নাদিরা তাবাসসুম : ঘূর্ণায়মান সূর্য, চন্দ্র আর পৃথিবীর মাঝে আমরা গতিশীল ছুটন্ত মানুষ
চলতে চলতে থমকে থেমে গেলাম, একি ঘটলো বিশ্ব জুড়ে?
করোনা মহামারী কভিড-১৯ নামে উত্পত্তি হল যার চীন দেশের উহানে।
হঠাত কি যে হলো থমকে গেল সারা বিশ্ব, নানা প্রশ্ন জাগে মানুষের মনে।
দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা মানুষ নির্বাক নিস্তদ্ধ; স্থগিত কাজকর্ম, বন্ধ আনাগোনা
নিত্য প্রয়োজন- ‘এটা নেই’ ‘ওটা নেই’ ঘরের বাহিরে যাতায়াত সীমিত
জীবন চলার ছন্দে পড়েছে টান, ভাইরাস বলে “ঘরে থাকো আপনার সনে”।

২০২০ সালের শুরুতে এসে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ হরণ করে চলেছে এ ভাইরাস। এর আগেও এরকম মহামারী প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ হরণ করে গেছে। এবারের করোনা পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে আক্রমণ করেনি। এতদিন আমরা দেখেছি কোন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প অথবা সামাজিক অপ্রীতিকর ঘটনা, রাজনৈতিক গোলযোগ বা যুদ্ধ, হানাহানি ইত্যাদি কোন এক নির্দিষ্ট এলাকায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদ-আপদ-এর কারণ ঘটায়। বর্তমানে করোনা ভাইরাসটি চোখে দেখা যায় না ঠিকই কিন্তু ভয়াবহ আকৃতিতে মারাত্মক আকারে সারা বিশ্বে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু মিছিল। দেশে দেশে লকডাউন চলছে। ঘরবন্দি মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে যেতে পারছে না। বাইরে যেতে হলে মাস্ক, গ্লাভস পরিধান করে অন্য মানুষের থেকে ২ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হচ্ছে।

বেশির ভাগ সময় ঘরেবন্দি থাকতে হয় তাই মনটা মাঝে মাঝে যাপিত জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সংক্রান্ত নানাবিধ বিষয়গুলো নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা ও পর্যালোচনা মুখর হয়ে ওঠে। অতীতে কি কি করেছি, কি কি করা উচিত ছিল এবং কি কি করা উচিত হয়নি ইত্যাদি। বর্তমানে কি কি করা উচিত, কি কি করা উচিত নয়, কিভাবে চলাফেরা করা উচিত, কিভাবে চলাফেরা করা উচিত নয় ইত্যাদি। অতঃপর ভবিষ্যত যা কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটতে পারে।

একমাত্র পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখি, গাছপালা সকলেই যার যার সুনির্দিষ্ট আয়ু নিয়ে কাটায় জীবন-কাল। কালের বিবর্তনে কেউ অল্প সময়ের জন্য বেঁচে থাকে আবার কেউ দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে। কিন্তু কেউই চিরকালের জন্য বেঁচে থাকে না। মানুষ পৃথিবীতে তার যাপিত জীবনে কখনো একই ধরনের সময় অতিবাহিত করে না। বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় মানুষকে। নানা রকমের সুবিধা-অসুবিধা, ভাল-মন্দ, সুখ-অসুখ, বাধা-বিপত্তি প্রতিনিয়ত মানুষ অতি সাহসিকতা ও বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়েই মোকাবিলা করছে এবং সকল সমস্যার সমাধান করে আসছে। অনুক‚লে অতিবাহিত সময়কে মানুষ ভাল সময় আর প্রতিক‚লে অতিবাহিত সময়কে মানুষের কাছে খারাপ সময় বা অসময় বলে মনে হয়। যেমন এখন বর্তমান করোনা চলাকালীন সময়কে আমরা দুঃসময় মনে করছি।
অতীত-এর মানুষের শিশুকালের স্মৃতিগুলো বড়ই স্পর্শকাতর। কিছুতেই ভোলা যায় না। মনের কোণে জ্বল জ্বল করে, মনে হয় এইতো সেদিন সব কিছু ঘটে গেলো। মা-বাবা, ভাই-বোনের আদর বকুনি সবই যেন কিছুদিন আগের ঘটনা। প্রতিদিন মা ঘুমানোর সময় শুয়ে যে সকল ঘুমপাড়ানি গজল করতেন তা এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তা হলো “এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানী।

