মেহেদী হাসান: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার তৈয়ব নেছাকে গত রবিবার সকাল সাড়ে ১১টায় ফোন করা হলে ওপাশ থেকে ধরেন তাঁর পরিবারের এক সদস্য। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে অবৈধভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ফজলুর রহমানের বিষয়ে জানতে চাওয়াই ছিল ফোন করার উদ্দেশ্য। তৈয়ব নেছা ফোন ধরে প্রথমে ভেবেছিলেন তাঁর ছেলে ফজলুর রহমান ফোন করেছেন। ভুল ভাঙার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তৈয়ব নেছা কালের কণ্ঠকে বলতে থাকেন, বাংলাদেশ ছাড়ার পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো খোঁজ নেই ফজলুর রহমানের। কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, খাওয়াদাওয়া করতে পারছেন কি না কিছুই জানেন না তিনি।
তৈয়ব নেছা জানেন না তাঁর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে পারেননি। নোয়াখালীর দালাল সাকিবের মাধ্যমে ২২ লাখ টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়লেও হয়তো কোনো দিনই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে পারবেন না। তিনি এখন আছেন মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ রাজ্যের একটি বন্দিশিবিরে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত শুল্ক এড়াতে মেক্সিকো গত জুন মাসে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী আশ্রয়প্রার্থীদের ঢল এক-তৃতীয়াংশ কমাতে রাজি হয়। এতে গত আগস্ট মাসে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের হার কমে যায়। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ৫১ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীকে গ্রেপ্তার করে।
মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যাসাইলামপ্রার্থীরা মেক্সিকোতেই থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডুরাস, এল সালভাদর ও গুয়াতেমালার সঙ্গেও অনুরূপ চুক্তি করেছে। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাসাইলামপ্রত্যাশীদের আবেদনের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই দেশগুলো তাদের ‘রেসিডেন্স পারমিট’ (থাকার অনুমতি) দেবে।
মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হুন্ডুরাস ও এল সালভাদরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রাখার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংঘাত ও দারিদ্রপীড়িত ওই দেশগুলোতেও বছরের পর বছর ধরে আশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে এরই মধ্যে বোঝা হয়ে উঠা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তারা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে দেবে না।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে মেক্সিকোর অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ৩১১ জন ভারতীয়কে বহিষ্কার করেছে। মেক্সিকোর ন্যাশনাল মাইগ্রেশন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মেক্সিকোতে নিয়মিত অভিবাসনের যোগ্যতা রাখে না—এমন ৩১১ জনকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অভিবাসনপ্রত্যাশী ভারতীয়দের এভাবে বহিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর জন্য একটি কড়া সতর্কবার্তা। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটার জোর আশঙ্কা আছে।
মেক্সিকোর অভিবাসন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি মেক্সিকোতে ঢুকেছে। মাত্র ৪১ জন বাংলাদেশিকে মেক্সিকো কর্তৃপক্ষ ওই দেশটিতে ঢুকতে দেয়নি। বর্তমানে দেশটির বন্দিশিবিরগুলোতে ১৭২ জন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থী আটক আছে। এর বাইরে মেক্সিকোর বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাসাইলামপ্রত্যাশী আরো ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি থাকার তথ্য রয়েছে। সংখ্যাটি হাজার ছাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আশ্রয়ের জন্য এক হাজার দুই শর বেশি বাংলাদেশি মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। ওই সময়ের মধ্যে আট লাখ ৯২ হাজার বিদেশি আশ্রয়প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছিল। ট্রাম্প কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, আগামী এক বছরে এই সংখ্যা কোনোভাবেই ১৮ হাজারের বেশি হতে দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে মেক্সিকো সরকার বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছে কি না জানতে চাইলে মেক্সিকোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তিনি ঢাকায় এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
ঢাকায় সরকারি সূত্রগুলো বলছে, মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার তৎপরতার সঙ্গে আন্তর্দেশীয় চক্র বেশ কয়েক বছর ধরেই সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ বিষয়ে কঠোর হওয়ায় অন্য দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে।
সরকারি সূত্রগুলো আরো বলছে, মেক্সিকোতে অবৈধ অভিবাসীদের ঘিরে সৃষ্ট মানবিক সংকট সামাল দিতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর প্রতিনিধিদলের মেক্সিকো সফরের সুপারিশ এসেছে। এ ছাড়া দেশে ফিরতে আগ্রহীদের ফিরিয়ে আনতে ফ্লাইটের টিকিট কেনা এবং তাদের খাদ্য ও পোশাকের চাহিদা পূরণ করার জন্য ঢাকার কাছে অর্থ বরাদ্দও চেয়েছে দূতাবাস।