মনিস রফিক : বৃদ্ধাবস্থায় মানুষের শারীরিক ক্ষমতা কমতে থাকার সাথে সাথে বিভিন্ন মস্তিষ্কজনিত অসুখ শরীরে জেঁকে বসে। বর্তমানে কানাডায় ষাট বছরের বেশি মানুষের তিন ভাগের দুই ভাগই ‘ডিমেনশিয়া’য় আক্রান্ত। কানাডাসহ সারা পৃথিবীতে এ সংখ্যা দিন দিন আশংকাজনক হারে বেড়ে চলছে। বয়স্ক মানুষের জীবন, তাদের অবস্থান এবং তাদের মস্তিষ্কজনিত বিভিন্ন অসুখ নিয়ে “বাংলা কাগজ” এ লিখছেন মনিস রফিক। সত্য ঘটনার লেখাগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
ক্যাথরিনের ঘরে প্রথম ঢুকেই আমি চমকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছুতেই আমার কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে মৃত্যুপথযাত্রী এক সাদা মহিলার ঘরে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবো। ক্যাথরিনের বিছানার মাথার কাছে রাখা কম্পিউটার থেকে গানটা ভেসে আসছিল। আমি ধীরে ধীরে তার মাথার কাছে গেলাম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ক্যাথরিনকে দেখলাম গভীর ঘুমে মগ্ন। আমি বেশ কিছুক্ষণ তার মাথার কাছে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলাম, ভাবলাম সে জাগলে তার রবীন্দ্রপ্রীতি নিয়ে কথা বলবো, কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পরও তার সামান্যটুকু নড়াচড়া দেখলাম না।
তারপর আমি আমার অন্য কাজে ঢুকে পড়লাম। ওল্ড হোম থেকে বাড়ি ফেরার সময় আমি আবার ক্যাথরিনের ঘরে ঢুঁ মারলাম, তার মাথার কাছে দাঁড়ালাম, এমনকি তার মাথায় একটু হাত রাখলাম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তাকে সেই পূর্বের মতই ঘুমের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে ঠিক সেইভাবেই শুয়ে থাকতে দেখলাম। ওল্ড হোমে তার ঘরটা ছিল অন্যদের চেয়ে একবারে আলাদা। সারা ঘরটা দেখে মনে হতো একটা মিউজিক মিউজিয়াম। ঘুমন্ত ক্যাথরিনকে রেখে আমি একজন সংগীত পিপাসু দর্শক হয়ে তার ঘরটা দেখতে লাগলাম। হঠাত আমি থমকে গেলাম- আনন্দে, বিস্ময়ে। ক্যাথরিন তার বিছানার যে জায়গাই তার মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, তার সরাসরি সামনের দেয়ালে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। সাদা চুল দাড়ির সেই বাংলার রবীন্দ্রনাথ। তাকিয়ে আছেন পরম আশা আর আলো নিয়ে। ছবির নীচে লেখা -“Death is the Gateway of New Life” — Rabindranath Tagore. আমার মুহূর্তে মনে পড়ে গেল বাবার কথা। আমার ছোটবেলায় বাবা প্রায়ই আমাকে গল্প শুনাতেন। বিভিন্ন গল্প। কখনো পৃথিবীর মহান সব মানুষদের গল্প, আবার কখনো জীবনের নানা স্বরূপের গল্প। আমাদের পাশের বাড়ির একজনের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর বাবার কাছে মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। বাবা সেদিন মৃত্যু নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন। বাবা বলেছিলেন, যারা সুন্দর ও ভালো মানুষ তাদের কাছে মৃত্যু কোনো ভীতিকর বিষয় নয়, বরং বীর, মানবপ্রেমিক ও সৎ মানুষরা হাসিমুখে মৃত্যুকে স্মরণ ও বরণ করে নেয়। বাবা তখন জানিয়েছিলেন, মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি, “মৃত্যু নবজীবনের সিংহদ্বার।” কী অদ্ভুত বিষয়, সেই কোনকালে বাংলাদেশের রাজশাহীতে যে কথা শুনেছিলাম, তারই প্রতিধ্বনি শুনলাম কানাডার টরন্টোর ওল্ড হোমে এক মৃত্যুপথযাত্রী সাদা মেয়ের ঘরে। সত্যি বড় অদ্ভুত এই মানবজীবন! আমার আবার মনে পড়ে গেল ররি ঠাকুরের গানের সেই লাইন- “তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় নাতো কিছু …”