তুমি কতই দিলে রতন, ভাই বেরাদর পুত্র-স্বজন
ক্ষুধা পেলে অন্ন যোগাও, মানি চায় না মানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
“রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার আল্লাহ করো না বিচার-
বিচার চাহিনা দয়া চাহি আমি গুনাহগার আল্লাহ”
“ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়”
“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে”
– ইত্যাদি গীত বা গজল যা ছিল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রাসুলের প্রতি হামদ ও নাত। গজল শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম কিচ্ছু জানতে পারতাম না। ছোটকাল থেকেই তাই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা ছাড়া আমাদের আর কোন রক্ষাকর্তা নেই। তিনিই আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর কাছে তুলে নেবেন। তাই তিনিই আমাদের একমাত্র আশ্রয় এবং নামাজ রোজাসহ সকল ধর্মীয় আদেশ নিষেধ আমাদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

এভাবে আল্লাহ ভীতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা, পাশাপাশি স্কুল কলেজে পড়াশোনা করা। হাইস্কুলে পড়াকালে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা নিয়ে যখন এগুচ্ছিলাম তখন বড়ভাই-এর ধর্ম-দর্শন, সমাজতত্ব, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ যা তিনি অধিক সময়ে আমার সাথেই করতেন কারণ অন্যান্য ভাইবোনদের চেয়ে আমিই বেশি আগ্রহ ও মনোযোগ সহকারে শুনতাম। আমার বড় ভাইয়ের বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদদের বই সংগ্রহ করা এবং পড়ার আগ্রহ ছিল প্রচন্ড। তিনি চাকুরী শেষে বাসায় ফিরে বই পড়তেন এবং আমাদের ভাইবোনদের পড়ে শোনাতেন।

এভাবে একদিকে আল্লাহভীতি অন্যদিকে আধুনিক দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি সব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ ঘটেছিল ছোটবেলা থেকেই। তখন থেকেই অনুধাবন করেছিলাম যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার ইবাদত ও প্রার্থনা আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য – অতঃপর মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, অর্থাত আল্লাহতায়ালার সকল সৃষ্টির প্রতি।

উনিশ/বিশ শতকে যখন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জয়জয়কার এবং বিজ্ঞানের আকাশ্চুম্বী সাফল্য তখন সবকিছুকেই ব্যাখ্যা করা হয় বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে। দার্শনিকতত্ব মতবাদ ব্যাখ্যার পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় চর্চা অব্যাহত থাকে। ধর্মকে ব্যক্তিগত সামাজিক রীতিনীতিতে উদযাপন করা ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার প্রসার চলতে থাকে। ধর্মকে যারা কঠোরভাবে মেনে চলে তাদেরকে স্মার্ট মনে করা হতো না। আমি নিজেই লক্ষ্য করেছি কলেজ ইউনিভার্সিটিতে যারা ঝকমকে দামী পোশাক আশাকে সজ্জিত হয়ে স্মার্ট চলাফেরা করতো তাদেরকে সকলে একটা বিশেষ প্রাধান্য দিতো। তাদেরকে মনে করা হতো অনেক সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়ে। যে বিষয়টি বর্তমান একবিংশ শতকের ধারাবাহিকতায়ও লক্ষ্য করা যায়।
ছোটবেলা থেকেই ধর্ম ও দর্শন স্বাভাবিকভাবে আমার আগ্রহের বিষয় হয়ে যায়। যদিও ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে ধর্ম চর্চার পাশাপাশি বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্মন্ধে জানার অতীব আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সাথে মহাবিশ্ব, আকাশ, পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্ররাজি, প্রকৃতির গাছপালা আর জীব বৈচিত্র এবং মানুষ সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার চিন্তা রাজ্যকে খুব বেশি ভাবিয়ে তুলতো। এতে যিনি সবচে বেশি অনুপ্রেরণা যোগাতেন তিনি ছিলেন আমার বড় ভাই মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। তিনি এতদবিষয়ে কোন লেখা অথবা বই পত্র পেলেই তা কিনে এনে পড়ে শোনাতেন এবং পড়তে উত্সাহ দিতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতই গভীরে প্রবেশ করেছি ততই মনে হয়েছে যে, মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সী, মিল্কিওয়ের মাঝে সূর্য নামক নক্ষত্রের পৃথিবী নামক একটি ছোট্ট গ্রহের মাঝে আমার অস্তিত্ব একেবারেই অতি নগণ্য। এত সুপরিকল্পিত পৃথিবী এত সুন্দর পরিমিত মানব জীবনের সৃষ্টি কি কোন কারণ ছাড়াই হয়েছে; নাকি এর পেছনে কোন মহান উদ্দেশ্য রয়েছে? কস-এফেক্ট রিলেশনস বিবেচনায় নিশ্চয়ই আমার সৃষ্টির পেছনে কোন উদ্দেশ্য তো রয়েছেই। তীব্র অনুতাপ ও আশংকায় মাথা অবনত হয়ে আসে। আর যখন জানতে পারি যে ‘স্টাডিইং অফ কোশ্চেন্স এন্ড নট আন্সারিং দেম ইস দা বিজনেস অফ ফিলসফি’ ‘ইটস লাইক সার্চিং ফর এ ব্লাক ক্যাট ইন এ ডার্ক রুম বাই এ ব্লাইন্ড ম্যান’। ‘হোয়ার ফিলসফি এন্ডস সাইন্স বিগিন্স, হোয়ার সাইন্স এন্ডস রিলিজিয়ন বিগিন্স’ ‘রিলিজিয়ন উইথাউট সাইন্স ইজ ব্লাইন্ড এন্ড সাইন্স উইথাউট রিলিজিয়ন ইজ লেম’।

