ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টো ভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার বাইশ ও তেইশতম অন্তর্জাল আসর অনুষ্ঠিত হয় নভেম্বরের সাত ও ডিসেম্বরের বারো তারিখ।
বাইশতম আসরটি নিবেদন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে।
মুজিবের নিজ বয়ানে মুজিবকে জানার জন্যে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ – এই গ্রন্থত্রয়ী আমাদের পরম সম্পদ-আশ্রয়। শেখ মুজিবকে নিয়ে সব অস্বীকার-বিতর্ক-বিভ্রান্তি আর উন্নাসিকতার জবাব এই তিনটি বই। তাঁকে আগে ঢালাওভাবে বলা হতো নিছক একজন সংগঠক বা বড়জোর উদার হৃদয়ের একজন মানুষ। এই বই পড়ে আমরা জেনেছি শেখ মুজিব আর আমাদের জাতির ইতিহাস যে অবিচ্ছেদ্য। জেনেছি তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তির একজন সার্বক্ষণিক মুখপাত্র। চিনেছি ব্যক্তিগত জীবনকে বিসর্জন দেওয়া আত্মত্যাগী একজন জাতীয় নেতাকে যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় জেল খেটেছেন। আবিষ্কার করেছি একইসাথে প্রাজ্ঞ-সাহসী-উদার একজন মানুষকে যিনি আন্দোলন-সংগঠন-পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতির অনিবার্য এক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। আবিষ্কার করতে পেরেছি তিল তিল সংগ্রামে গড়ে ওঠা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে। স্বাধীন দেশেও আমরা পেয়েছিলাম এমন একজন পিতাকে যিনি একটা জাতিকে ধারণ করতে প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার স্থায়ীভাবে ফিরে পেতে এই ‘মুজিব ট্রিলজি’ আমাদের দরকার ছিল। এই তিনটি বই ঘিরেই ছিল পাঠশালার আয়োজন। আলোচনা করেন টরন্টো থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘নতুন দেশ’ এর সম্পাদক শওগাত আলী সাগর।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী সংকলন। ২০১২ সালের জুনে এ বইটি প্রকাশিত হয় ইউপিএল – দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে। এ পর্যন্ত বইটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের অনেক সময়ই কেটেছে জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। ১৯৬৬-৬৯ সালে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন। এ সময়টায় বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সহধর্মিণীর অনুপ্রেরণায় তিনি জীবনী লেখা শুরু করেন। এই বইয়ে তিনি ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। বইটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সম্পাদনা করেছেন লোকসাহিত্যবিদ ও গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রথম প্রকাশ মার্চ, ২০১৭তে, বাংলা একাডেমি থেকে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামটি দেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়ার পর মুজিব গ্রেফতার হন। ১৯৬৬র মে থেকে ১৯৬৮র জানুয়ারি, ২১ মাস তাঁকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়। ১৯৬৮র জানুয়ারিতে মুক্তি পাবার সাথে সাথেই আবার তাঁকে কুর্মিটোলা সামরিক জেলে বন্দি করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়? সেই সময়ে কারাগারে প্রতিদিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখাগুলি এই বইয়ে আছে। তবে শুরুর একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন কিন্তু আরেক খাতা থেকে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। ঐ সময়ের লেখা থেকে প্রথম অংশটি যুক্ত করা হয়েছে।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে, বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন ৩২, তখন ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন তিনি (ঐ বছরই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান)। ২৫ দিন থাকেন চীনে। সেই সময়ে ডায়রিতে টুকে রাখা স্মৃতি থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেন ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকার সময়। তাঁর সেই ভ্রমণের সাত দশক পর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামে বইটি বের হয়, ২০২০ এর বইমেলায়, বাংলা একাডেমি থেকে। ভূমিকা, রচনার প্রেক্ষাপট লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৫৭ সালে পূর্ব বাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি আরো একবার চীন সফর করেন। কিন্তু বইটা শুধু প্রথমবারের ভ্রমণ নিয়েই। তবে বইয়ের শেষে যুক্ত করা হয়েছে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বার চীন ভ্রমণের সময়কার বেশ কয়েকটি দুর্লভ আলোকচিত্র।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ – এই তিনটি বই আলোচনার মাধ্যমে, মুজিবের বয়ানেই মুজিবকে নির্মোহভাবে তুলে ধরেন আলোচক শওগাত আলী সাগর।
পাঠশালার তেইশতম আসরটি নিবেদন করা হয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে।