টরন্টোর এক্সটেনডিকেয়ার রুজ ভ্যালী নামের ওল্ড হোম এ কাজ শুরু করার পর প্রতিনিয়ত এমন সব মানুষের সাথে পরিচয় হয় যে, মনে হয় জীবনের অনেক কাহিনীই আমাদের কল্পনাকে হার মানায়। বাংলাদেশে ওল্ড হোম বলতে আমরা যা ভাবি, কানাডায় সেটাকে বলা হয় ‘লং টার্ম কেয়ার হোম’। কানাডা এবং পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখন বৃদ্ধ মানুষদের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু পরিবার প্রথা দিন দিন ছোট হতে থাকায়, একটা সময়ের পর অধিকাংশ বৃদ্ধ মানুষেরা নিজেদের ইচ্ছেয় চলে আসে এ সব বৃদ্ধনিবাসে। বয়স্ক মানুষদের জন্য কানাডায় তিন ধরনের সেবার ব্যবস্থা আছে। এদের একটি লং টার্ম কেয়ার হোম, আর অন্য দুটি হচ্ছে রিটায়ারমেন্ট হোম এবং এডাল্ট ডে কেয়ার। সরকারিভাবে এই সেবা দেয়া হলেও, কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই সেবা বা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। অধিকাংশ কানাডিয়ানরা মনে করে, বয়স্ক অবস্থায় সন্তানদের সাথে নিজের বাড়িতে না থেকে এ সব প্রতিষ্ঠানে থাকা অনেক ভালো। রুজ ভ্যালিতে কাজ শুরু করার পর আমারও মনে হয়েছে, বৃদ্ধ অবস্থায় অধিকাংশ মানুষেরই উচিৎ এমন কোন এক ব্যবস্থায় চলে আসা। কানাডায় ৬৫ বছরের পর অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন ধরনের ডিমেনশিয়াতে ভুগে। মস্তিস্কের নিউরণ কোন কারণে সংকুচিত বা ধ্বংস হয়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের ডিমেনশিয়া হতে পারে। প্রায় একশ রকমের ডিমেনশিয়ার মধ্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে আলঝেইমার আর পারকিনসন্স এর নাম। এই সব ডিমেনশিয়াগ্রস্থ মানুষদের বাড়ির পরিবেশে রেখে সেবা দেয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশেও বয়স্ক মানুষেরা মস্তিস্কের এই সব রোগের শিকার হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো কখনও কানাডার মত যতœ সহকারে দেখা হয় না। কানাডার এই সব ওল্ড হোমগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনি সেগুলোতে রয়েছে তাদের বিনোদনের প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থা। ফলে বৃদ্ধ অবস্থায় একজন খুব সহজেই এই জায়গাটাকে নিজের আপন জগত মনে করে নিতে পারে। পনের বছর ধরে ক্যাথরিনও রুজ ভ্যালীকে তার আপন জগত হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