মানুষের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ সময় যৌবন কাল ও মধ্যবয়সের জীবিকার তাগিদে যে ছোটাছুটি, ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্য তা মানুষকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুনিয়ামুখী বা দুনিয়া প্রেমিক করে তোলে। পৃথিবীর বস্তুগত বিষয়সমূহ আমাদের এত আকৃষ্ট করে রাখে যে আমরা জ্ঞানের পরিপূর্ণতা ও গভীরতা না অর্জন করা পর্যন্ত কিছু উপলব্ধি করতে পারি না। বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের উপর গভীর গবেষণা এবং জ্ঞান মানুষকে যে পরিপূর্ণতা দান করতে পারে তা আমরা বুঝতে সক্ষম হই না।

ইসলাম হলো মানব জাতির আদি ও অকৃত্রিম ধর্ম যার অর্থ আত্মসমর্পণ। যেহেতু এই ধর্মে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করে থাকে সেহেতু সে একজন মুসলিম। হযরত আদম (আঃ) হতে সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল ধর্মের মূল বা সার কথাই ছিল ইসলাম। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তির যে বাণী প্রচার করেছিলেন তাই ইসলাম। ইসলাম শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালার মনোনীত ধর্ম যে ইসলাম ধর্ম তার উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা বাকারার ১৩১ ও ১৩২ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন “যখন রব বললেন ‘আত্মসমর্পণ করো; বলল “আমি বিশ্ব রবের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম”। আর এরই অসিয়ত করেছে ইব্রাহীম ও ইয়াকুব তার পুত্রদেরকে, হে সন্তানেরা! আল্লাহ তোমাদের দ্বীন মনোনীত করেছেন। অতএব তোমরা মরো না মুসলমান না হয়ে। সুরা মায়েদার ৩ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করলাম; আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম তোমাদের প্রতি; ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম”। সূরা আল-ইমরান-এর ৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন অন্বেষণ করে তা কখনো কবুল করা হবে না, আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে”।

পবিত্র কোরআনে অন্যান্য ধর্ম এবং আহলে কিতাব বা কিতাবধারীদের লক্ষ্য করে অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ইহুদী, খ্রীষ্টান অর্থাত যারা আসমানী কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসারী তাদেরকেই বিশেষভাবে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাঁর নবী ও রাসুলদের কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে পূর্ণ বিধান। আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ নবীর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর নিকট কোরআন নাযিল করেছেন।

তিনি সূরা নিসা ১৬৩ নং আয়াতে বলেছেন “নুহ ও তার পরবর্তী নবীদের মতো আপনার কাছেও অহী অবতীর্ণ করেছি; আর অহী নাযিল করেছি ইব্রাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরদের প্রতি, ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সোলায়মানের প্রতি এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছি”। সূরা বাকারার ২১৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “সকল মানুষ একই দলভুক্ত ছিল, তারপর আল্লাহ নবীদেরকে প্রেরণ করলেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আর সাথে সত্য কিতাবও দিলেন, যেন মতভেদযুক্ত বিষয়গুলোর মীমাংসা করতে পারেন”। বস্তুতঃ কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতবিরোধ করেনি স্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পর। শুধুমাত্র কিতাবধারীরা নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষবশতঃ এটাতে মতভেদ করেছিল, আল্লাহ মুমিনদেরকে স্বীয় ইচ্ছায় মতভেদযুক্ত বিষয়ে সত্যের সন্ধান দিয়েছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পরিচালিত করেন সরল পথে”।

