আকতার হোসেন : সোনার চামচ কিংবা রূপার চামচ কোনটাই আমার জন্য অপেক্ষায় ছিল না। ক্ষুধা যাদের জন্মশত্রু তাদের জন্য কোন কিছু অপেক্ষা করে না। জন্ম নিয়েছি কি অমনি ক্ষুধা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মনে হয়েছিল দুনিয়াটা খেয়ে ফেলি। কিন্তু খেয়েছিলাম কিছু বাতাস। বাতাস আমার প্রথম খাদ্য। চোখ মেলে দুনিয়াটা ভাল করে দেখার সুযোগও পেলাম না, অথচ ঘনঘন ক্ষুধার আক্রমণ হতে লাগল। আত্মরক্ষার জন্য অদ্ভুত এক শব্দ করে বসলাম। ওয়া-আ-আ। সাথে সাথে এক মধুর সরবত এসে ঘায়েল করে দিল ক্ষুধাটাকে। ওয়া-আ-আ আমার মাতৃভাষার প্রথম সবক।

দিনে দিনে যত বড় হতে লাগলাম পেটের মধ্যে একটা শূন্য জায়গা ততো বেড়ে উঠতে লাগল। সে জায়গাতে গড়ে উঠল খবিশ ক্ষুধার অবৈধ বস্তি। মাঝে মাঝে মনে হতো পা দুটো পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ক্ষুধার কোমরে লাথি বসিয়ে দেই। কিন্তু পারিনি। নিজের পেটে লাথি মারা আর অন্যের পেটে লাথি মারা দুটোই অন্যায়। গরীব হয়ে জন্মানোর একটাই অভিশাপ। গরীবরা অন্যায় করতে পারে না। তাদের অন্যায় সহ্য করতে হয়। এতসব কথা বলতাম না যদি গুঁজা নানীর কিছু কিছু অন্যায় মেনে নেয়া হতো।

গুঁজা নানীর কোন শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। কিন্তু মাঝেমাঝে তার গল্প শুনলে কানের ভেতর মরিচ বাঁটা পড়ত। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দারোয়ান ভাই, ‘কতি পার পোকামাকড় কাকপক্ষীরাও কি আমাগোর মতই গরীব। খিদা লাগলি কাকপক্ষীর ছানারাও কি ওয়া-আও বলি ডাকতি থাকে’?

আবার আরেকদিন দেখলাম গুঁজা নানীর মনটা খুব খারাপ। গোলাপ ফুলের মত ফোলা চোখ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘নানী গো, কি খবর’? কতক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘দারোয়ান ভাই, খিদার কষ্টে কি মাছের চোখ দিয়াও পানি পরতি থাকে’?

গুঁজা নানীর এই এক অভ্যাস। আমি তাকে যতই নানী বলে ডাকিনা কেন, সে আমাকে ডাকবে দারোয়ান ভাই।

গুঁজা নানীর পেটের ভেতর জন্ম থেকেই কোন পিলার ছিল না। পিলার ছাড়া দালান যেমন মজবুত হয় না, মানুষের শরীরটাও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ঘরের চালের মত মানুষও একদিন গুঁজা হয়ে যায়। গুঁজা নানীর শরীরের চালটাও নুয়ে পড়েছে। অথচ এই বয়সেও তার দিকে পাঁচ ছয়জন মানুষের চোখ। একমাত্র ছেলেটির বয়স যখন চার তখন তার স্বামী মারা যায়। বিয়ের দিনে পালকিতে চড়ে সেও গিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি। স্বামী মরে যাবার পর শ্বশুরবাড়ি হয়ে গেল ভাশুর বাড়ি। কিল-চড়-লাথি খেতে খেতে মোতালেব চৌদ্দ বছরের হয়ে উঠল। ছেলের বয়স যখন আঠারো, মোতালেব তখন তার মাকে নিয়ে এল ঢাকায়। ঢাকা এলে মোতালেব তার মায়ের পেট পাথর দিয়ে বেঁধে দিতে পারবে এই ছিল আশা।

বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওরা ভাবল ফুলসুরাত পার হয়ে এসেছে। রেললাইনের বস্তিতে এসে মা-ছেলে তাদের পুঁটলিটা রাখল। আল্লাহর জোড়া মেলানো বিলকিস সেই রেললাইনের বস্তিতেই অপেক্ষা করে বসে ছিল। আল্লাহর মেলানো জোড়া কে দেবে তাতে বেড়া? রেললাইনের খটরমটর খটরমটর শব্দের ভেতর বিলকিসের পেট আনদোষা পিঠার মত ভেসে উঠতে লাগল। টুপুস টুপুস করে চারটা রহমত বেরিয়ে এল অল্প দিনেই। প্রথমটা বোবা। দ্বিতীয়টা খোঁড়া। তৃতীয়টা অন্ধ, তার জলবসন্ত হয়েছিল। আর চতুর্থটা হতে না হতেই গায়ের চামড়ায় হলুদবাটা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে ডাবের পানি, পাকা পেঁপে এসব খাওয়াতে। একটা ডাবের দাম দশ টাকা। পাকা পেঁপের দাম জানে আতা গাছের তোতাপাখি, গুঁজা নানীর সংসারটার উপরে খবীশ ক্ষুধার ভীষণ মাস্তানী।

চুন্নু খেলাপীর বাসায় আমি দারোয়ানের চাকুরী করি। গুঁজা নানী এই বাড়ির থালাবাসন মাজে, কাপড় কাচে, ঘর ঝাড়– দেয়। পুরুষ হয়ে আমি টুলের উপর বসে থাকি। আর গুঁজা নানী হাতপা চালিয়ে কাজ করে। যতই হাতপা চালাক না কেন, খেলাপী-আম্মা কথায় কথায় নানীকে বকাঝকা করে। যেসব বকাঝকার মানে নানী বোঝে না খেলাপী আম্মা সেই গালিগুলোও দিতে থাকে। গুঁজা নানী আমাকে ইডিয়েট, স্টুপিড এসব কথার মানে জিজ্ঞেস করে।

খেলাপী নামটা এদের বংশগত নয়। সরকারের দেয়া। ইংরেজ সরকার দিত খানবাহাদুর টাইটেল। এই আমলে বাহাদুরির ধরণ বদলে গেছে। বাধ্য হয়ে সরকারও টাইটেল বদলে দিয়েছে। ঋণ খেলাপী এখন সরকারী টাইটেল।

বাসনপত্র ধোয়ার সময় হাঁড়িতে লেগে থাকা মাছমাংসের দিকে তাকিয়ে গুঁজা নানী প্রায়ই আনমনা হয়ে যায়। মনের অজান্তে সে চলে যায় নিঝুম পল্লী ছেরাম কান্দি (শ্রীরাম কান্দি)। মধুমতীর তীরঘেঁষা ছোট্ট একটা গ্রাম। লোক বসতি খুবই অল্প। হিন্দু পরিবারগুলো মোটামুটি স্বয়ম্ভর। যে কয়ঘর মুসলমান ছিল সবাই দরিদ্র চাষা। এমনি এক অভাবগ্রস্ত ঘরের নঈম শেখের সাথে যখন তার বিয়ে হয় গুঁজা নানীর বয়স তখন মাত্র পনেরো। বছর যেতে না যেতে জন্ম নিলো মোতালেব। নঈম শেখের জীর্ণ কুটিরে এক বছরের মাথায় এল বাড়তি দুটি মুখ। দুটি মুখই কিছু না কিছু খেতে চায়। নঈম শেখ শরীরে বাড়তি শক্তি যোগাতে পারে না। দিনের পর দিন না খাওয়া বেড়ে উঠতে লাগল। তবুও মাঝে মাঝে বাজার থেকে চেলা-পুঁটি নিয়ে এসে বলতো, ‘কতদিন হয়ে গেল মাছটাছ খাই না। আজ একটু মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাতি ইচ্ছে করছে। মোতালেবের মা বেশি বেশি মরিচ পিঁয়াজ দিয়ে সালুন রান্তি পারবা না’?
যতই মরিচ পিঁয়াজ দিয়ে রান্না করেন, পচা মাছের বড়ো মশল্লা হলো লেবুর পাতা। পিঁয়াজ মরিচ লেবুর পাতা কিনতে গুঁজা নানী বাজারে যেত না। স্বামীর মুখে তৃপ্তি তুলে দিতে ছেরাম কান্দির সব বাড়িকে সে নিজের বাড়ি মনে করত। এ-বাড়ির মরিচ তো ও-বাড়ির পিঁয়াজ। সবই আনতো বাড়ির মালিকদের না জানিয়ে, লোকচক্ষুর আড়ালে। রোজ হাসরের দিনে মরিচ পিঁয়াজ লেবুর পাতা সাক্ষী দিলে গুঁজা নানীর খবর আছে। স্ত্রীর হাতের মধুর রান্না খেয়ে মোতালেবের বাবা বলতো, ‘কি যে মজার সালুন হইছে তা আর কতি পারবো না। মোতালেবের মা, তোমার রান্না বিশ্বের সেরা’।