ক্যাথরিনের সাথে আমার কখনো কোনো কথা হয়নি। আমি ওল্ড হোমে কাজ শুরুর প্রায় এক মাস আগে থেকেই সে কথা বলা এমনকি চোখ মেলে তাকানোও বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি সেই হোমে যাবার কিছুদিন পর তাকে প্যালেটিভ কেয়ার এ নেয়া হলো। প্যালেটিভ কেয়ার হলো এমন এক জায়গা বা সময় যেখানে আসন্ন মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ার জন্য একজনকে প্রস্তুত করা হয় বা একজন ধরেই নেয় সে আর কয়েকদিন পর মৃত্যুবরণ করবে।
প্যালেটিভ কেয়ারে ক্যাথরিনকে যেদিন নিয়ে যাওয়া হলো তার তিন দিন আগে তার আটাশিতম জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন করা হয়েছিল ওল্ড হোমের হল রুমে। হুইল চেয়ারে আধো শোয়া অবস্থায় ক্যাথরিন সেই অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যেই আলতো করে চোখ মেলে তাকিয়ে শান্তভাবে হেসেছিল। জন্মদিন পালনের সময় প্রায় এক ঘন্টা ধরে বাজানো হয়েছিল ক্যাথরিনের পছন্দের সব গান। প্রায় পনের বছর ক্যাথরিন এই ওল্ড হোমে। ফলে এই জায়গার উপর তার একটা অন্যরকম ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া তার সব সম্পত্তি সে দান করে দিয়েছে অসহায় বৃদ্ধ মানুষের সেবায়। জন্মদিনে যে সংগীত বাজানো হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত। “জীবনো মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে …” সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে। আমি শুধু বিস্মিত হচ্ছিলাম। একজন সাদা কানাডিয়ানের কাছে আমাদের রবীন্দ্রনাথ কীভাবে এমন হৃদয়ের ভিতরে ঢুকে গেলেন!
ক্যাথরিন আমার মনোজগতে যে অপার এক বিস্ময়ের কারণ হয়ে গিয়েছিল তার সমাধানের জন্যই আমি আমার সুপারভাইজার লোরিন্ডা ক্রাফোর্ড এর কাছে ক্যাথরিনের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। লোরিন্ডা আমার এই আগ্রহের কারণ জানতে পেরে তার স্বভাবসূলভ হাসি হেসেছিল। সে শুধু বলেছিল, আমার দীর্ঘদিনের এই ওল্ড হোমের কাজে শুধু ক্যাথরিনকে দেখেছি কখনো মৃত্যুকে ভয় করেনি। নিজের জীবনে তার অনেক কষ্ট ছিল কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করেনি। বরং নিজে মৃত্যুর শেষ প্রান্তে এসেও মৃত্যু নিয়ে তার কোনো আতংক ছিল না। সে মৃত্যুকে আলিংগন করার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেকে প্রস্তুত করছিল। লোরিন্ডার কথা শুনে ক্যাথরিনের প্রতি আমার আগ্রহ আরো বেশি বেড়ে যাচ্ছিল।
লোরিন্ডার কাছেই জেনেছিলাম ক্যাথরিনের পূর্ব পুরুষরা এ দেশে এসেছিল আয়ারল্যান্ড থেকে। বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। ক্যাথরিনের জীবনের শুরুটা কাটে কিছুটা বেহিসেবী আর উচ্ছৃংখলভাবে। বেশ কয়েকটি বিয়ে হয়েছিল কিন্তু কোথাও স্থিতি হয়নি। শেষ বিয়েটা হয়েছিল টমাসের সাথে। তখন ক্যাথরিন পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। টমাস ছিল কিছুটা দার্শনিক ধরনের মানুষ, সংগীতপ্রেমী। এই টমাসের সাথে তার যে সংসার গড়ে উঠে তাতে ক্যাথরিনের জীবনটা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। খুব অদ্ভুত ব্যাপার সেই বয়সেই ক্যাথরিনের প্রথম সন্তান হয়েছিল। ছেলে সন্তান, নাম রেখেছিল ডেভিড হোপ। সন্তান হবার পর ক্যাথরিন আরো বেশি পরিবর্তিত হতে থাকে। এক সময়ের ধনীর বখাটে বেহিসেবী মেয়ে তখন পুরোদস্তুর গৃহিণী।