“হে মুমিনরা! তোমরা ঈমান আন আল্লাহর উপর, তাঁর রাসুল ও রাসুলের উপর অবতীর্ণ কিতাব ও তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের উপর। আর যে ব্যাক্তি আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রাসুল ও পরকালকে অস্বীকার করে সে চির ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত” (সূরা নিসা আয়াত ১৩৬)।

“আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে ঐরূপ চেনে যেরূপ তারা তাদের সন্তানদের চিনে” (সূরা বাকারা ১৪৬ নং আয়াত)।

“নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে” (সূরা কদর ১নং আয়াত)।” এ তো শুধু বিশ্ব জগতের জন্য উপদেশ, তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায় তার জন্য” (সূরা তাকভীর ২৭-২৮ নং আয়াত)। “আপনাকে প্রদান করেছি কল্যাণময় গ্রন্থ যেন মানুষ বুঝে, আর যারা জ্ঞানী তারাই উপদেশ গ্রহণ করে” (সুরা সোয়াদ ২৯ নং আয়াত)।

“ইয়াসিন। জ্ঞানময় কোরআনের শপথ! নিশ্চয়ই আপনি রাসুলদের একজন। সরল সঠিক পথে আছেন। এ পরাক্রমশালী দয়াময়ের কাছ থেকে অবতীর্ণ, যেন জাতিকে সতর্ক করেন, যাদের পূর্বপুরুষদের সতর্ক করা হয়নি, তারা উদাসীন ছিল” ( সূরা ইয়াসিন ১-৬ নং আয়াত)। আর রাসুল (সাঃ) বলল, হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমার স¤প্রদায় এ কোরআন সম্পূর্ন রূপে পরিত্যাগ করেছিল। আল্লাহ বলেন, এভাবে আমি অপরাধীদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছিলাম, পথ প্রদর্শক ও সাহায্যকারীরূপে আপনার রবই আপনার জন্য যথেষ্ট। আর কাফেররা বলে, সমগ্র কোরআন একত্রে নাযিল হলোনা কেন? এভাবে এজন্য করেছি যাতে মন দৃঢ় হয়, আর এজন্যই আমি ধারাবাহিকভাবে আবৃত্তি করেছি “(সূরা ফুরকানঃআয়াত৩০-৩২)। “তোয়া হা। আপনি কষ্ট করার জন্য কোরআন নাযিল করিনি। বরং এমন ব্যাক্তিকে উপদেশ প্রদানের জন্য যে ভয় করে। (এ কোরআন) যিনি যমীন ও উচ্চ আকাশের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ হতে নাযিলকৃত। তিনি পরম দয়ালু, আরশে সমাসীন। আকাশ, পৃথিবী ও তার মধ্যবর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে যা আছে তা তাঁরই। আপনি উচ্চস্বরে যাই বলেন, তিনি গোপন ও অব্যক্ত সবই জানেন“ (সুরা তোয়া হা ১-৭ নং আয়াত)। আবার সূরা তোয়া হার ১১৩-১১৪ নং আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন, “আর এভাবেই আমি কোরআনকে আরবীতে নাযিল করেছি এবং তাতে বিভিন্ন সতর্কবাণীর বর্ণনা দিয়েছি যেন তারা ভয় করে এবং তাদের জন্য স্মরণ সৃষ্টি করে। বস্তুতঃ আল্লাহ অতি মহান, প্রকৃত মালিক। আর আপনার প্রতি অহী ( প্রত্যাদেশ) পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোরআন পাঠে আপনি তাড়াতাড়ি করবেন না। বলুন, হে আমার রব! আমার জ্ঞান বাড়াও”।

পবিত্র কোরআনে মানুষের জীবনের প্রতিটি বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং প্রকৃত দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমান একবিংশ শতক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্ব শিখরে উন্নীত। কিন্তু অদৃশ্য করোনা ভাইরাস এই বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে হার মানিয়ে তীব্র গতিতে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ আমরা এখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অসহায় চেয়ে আছি ভ্যাকসিন বা টিকার দিকে। বিজ্ঞান গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত নানামূখী প্রচেষ্টা চলছে ভ্যাকসিন বা টিকা আবিস্কারের। ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়ে চলেছে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই মহামারী, এখনও কোন নিশ্চয়তা নেই কবে প্রতিটি মানুষ পাবে সেই কাংখিত করোনা মহামারীর ভ্যাকসিন।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিক‚ল তথা বিশ্বজগত প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাদের জীবনেও সর্বদা ঘটে চলেছে ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। জীবনের সকল সময় এক অবস্থায় কাটে না। কখনো মানুষের কর্মফলের কারণে কখনোবা প্রকৃতির নিয়ম-নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে নেমে আসে দূর্যোগ, মহামারী নানা ধরনের বিপদ-আপদ ইত্যাদি। আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষেরা জানে যে এ সবই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় হয়ে থাকে। এতে তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে কারা ধৈর্য্যশীল আর কারা সহনশীল এবং কারা ধৈর্য্যহারা বা দুর্বল ঈমানের অধিকারী সে পার্থক্য করে নেন। পবিত্র কোরআনে বিপদে-আপদে ধৈর্য্যধারণকারীদের জন্য সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কোরাআনে সূরা তাগাবুনের ১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “কোন বিপদই আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া আসে না, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, তিনি তার মনকে হেদায়েত দেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞাত”।
“পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় অবতীর্ণ হয় তা আমি সংঘটিত করার পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। নিশ্চয়ই এটা খুবই সহজ আল্লাহর পক্ষে” (সূরা হাদীদ ২২ নং আয়াত)।

“আর তোমাদের উপর যেসব বিপদ আপতিত হয় তা তোমাদের কৃতকর্মের ফসল; আর তিনি অনেকগুলো তো মাফ করেন” (সূরা শূরা ৩০ নং আয়াত)।
“মানুষ বিপদে হতাশ হয় আর যখন কল্যাণ আসে তখন কার্পণ্য করে”(সূরা মাআরিজ ২০-২১ নং আয়াত)।

“তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরসহ আকস্মিকভাবে ভূমিকে ধসিয়ে দেবেন না, আর তা কাঁপতে থাকবে নাকি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর কঙ্কর বর্ষাবেন না? তখন জানতে পারবে কি কঠোর ছিল আমার সতর্কবাণী” (সূরা মূলক ১৬-১৭ নং আয়াত)।
“তারপর যখন আমি তাদের রক্ষা করি তখন তারা জমিনে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে; হে মানুষ! তোমাদের বিদ্রোহ তোমাদের উপরেই বর্তাবে, পার্থিব জীবনের সুখ মাত্র ক্ষণিকের; তারা পরে আমারই কাছে আসবে” (সূরা ইউনুস ২৩ নং আয়াত)।

কোরআন পাকে আল্লাহতায়ালা মুমিন বা বিশ্বাসী মানুষকে ধৈর্য্য ধারণ করার উপদেশ দিয়ে ঘোষণা করেছেন “তিনি ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন”। তিনি পবিত্র কোরআনে মুমিনদের ধৈর্য্য ও সালাতের মাধ্যমে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছেন। ধৈর্য্য আল্লাহর একটি বড় গুণ। বিপদাপদে ধৈর্য্যের মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা সত্গুণাবলী বিশিষ্ট মানুষের প্রকৃতি বা আদর্শ। তিনি সূরা আসরের ১-৩ নং আয়াতে বলেন “কালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে, ঐ সকল লোক ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, নেক কাজ করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ প্রদান করতে থাকে ও একে অন্যকে ধৈর্য্যের উপদেশ প্রদান করে”।

“অতএব (হে নবী) ধৈর্য্য অবলম্বন করুন দৃঢ়সংকল্প রাসুলদের মতো”( সূরা আহকাফ-এর ৩৫ নং)।
“তোমাদের নিকট যা আছে তা শেষ হয়ে যাবে এবং আল্লহর কাছে যা আছে তা কখনো শেষ হবে না। আর যারা ধৈর্য্যশীল তাদেরকে কাজের চেয়ে উত্তম পুরস্কার দিবো” (সূরা নাহলঃ ৯৬)। “ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, অবশ্য এটা অত্যন্ত কঠিন, বিনয়ী লোকদের ছাড়া অন্যদের নিকট” (সূরা বাকারাঃ ৪৫)।

