আরিফ ভূঁইয়া

আরিফ ভূঁইয়া : পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই এক একটি পৃথিবী। সব ভূখণ্ডের মত ‘ম্যাপল লীফ’ এর দেশ কানাডার মানুষের মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভুত বৈচিত্র্যময়তা। এদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলের সংস্কৃতির এক স্রোত বয়ে যায় কানাডার জনপদ থেকে জনপদে আর প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। একেবারে নিজস্ব ভাবনা, চিন্তা আর জীবনযাপনের এই মানুষগুলোর স্বরূপ অনুসন্ধানে প্রতি সপ্তাহে একজনকে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের সামনে উপস্থাপন করছেন চলচ্চিত্রকর্মী আরিফ ভূঁইয়া। ‘ম্যাপল লীফ’ এর প্রথম অনুসন্ধানে তিনি কথা বলেছেন তাঞ্জানিয়ায় জন্ম নেয়া কানাডার নাগরিক এবং একজন সফল ইন্ট্রাপ্রনার আলকরিম চতুর এর সঙ্গে।

আরিফ : আপনার নাম?
আলকরিম : আলকরিম চতুর
আরিফ : আপনার জন্ম কোথায়?
আলকরিম : নর্দান তাঞ্জানিয়ার সিনইয়ানগা শহরে।
আরিফ : আপনার পিতা-মাতা কোথায় জন্মেছেন?
আলকরিম : ভারতে।
আরিফ : আপনি ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলতে পারেন?
আলকরিম : গুজারাতি, কাচ্চি, হিন্দি।
আরিফ : কানাডা আপনার কেমন লাগে?
আলকরিম : ভাললাগে।
আরিফ : কেন ভাল লাগে?
আলকরিম : ভাল লাগে কারণ, দেশটিতে নাগরিকদের জন্য সম্ভাবনার সকল দরজা খোলা। যে কেউ এখানে মেধায়, পরিশ্রমে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন। সফল হতে পারেন।
আরিফ : জীবিকার জন্য আপনি কি করেন?
আলকরিম : আমি একজন ইন্ট্রাপ্রনার।

আরিফ : আপনি কি এতে সন্তুষ্ট?
আলকরিম : হ্যাপিনেস বিষয়টা সাব্জেক্টিভ। আমার কজের ফলে যখন দেখি একজন অপ্রথাগতভাবে অথবা ‘আউটসাইড দ্য বক্স’ চিন্তা করছে, তখন সেটা ভীষণ আনন্দ দেয়।
আরিফ : আপনি কোন শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন?
আলকরিম : ১৯৮২ সালে আমি তানজানিয়া থেকে কানাডায় আসি। তখন আমার বয়স ১৮। এখানে এসে এখানকার পড়াশুনা শুরু করি। এখানে স্কুল পাশ করে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্পন্ন করি।
আরিফ : আপনি কি আপনার বর্তমান অবস্থায় নিজেকে সুখী মনে করেন? করলে কেন?
আলকরিম : অবশ্যই মনে করি। কারণ আমার কাজ আমাকে আনন্দ দেয়।
আরিফ : আপনি কোন কাজ করতে সবচেয়ে আনন্দ পান?
আলকরিম : আমার বর্তমান পেশায় আমি আনন্দিত। যখন দেখি কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান আমার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে অথবা আমার কাজের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করছে, তখন আমি খুবই আনন্দ পাই।

আরিফ : কোন কাজ আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়?
আলকরিম : হয় বৈ কি? একাউন্টিং! আমার অপছন্দের কাজ। কিন্তু করতে হয়। আমি কাজ জমিয়ে না রেখে কাজগুলো সব সময় সময়মত শেষ করি। আর কাজ শেষ হবার পর নিজের মধ্যে এক অন্যরকম আনন্দ হয়।
আরিফ : আপনি কেমন সমাজ বা পৃথিবী চান?
আলকরিম : জাপানের ইকিগাইদের মত ভাবতে পারা যেত যদি! শতায়ু পেরুনো মানুষের সংখ্যা জাপানের অকিনাওয়া দ্বীপে সবচেয়ে বেশি। কেন? কারণ মুলত চারটি-
* তুমি তাই কর যা তুমি করতে ভালোবাস
* তোমার কাজে তুমি ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠো
* এই কাজ থেকেই তুমি উপার্জন কর – মেইক ইউর প্যাশন ইউর প্রফেশন।
* সবশেষে তোমার এই কাজ কি করে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় সেটা ভাব।
জাপানিজ ভাষায় ‘ইকি’ অর্থ জীবন। ‘গাই’ হল অর্থ বা মুল্য বা উদ্দেশ্য। ‘ইকিগাই’ আসলে অর্থপূর্ণ এক জীবন যাপন। মানুষ অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করবে এমন সমাজের কথাই আমি ভাবি।