পরম শান্তির সময় কাটিয়েছিল ক্যাথরিন বেশ কয়েক বছর। টমাস আর হোপ’কে পেয়ে ক্যাথরিন জীবনের সব হতাশা কাটিয়ে এক নতুন ভালোবাসার জীবনে সুখী হতে থাকে। অন্যরকম সুখ আর আনন্দে কেটে যাচ্ছিল তার জীবন। কিন্তু হয়তো সবাই ইচ্ছে করলেই সুখী হতে পারে না। কথাগুলো বলতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম লোরিন্ডার গলাটা কিছুটা ধরে আসলো।
ক্যাথরিনের আদরের উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত হোপ ষোল বছর না পেরুতেই মারা গেল। হঠাত করেই একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। তরতাজা কিশোর হোপ বিকেলের খেলা শেষে বাড়ীতে ফিরছিল। খেলার মাঠের কাছেই বাড়ী। মাঠ থেকে হেঁটেই বাড়ীতে ফিরছিল হোপ। এদিকে ক্যাথরিন আর টমাস তাদের প্রিয় কুকুরকে নিয়ে বের হয়েছেন বৈকালিক হাঁটায়। হোপ ঘরে ফিরছে আর ক্যাথরিন আর টমাস বাড়ীর সামনের ফাঁকা জায়গাই হাঁটছে, সংগে তাদের প্রিয় কুকুর জেনি। হোপকে দূর থেকে দেখেই জেনি মাঝের রাস্তা পেরিয়ে ছুটে আসতে চাইল তার দিকে। সেই রাস্তা দিয়েই আস্তে করে ছুটে যাচ্ছিল একটা গাড়ী। হোপের মনে হলো গাড়ীর মধ্যে ঢুঁকে যাচ্ছে জেনি, ফলে ছোঁ মেরে তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে গাড়ীর সাথে ধাক্কা খেলো সে, গাড়ীর চালক সাধ্যমত গাড়ীর গতি কমিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু গাড়ীর সম্মুখটা এসে লেগেছিল হোপের বুকে। বাবা মার চোখের সামনেই ছটফট করতে করতে হোপ মৃত্যু হয়েছিল। মৃত হোপকে কোলে নিয়ে পাগলের মত উদ্ভ্রান্ত টমাস হাসপাতালের দিকে ছুটছিল আর তখনই তার হার্ট এটাক হয়। মুহূর্তের মধ্যে এমন এক ছিন্নভিন্ন করা ঝড় ক্যাথরিনের জীবনের সব আনন্দ, সুখ আর ভালোবাসাকে এক লহমায় উড়িয়ে নিলো।
ক্যাথরিনের জীবনে এমনই এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে। তারপর প্রায় তিন বছর তার নির্বাক সময় কেটেছে, একবারে কথাহীন এক ফ্যালফ্যালে জীবন। শুধু পলকহীনভাবে চেয়ে থাকা আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়া।
লোরিন্ডার কথাগুলোয় আমার মনের অজান্তেই আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। আমি জানতে চাইলাম, তারপর। লোরিন্ডা জানিয়েছিল, প্রায় পাঁচ বছর ক্যাথরিনকে মিউজিক থেরাপী দেয়া হয়েছিল আর সেটাতেই সে আবার পরিপূর্ণভাবে সেরে উঠে। ক্যাথরিন সেরে উঠার পর নিজের বাড়ীতে তাকে বড় বেশী একা লাগছিল, ফলে নিজে থেকেই সে এই ওল্ড হোমে নিজের নতুন আবাস গড়ে তোলে। তখন ক্যাথরিন তিয়াত্তরে পা দিয়েছে। একা একা চলা ফেরা করতে পারতো না। তবে অদ্ভুত বিষয় এখানে এসে ক্যাথরিন সুস্থ হতে থাকে এবং একজন সুস্থ্ স্বাভাবিক মানুষের মত সব কাজ নিজেই করতে পারতো। শুধু তাই নয় অন্যদের সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতো। লোরিন্ডা এবার একটু থেমে ক্যাথরিনের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিয়ে বললো, জানো রফিক, ক্যাথরিন তার সমস্ত সম্পত্তি অসহায় দুস্থ বয়স্ক মানুষদের মঙ্গলের জন্য দান করেছে। আর তার সম্পত্তির পরিমাণ কিন্তু অনেক!
লোরিন্ডার কথাগুলো শুনে কেনো যেনো আমার চোখটা বারবার জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল কেনো আমি ক্যাথরিনের সাথে একটু কথা বলতে পারলাম নয়া, কেনো তার একটু সেবা করতে পারলাম না। এবার আমি লোরিন্ডার কাছে তার ঘরে যেসব ছবিগুলো টাঙানো আছে তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম, লোরিন্ডা সে সম্পর্কে পরিস্কার কিছু বলতে পারলো না। শুধু বললো, ঐ ছবির মানুষগুলো সব ক্যাথরিনের কাছে মহামানব। তাদের কথা ও সংগীতে ক্যাথরিন জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে, সেজন্য সে সবাইকে এমনভাবে তার ঘরে রেখেছে যে মনে হয় তাদের পরম ছায়ায় সে তার দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছে।
আমি রবীন্দ্রনাথের ছবি ও গান সম্পর্কে জানতে চাইলাম। লোরিন্ডা পূর্বের মতই কিছুটা অপরিস্কার ধারণা নিয়ে বলেছিল, টেগোরের গান ও বাণীর প্রতি ক্যাথরিনের গভীর ভক্তি ছিল। টমাস ও হোপ মারা যাবার পর ক্যাথরিন নির্বাক হয়ে যায়, এক সময় সে আত্মহত্যা করতে যায়। সে সময় ক্যাথরিন টেগোরের গান শুনে অভিভূত হয়ে পড়ে। পরে টেগোর সম্পর্কে জানতে গিয়ে তার মৃত্যু নিয়ে ওই উক্তিটি তার চোখে পড়ে। তখন সে উপলব্ধি করে, যেহেতু আত্মহত্যা পাপ, অতএব আত্মহত্যা করলে মৃত্যুর পর টমাস আর হোপের সাথে তার আর দেখা নাও হতে পারে। আর যেহেতু মৃত্যুর পথ দিয়ে আমরা আরেকটি জীবনে যেতে পারি তাহলে সেই নতুন জীবনে সে তার টমাস আর হোপকে ফিরে পাবে, অনন্তজীবনের জন্য — যেখান থেকে কোনো কিছুই তার কাছ থেকে তার প্রিয় স্বামী আর সন্তানকে কেড়ে নিতে পারবে না।
আমি বাড়ী ফেরার আগে দূর থেকে ক্যাথরিনকে প্রবল শ্রদ্ধা নিয়ে দেখে নিলাম আর মনে মনে বললাম, তুমি সুস্থ্ হয়ে জেগে উঠো ক্যাথরিন, তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে, আমি আমার সারাজীবন তোমার সেবা করতে চাই।
তার তিনদিন পর ক্যাথরিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। মৃত ক্যাথরিনকে যখন তার বিছানা থেকে তোলা হচ্ছিলো তখন তার পোষাকের ভিতর থেকে একটা চিরকূট বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল, যেটাতে লেখা ছিল, Death is the Gateway of New Life.
মৃত ক্যাথরিনের মুখটায় আমি আস্তে করে হাত রেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, ও পরম আনন্দে হাসছে। আটাশি বছরের ক্যাথরিনের মুখটা আমার কাছে বড় বেশী প্রশান্তিময় মনে হয়েছিল তখন। আমার তখন কেন যেন বার বার মনে হচ্ছিল, অনন্ত জীবনের মিলন মেলায় ক্যাথরিন খুঁজে পেয়েছে তার প্রাণের টমাস আর হোপ’কে।