সূরা হজ্জঃ ৩৫ নং আয়াতে “যাদের হৃদয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে ভয়ে কম্পিত হয়, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করে এবং যথাযথভাবে নামায পড়ে এবং তাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে ( তারা বিনীত)”।
কালের প্রবাহে আমরা যখন বর্তমান যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মহামারীতে বেষ্টিত হয়ে পড়েছি তখন আমরা অনেকেই ভাবছি আমাদের সময় কাল তো শেষ কিন্তু চিন্তা হয় নতুন প্রজন্মের জন্য। তাদের সামনে তো পুরো জীবনটাই পড়ে আছে। তারা কিভাবে সুস্থ স্বাভাবিকরূপে বেঁচে থাকবে। সামনের ভবিষ্যত পৃথিবী কেমন হবে তা যখন আমরা কেউই নিশ্চিত বলতে পারিনা সুতরাং সেসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ যিনি আমাদের সৃষ্টি করে এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনিই আমাদের তাঁর ওপর নির্ভর করতে ও ভরসা রাখতে বলেছেন। কারও উপর নির্ভর না করে একমাত্র আল্লাহর উপর সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করাকেই তাওয়াক্কুল বলে। “যে আল্লাহতে ভরসা করে, তাঁর জন্য তিনিই যথেষ্ট” (সূরা তালাকঃ ৩ নং আয়াত)।

হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় চায় আল্লাহ তার সকল কার্য সহজ করে দেন, আল্লাহই তার যথেষ্ট সহায়, কিন্তু যে ব্যক্তি পৃথিবীর আশ্রয় লয় আল্লাহ তাকে দুনিয়ার সাথে ছেড়ে দেন। আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকল আশ্রয় ছেড়ে শুধু আমার আশ্রয় নিয়েছে, সমগ্র পৃথিবী ও আকাশসমূহ তার বিরূদ্ধে দাঁড়ালেও আমি তাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবো”। রাসুলাল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি তোমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করতে পার তবে তিনি এমন অজানা স্থান হতে রিযিক দিবেন যা তোমরা ধারণাও করো নাই, যেরূপ তিনি পাখীদিগকে দিয়ে থাকেন, পাখীরা সকালে অভুক্ত অবস্থায় বাসা ছেড়ে যায় এবং সন্ধায় পেট ভরে আনন্দে বাসায় ফিরে আসে”।

তবে কাজ না করে শুধু কাজের ফলের জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করা তাওয়াক্কুল নয়। নিয়মিতভাবে কাজ করতে হবে ও চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ মানুষকে শ্রমজীবী করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও মাতা হাওয়া-কে বেহেশত হতে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্যে বিভিন্ন উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তাঁরা পরিশ্রম করে তা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। পরিশ্রমীকে আল্লাহ ভালোবাসেন, আর অলস ও পরনির্ভরশীলকে ঘৃণা করেন। পবিত্র কোরআনে তিনি মানুষকে ইবাদতের পাশাপাশি পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করার তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন “অনন্তর নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি, নিশ্চয় আছে কষ্টের সাথে স্বস্তি। অতএব আপনি অবসর পেলে সাধনা করবেন আর আপনার প্রতি মনোনিবেশ করবেন” (সূরা ইনশিরাহ ৫-৮ নং আয়াত)। “আর মানুষ কেউ কারো গুনাহ বহন করবে না, শুধু নিজের চেষ্টা অনুযায়ীই পাবে, শীঘ্রই তার কর্ম দেখানো হবে, সে তার পূর্ণ প্রতিফল পাবে” (সূরা নাজম ৩৯-৪১ নং আয়াত)।

মহামারীর বর্তমান এই পরিস্থিতিতে আমাদের সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার উপর ধৈর্য সহকারে নির্ভর করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে যেমন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, নিয়মিত হাত ধোয়া, বাইরে বেরুলে মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার করা, বাইরে বেরুলে মানুষের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলা, সুষম খাদ্য গ্রহণ,নিয়মিত ব্যায়াম করা ইত্যাদি। তাছাড়া যেকোন প্রয়োজনে অসুস্থতায় ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা। ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানী যেমন ফাইজার, মডার্না ও এষ্ট্রোজেনিকা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফলতা অর্জন করেছে এবং আশা করা যাচ্ছে আমরা মাস কয়েক-এর মধ্যেই ভ্যাকসিন পেয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ্।