টুকটাক গানের পাশাপাশি প্রথমজীবনে সাহিত্যে মজে ছিলেন এক তরুণ। গল্প লিখতেন। সমসাময়িক কবি, সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে রীতিমতো সাহিত্যসভা করতেন নিয়মিত। তাঁর লেখা ‘একটি ঘটনা’ নামে একটি গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় পর্যন্ত ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যিক না হয়ে, হয়ে উঠলেন তিনি সঙ্গীতের মানুষ। শুধু তাই না, হয়ে উঠলেন মধ্যবিত্ত বাঙালির সাঙ্গীতিক আইকন। মধ্যবিত্ত বাঙালির সাঙ্গীতিক অন্তরটি তাঁর মতো এত পরিষ্কারভাবে খুব কম সুরকার ও গায়কই অনুভব করতে পেরেছেন।
যথাযথ উচ্চারণ ও স্বরপ্রক্ষেপণ এবং সুরের পরিমিতি প্রয়োগ করে, গায়নরীতির সাবেকীয়ানা থেকে মুক্ত করে তিনি বাংলা গানকে উত্তীর্ণ করেছেন আরেক পর্যায়ে, করে তুলেছেন সমসাময়িক এবং পৌঁছে দিয়েছেন শত-কোটি বাঙালির অন্তরে।
এই শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
‘আনন্দধারা’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজ হাতে লেখা আত্মকথন। সাহিত্যের সাথে একসময় নিবিড় যোগ থাকায়, বইটিতে তিনি প্রাঞ্জল গদ্য উপহার দিয়েছেন।
‘আনন্দধারা’ ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় কোলকাতার ‘নিউ বেঙল প্রেস’ থেকে। ১৯৮৮ সালে ৫ম ও শেষ সংস্করণ বের হবার পর দীর্ঘদিন এটি বাজারে ছিল না। পরে সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে, অভীক চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, নব কলেবরে বের হয় ২০১৩ সালে।
হেমন্ত বলছেন – ‘এটা আমার আত্মচরিত নয়। আত্মপ্রচারের জন্যেও কলম ধরিনি। তবে এককালে লেখার অভ্যাস ছিল তাই আমার শিল্পজীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি। তাও করতে হয়েছে অনেকের অনুরোধে।
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন তো বলবো, শিল্পের পথ কণ্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সেই হিসেবে ভবিষ্যতের শিল্পীদের কাছে আমার অভিজ্ঞতার মূল্য হয়তো কিছুটা আছে।’
আসলেই তাই। বইটিতে হেমন্ত তাঁর নিজের অর্জনকে সেভাবে তুলেই ধরেননি, বরং অর্জনের পথ যে কতটা কণ্টকাকীর্ণ হয়, তারই গল্প বইটি জুড়ে।
একজন শিল্পীর জীবন কতটা ভঙ্গুর, কতটা ঝুঁকির তা বোঝা যায় বইটি পড়লে। আজ যেই শিল্পীর গান হিট এর জন্য সবাই ধন্যি ধন্যি করে, কালই একটা ফ্লপের জন্য তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে শ্রোতৃকূল বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। অনেক ভালো কাজ করেও, হিট না হলে, সেসব মূল্যহীন। আবার একবার লাইমলাইটে এসে গেলে, তখন মানহীন সঙ্গীতেরও স্তাবকের অভাব হয় না। হেমন্ত এক জায়গায় লিখছেন – “পরপর ছবি হিট হলে খাতির দেখে কে! কিন্তু একটা ফ্লপ হলেই শিল্পীর দফা শেষ? আমরা নামেই শিল্পী। আসলে আসন দেহপসারিণীদের এক ইঞ্চি উপরেও না। ওদের তবু যতদিন দেহ ততদিন বাজার? আর শিল্পীদের অনেকের গলা থাকতে থাকতেও গলাধাক্কা খেতে হয় সময় বিশেষে?” হেমন্ত এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বলেই হিন্দী ‘নাগিন’ কিংবা বাংলা ‘শাপমোচন’ চলচ্চিত্রের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তাতেও বিভ্রান্ত হননি, নিজেকে কেউকেটা ভাবেননি এবং এতেই হয়ত অতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুইটি সত্তা – গায়ক হেমন্ত ও সুরকার হেমন্ত। দুটি সত্তাই সমভাবে প্রবল। দীর্ঘ ৫ দশকেরও বেশি সময় জুড়ে (বাংলা ও হিন্দি) অজগ্র গানে কণ্ঠ, অজগ্র গানে সুর, অসংখ্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, সেসবের নানা অভিজ্ঞতা আর গল্প মিলে, বহুমাত্রিক সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক জীবনের যে বিশাল ব্যাপ্তি, তা লিপিবদ্ধ করতে গেলে হাজার পাতাতেও কুলাতো না। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ন যেমন পরিমিত-মেদহীন, তেমনি লেখাও। বিস্তীর্ণ সঙ্গীত জীবনের কেবল চুম্বক অংশগুলোই একদম নির্মোহভাবে এবং অকপটে তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’।
‘আনন্দধারা’ মোট ৩১৩ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে শখানেক পৃষ্ঠা জুড়ে আত্মজীবনী। আর বাকি ২১৩ পৃষ্ঠা জুড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের তালিকা। তালিকাটি তৈরি করেছেন জয়দীপ চক্রবর্তী। এই তালিকা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করবার সুযোগ আছে।
একজন শিল্পীর গড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার সাথে সাথে তখনকার সমাজের শিল্পের সামগ্রিক চালচিত্র ও বহু অজানা তথ্য মিলিয়ে একটি প্রয়োজনীয় ও একই সঙ্গে রসসিক্ত গ্রন্থ হলো এই ‘আনন্দধারা’।
‘আনন্দধারা’ ঘিরেই ছিল এই আসরের আয়োজন।
আসরের আলোচক ছিলেন আইএফ আইসি ব্যাঙ্ক সাহিত্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক খসরু চৌধুরী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে, ‘আনন্দধারা’ বইটি নিয়ে আলোচক খসরু চৌধুরীর আলোচনায় উঠে আসে — বাংলা, হিন্দি দুই গানেরই গায়ক হেমন্ত, সুরকার হেমন্ত, প্রযোজক হেমন্ত, পরিচালক হেমন্তের নিজ জীবনের গল্প সহ আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অনেক জানা-অজানা অধ্যায়।
পাঠশালার দুটো আসরেরই সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।