গুঁজা নানী স্বামীর প্রশংসায় ঘোমটা টেনে নড়েচড়ে বসতো। দূর থেকে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে ভাবতো এত অল্পতেই যে মানুষটা খুশিতে দিশেহারা হয়ে যায় তাকে আল্লাহ কিছুই দিল না কেন? পরীক্ষা দিতে দিতে গরীব মানুষের আর কিছুই থাকল না।

খেলাপী আম্মা রান্না করতে জানে না। এ বাড়িতে রান্না করে বাবুর্চি ভাই। গুঁজা নানীর কাজ শুধু ধোওয়া-মোছা। হাঁড়ি-পতিল ধুতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে অতীতের ঘ্রাণ খুঁজে পেত। অতীতের ধ্যানে যখনই সে অন্যমনস্ক ঠিক তখনই খেলাপী আম্মা এসে তেলের ভেতর বেগুন ছেড়ে দিত। সে তেলে বেগুন পুড়তো না, পুড়ে যেত নানীর পোড় খাওয়া মনটা। চোখের কল দিয়ে তার ঝপঝপ করে ঝরতো পানি। গুঁজা নানীর চোখের কলের প্যাঁচ কেটে গিয়েছিল অনেক আগেই। কলপাড়ের মত চোখপাড়টাও ছিল শ্যাওলাপড়া।

বি-এ পাশের সার্টিফিকেট আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মৃত্যুর পর যদি কোন কাজে লাগে সে জন্য। দারোয়ানের কাজ করা মানে শুধু শুধু বসে থাকা। এক জায়গায় শুধু শুধু বসে থাকলে এমনিতেই খিদে লাগে। বাড়ির পেছন থেকে যখন বাবুর্চি ভাইয়ের রান্নার খুসবু আসে তখন আর দারোয়ানগিরি করতে ইচ্ছে করে না। নিজের পেটের দারোয়ানগিরিটা ঠিক মত করতে পারলাম না। অন্যের গেটের কি দারোয়ান হব। তবুও কাজটা ছেড়ে দিই না, কাজ ছাড়লে ক্ষুধার যাতনা সহ্য হবে না।

