্চ ১৯৭১ এর সেই ভয়াল রাত ৯.৩০ মিনিটে আমি ও অনুদ্বৈপায়ন এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব থেকে ফিরে ওকে বিদায় জানিয়েছিলাম জগন্নাথ হলের গেটের কাছ থেকে। পরদিন তার বিলেত যাবার কথা উচ্চশিক্ষার্থে কলম্বো প্লেনে বৃত্তি নিয়ে। কিন্তু তার আর যাওয়া হলো না। ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ সকালে দেশ মাতৃকার কোলে তাকে উত্সর্গীত হতে হলো।”
অনুদ্বৈপায়ন দার মৃত্যুরহস্য জানতে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে জগন্নাথ হলের গণকবর থেকে আহত অবস্থায় মৃত্যুর ভান করে অলৌকিকভাবে বেঁচে আসা আমার দুই বন্ধু সুরেশ দাস ও কালীরঞ্জন শীল (ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ও বর্তমানে মৃত) এর কাছে জানতে চাইলে ওরা কোন সঠিক তথ্য দিতে পারেনি তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের কর্মচারী কেশব চন্দ্র পালের স্ত্রী শোভা পাল অতি নিকট থেকে অনুদ্বৈপায়ন দার হত্যাকান্ড দেখেছিলেন ২৬শে মার্চের ভোরাবেলা। জগন্নাথ হলের সংসদ ভবনের হল কক্ষ থেকে শোভা দেখতে পান খুব ভোরে অন্ধকারে কজন পাকসেনা জনৈক ব্যাক্তিকে বেধে নিয়ে আসছে। সংসদ ভবনের সামনে ফাঁকা স্থানে তাকে উবু করে বসিয়ে রাখা হলো। অন্ধকার দুর হতেই স্পষ্ট হলো ঐ ব্যাক্তিটি অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য। উনার হাত দুটি পিছনে বাধা, পরনে কেবল অন্তর্বাস, চোখ দুটি রক্তলাল, সর্বাঙ্গে প্রহারের চিহ্ন, বোধ শক্তি রহিত, দিক ভ্রান্ত কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলেন। একটু পরে তাকে ও সুশীল নামের জনৈক ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে দক্ষিণ বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হলো।
অনুদ্বৈপায়ন দার বর্তমান পারিবারিক খবর জানতে জিজ্ঞেস করেছিলাম নবীগঞ্জের এক বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু রিটায়ার্ড কর্নেল চন্দ্র কান্ত দাস (C.K. DAS) কে। উনার ভাষ্যমতে দ্বৈপায়ন দার মৃত্যুতে তার পরিবার এই শোকাবহ অনাকাঙ্খিত ও গভীর তমশাচ্ছন্ন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের তিনি ছিলেন বড় ছেলে। তার উপর অনেক আশা ভরসা নিয়ে তাকিয়ে ছিল তার পরিবার। এত অল্প বয়সে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি পর্বে এরূপ মৃত্যুবরণ সহ্য করতে পারেনি তার পরিবারের কেউই। তাই আশির দশকে তার মা-বাবা ভাই-বোন সবাই ভারতে চলে যান। যতটুকু জানা যায় তার বাবা ও মা মৃত্যুবরণ করেছেন। সব ছোট বোনটি উনাদের জন্তরী গ্রামের বাড়িতে বর্তমানে স্বামী সন্তান নিয়ে বাস করছেন।
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বত্সর। অনুদ্বৈপায়ন দার মত যে সব শহীদ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তাদের রক্ত দিয়েছিলেন একটি সুখী ও সুন্দর বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য তা কি আসলে আজও বাস্তবায়িত হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কি তার পরিবারের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করেছে? স্বাধীনতার পরবর্তীকালে জগন্নাথ হল সংসদ ভবনের নাম রাখা হয়েছিল “অনুদ্বৈপায়ন ভবন”। কিন্তু আর এক বিষাদঘন সন্ধ্যায় ভেঙ্গে পড়ল অনুদ্বৈপায়ন ভবন- চাপা পড়ল অনেক ছাত্র মৃত্যুবরণ করল অনেকে। সেই স্থানে তাদের স্মৃতিতে নির্মিত হলো জগন্নাথ হলের “অক্টোবর ভবন”, অনুদ্বৈপায়ন হারিয়ে গেলেন। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি জগন্নাথ হলের নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা এ ভবনে অবস্থিত পাঠাগারের নাম তার নামে রেখে ৭১ এর এই শহীদকে স্মরণ রাখার ক্ষীণ চেষ্টা করেছে। শহীদ অনুদ্বৈপায়ন দার আত্মদান বৃথা যেতে পারে না। তিনি আমার মণিকোঠায় চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। জয়তু শহীদ। শহীদ স্মৃতি অমর হউক।