আলকরিম চতুর

আরিফ : এমন সমাজের জন্য কি আপনি কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আলকরিম : আমি আমার কাজকে ভালবাসি। মাদার তেরেসা যেমন বলেছিলেন, “আমি গোটা পৃথিবী হয়ত বদলাতে পারব না। কিন্ত জলের মধ্যে পাথর ছুড়লে যে রকম তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সে রকম তরঙ্গ নিশ্চয়ই সৃষ্টি করতে পারব।” আমিও আমার কাজের মধ্য দিয়ে সব সময় সে রকম কিছু করতে চেষ্টা করি।
আরিফ : আপনি কি মনে করেন সরকার জনবান্ধব?
আলকরিম : অন্য অনেক দেশের তুলনায়তো অবশ্যই।
আরিফ : সরকারের কোন কাজ আপনার ভালো লাগে? আর কোনটা ভালো লাগে না?
আলকরিম : অভিবাসীরা শুধু যে তাদের সংস্কৃতি নিয়ে এখানে পাড়ি জামায় শুধু তা নয়। নিজের সংস্কৃতি চর্চা করতে রাষ্ট্র প্রায় সকল রকম পৃষ্ঠপোষকতা করে। কানাডা কালচারালি সত্যিই একোমডেটিং।
বিভিন্ন সময়ে সরকার তার ভ্যালু ক¤েপ্রামাইজ করে কিংবা করতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে অন্য কোন দলের সাথে জোটগতভাবে যখন সরকার গঠন করতে হয়।

আরিফ : জনগণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য সরকারের কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ?
আলকরিম : প্রথার বাইরে চিন্তা করবার সময় এখন এসেছে। ওয়েলফেয়ার সিস্টেম কতটা কাজে দিচ্ছে অথবা কিভাবে আরও কার্যকর একটি ওয়েলফেয়ার সিস্টেম দাঁড় করানো যায় সেটা ভেবে দেখতে হবে। হেলথ কেয়ার সিস্টেমের রিফরম্যাটিং প্রয়োজন।
আরিফ : আপনি কি গান শুনেন, বই পড়েন এবং সিনেমা দেখেন?
আলকরিম : গানের চেয়েও মিউজিক বেশি শোনা হয়। কনেনন্ড্রাম, ভাইব্রেশনাল এবং স্পিরিচুয়াল মিউজিক। নিয়মিত বই পড়ি। পাবলো কহেলোর ‘আলকেমিস্ট’ বইটি খুব ভাবায় আমাকে। সিনেমাও দেখি, মূলত থ্রিলার।
আরিফ : আপনাকে যদি এক মাসের জন্য কানাডার প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তাহলে আপনি কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
আলকরিম : ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আউটসাইড বক্স চিন্তা করা জরুরি। আমাদের সিস্টেমেটিক লেগেসি রয়েছে। পলিসি মেকারগণ এক্সিস্টিং সিস্টেমকে সামনে রেখে তারপর ভাবছে। সব সময়ে এইভাবে ভাবলে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরী হয়। প্রধানমন্ত্রী হলে কিছু বিষয় শুন্য থেকেই শুরু করতাম। আমাদের সরকার অনেক বেশি রিএক্টিভ দ্যান প্রোএক্টিভ।

আরিফ : জীবন আপনার কাছে কেমন? আপনার কাছে জীবনের মানে কি?
আলকরিম : জীবন আমার কাছে এক অপ্রতিহত শক্তি। এটা উপলব্ধি করা জরুরী যে, তুমি জন্মেছ এবং কেউ তোমাকে থামিয়ে দিতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি নিজে থেকে থেমে যাও।
আরিফ : আমাকে সময় দেবার জন্য ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আলকরিম : আমি আমার মন থেকে ‘বাংলা কাগজ’ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার মত অন্য সংস্কৃতির একজনের সাথে জীবনের কথা বলার জন্য। নিঃসন্দেহে, এমন উদ্যোগ কানাডায় বসবাসরত বিভিন্ন ধরনের মানুষকে জানার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিবে। আমার মনে হয়, এটাই কানাডার মাল্টিকালচারালিজম এর মূল স্পিরিট। কানাডায় বহু সংস্কৃতি, বর্ণ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেয়া মানুষ বাস করে। কিন্তু আমরা সবাই এই দেশটিকে সত্যিকারভাবেই আমাদের দেশ মনে করি। এই অনুভূতিটা সত্যিই খুব সুখের। আপনাকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ।