Home কলাম মৃত্যুদিনে পিতৃ স্মরণ…

মৃত্যুদিনে পিতৃ স্মরণ…

সাজ্জাদ আলী : একঃ
মা-সর্বস্ব ছেলে ছিলেন আমার আব্বা। উঠতে মা, বসতে মা, পাশ ফিরতে মা! তাঁর জীবনজুড়ে ছিলো শুধু মা, আর মা। একটা নমুনা বলি তবে। সালিশি, মাতুব্বরি করে বাড়ি ফিরতে আব্বার বেশ রাত হতো। কোনো কোনো দিন তো গভীর রাত। বাড়িশুদ্ধ লোক তার জন্য জেগে! তো তিনি যখন ফিরলেন, তাঁর সাথে লোক দশ পনেরোজন। লোকেরা সব কাচারি ঘরে বসলো। খানিক বাদেই তাদের ডিনার চলে আসবে। আব্বা বাহির বাড়ির উঠোন দিয়ে হেঁটে এগুচ্ছেন। বেকি ব্যাড়া পেরিয়ে ভেতর বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই তাঁর মা ডাক শুরু হলো। মা, ও মা, মা গেইলা কই?

বড় ছেলের বাড়ি ফেরার ভাজ পেয়ে দাদীও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ততক্ষণে মা তাঁর ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে। বলছেন, এই যে আমি। কিন্তু কে শোনে দাদীর কথা। আব্বা ডেকেই চলেছেন, মা কো, মা! কিন্তু দাদী তো খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে কী ছেলে তাঁর মাকে দেখতে পাচ্ছে না?

গভীর রাত হলেও ভেতর বাড়ির উঠোন যে অন্ধকার, তা কিন্তু না। প্রতিরাতের মতই সেখানে হ্যাচাক লাইট জ্বলছে। সাদা শাড়ি পরিহিত দাদীকে দেখতে না পাবার কোনোই কারণই নেই। আব্বার চোখেও সমস্যা নেই, চশমা পরতে হয় না। দাদীকে তিনি ঠিকই দেখেছেন, তবুও তাঁর মা ডাক থামে না। আসলে মাকে ডেকে তাঁর মন ভরতো না তো, তাই এত ডাকাডাকি! অথবা বুঝতে পেরেছিলেন যে বেশি দিন আর ডাকতে পারবেন না!

সেই আশি সালে আব্বা চলে গেলেন। তখন আমার অপরিণত বয়স। মাতৃভক্তিটা তাঁর থেকে ঠিক মতো শিখেও রাখতে পারলাম না।

দুই.
কাচারি ঘরে সালিশ বসেছে। ছত্তার আর মোক্তার, দুই ভাইয়ের মধ্যে এজমালি সম্পতি নিয়ে বিবাদ। সেই সাওয়াল জবাব শুনতে সারা গাঁয়ের লোক জড় হয়েছে। পিন পতন নিরবতায় লোকে শুনানী শুনছে। ছত্তার বলছে, মা মরার আগে দক্ষিণ ডাঙ্গার চাইর বিঘা ভ‚ঁই আমারে দিয়া গ্যাছে।

মোক্তারের সোজাসাপ্টা জবাব, জমি হলো বাপের, মা তা দিবার কিডা?
আব্বা গর্জে উঠলেন, ওই হারামজাদা মোক্তাইর‌্যা, মা কেউ না, তাই না? তোরে জন্ম দিয়া তোর মা কি পাপ করছে? শোনরে শয়তান, কার জমি কে দেবে সে হইলো আইনের কথা। ও কথা তুই কোটকাচারিতে গিয়া কইস। তয় আমার কাচারির থেকে বাইর হইয়া কোর্টে যাওয়ার ক্ষমতা তোর বাপ দাদার ছেলো না। তোর আছে কিনা ভাইবা দ্যাখ! মারে অসম্মান কইরা যদি আর একটা কথা কইছিস, তাইলে কিন্তু তোরে এই ভরা মজলিশে জুতা পিটা করবো।

এমন সময় আড়কান্দির সালাম সরদার সাহেব কাচারি ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে আব্বা তো হতভম্ব! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন! এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ করে বললেন, কী সৌভাগ্য আমার! কাকা আপনি? আমারে খবর পাঠালেই তো পারতেন। কষ্ট কইরা আসার কী দরকার ছিলো?

হাটে মাঠে ঘাটে বাজারে মজলিশে আব্বার কাউকে “আসসালামু আয়ালাইকুম” বলার দরকার পড়তো না। শুধু “ওয়ালাইকুম আসসালাম” বলতে বলতেই তিনি বাড়ি ফিরতে পারতেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মমতা আর সুবিচারী ছিলেন বলেই মানুষ তাকে “সম্মান” ফেরত দিতো। তাঁর স্বল্প জীবত্কালে আল্লাহপাক তাকে যত ওপরে তুলেছেন, তিনি ততই মানুষের কাছে নত থেকেছেন। ইংরেজিতে যাকে বলে “ডাউন টু দ্য আর্থ”!

সালাম দাদাভাই আমাদের পূরোনো আত্মীয়। বৃহত্তর পরিবারের মধ্যে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান। সেদিন ভরা মজলিশে সরদার সাহেবকে দেখে আব্বার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগেনি। বড়’র কাছে নত হতে তাঁর কখনো কোনো দ্বিধা ছিলো না। আব্বা যদি আরো কিছু দিন বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই “নত হওয়াটা” শিখে রাখতে পারতাম।

তিন.
দাদী আব্বাকে বলতেন, দই খাইস না, ওয়া তোর প্যাটে সয় না। তাঁর এই কথাটা আব্বা রাখতে পারতেন না। রাতের খাওয়ার শেষে মেজচাচী পাতে এক চামচ দই তুলে দিতেন। এদিক ওদিক চেয়ে দইটুকু তিনি চেটেপুটে খেতেন। বলতেন, মাইজা বৌ মারে কইয়ো না।
দাদী ছেলেকে দই খেতে মানা করতেন বটে, কিন্তু সেই দই কিনে আবার মিটসেফ ভরে রাখতেন। মহারাজপুরের বঙ্কিম কাকুর দই তল্লাটের সেরা। তার কাছে দইয়ের মাসিক বায়না করা ছিলো। দাদী তাকে বলতেন, শোনো বঙ্কিম দই জানি মিঠা হয়। তোমাগো বড় মিয়া কিন্তু দই ভালো পায়।

আব্বা চলে যাওয়ার পরে দাদী দইয়ের বায়না তুলে নিয়েছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা আর অমন মিঠা দই কোনোদিন খেতে পাইনি!

Exit mobile version