আমার ওপর কড়া হুকুম বিনা অনুমতিতে যেন একটা মশামাছিও না ঢুকতে পারে। শুধু নিজ বাড়িতে নয়, আশপাশের বাড়িতেও আমাকে নজর রাখতে বলা হয়েছে। আশেপাশের বাড়ির দিকে আমি নজর রাখি, কিন্তু গুঁজা নানীর আঁচলের নিচে নজর দিই না। গুঁজা নানী সকালে যখন কাজ করতে ঢোকে তখন শরীর মাটির দিকে ঝুঁকে থাকে। শূন্য হাতদুটো ঝুলতে থাকে এমন হেলেদুলে যেন গলাকাটা মুরগী। অথচ কাজের শেষে বস্তিতে ফিরে যাবার সময় তার একটা হাত দেখা যায় না, সেটা থাকে আঁচলে ঢাকা। আমি আঁচলের নিচের মশামাছির দিকে তাকাই না। শুধু আল্লাহকে ডাকি। হে আল্লাহ, শেষ বিচারের দিন পান্তাভাতরে তুমি সাক্ষী করো না। পান্তাভাত সাক্ষী দিলে গুঁজা নানীর খবর আছে। পৃথিবীতে পুড়তে থাকা মানুষটা দোজখে গিয়েও শান্তি পাবে না।

দু’সপ্তা আগে মোতালেব বেবিট্যাক্সীর নিচে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। আমি চল্লিশটা টাকা দিলাম গতরাতে। টাকা হাতে নিয়ে নানী একটা মিষ্টি হাসি দিয়েছিল। সে মিষ্টি হাসি একদিনেই ইতিহাস হয়ে গেল। গুঁজা নানীর চোখের কল আজ সকাল থেকেই খোলা। সকালে মোতালেবকে নিয়ে গিয়েছিল পঙ্গু হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে পা পচতে শুরু করেছে। কেটে ফেলতে হবে। এখন কাটলে একটা, পরে কাটলে দুইটাই।

এদিকে খেলাপীদের বাসায় আজ সন্ধ্যার পর অনেক অতিথি আসবে। স্বভাবতই বাড়িতে অনেক কাজ। তার ওপর গুঁজা নানী আজ এল তিন ঘণ্টা দেরিতে। আজ রান্না করবে মডার্ন ডেকোরেটরে মান্নান বাবুর্চি। জন্মবার্ষিকী বিবাহবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী হলে মান্নান বাবুর্চিকে ডাকতে হয়। গুঁজা নানী আজ খেলাপী আম্মার হাতে ঘনঘন বকা খাচ্ছে। এমনিতেই তার মেজাজ ক্যাণ্টনমেণ্টের মেজাজ। উৎসব অনুষ্ঠানের দিন তিনি হয়ে যান চেঙ্গীস খান। এত বকা খাচ্ছে তবুও কিছুতেই নানীর কাজে মন বসছে না। ছেলেটার একটা পা কেটে ফেলতে হবে। গরীব মানুষের একটা পা চলে গেলে বাকী থাকে কি? নাতীগুলো দু’দিন থেকে কিছু খায়নি। স্বামীর পা কাটা হবে সে চিন্তায় বিলকিসও ভেঙ্গে পড়েছে। স্বামীর হাত কিংবা পা, দুটোই স্ত্রীর কাছে সমান। বিলকিস তাই স্বামীর পায়ের উপর হাত রেখে কেঁদেই চলছে। হাত কাটা গেলে হাতে হাত রেখে কাঁদত।

গুঁজা নানী ঘুরে ঘুরে কিছু ভাত খুঁজল। নাতীগুলো পাখির ছানার মত ভাত দাও ভাত দাও করে কিচিরমিচির করছে। খিদের কষ্টে ঠিকমত কিচিরমিচিরও করতে পারছে না। একটা ভাতের দানা পেলেও চলতো। গ্লাসের ভেতর ভাতটি ছেড়ে দিয়ে ভাতে ভেজানো পানি সে নাতীদের খেতে দিত। গুঁজা নানী আজ আর কোন ভাত পেল না। হাতের কাছে পেল কিছু কলা। আঁচলের নিচে একটা কলা লুকাতে গিয়ে খেলাপী আম্মার নজরে পড়ে গেল। খেলাপী আম্মা নানীকে কতক্ষণ লেফট-রাইট করিয়ে বললো, গেট আউট। কলাটি ফিরিয়ে দিয়ে গুঁজা নানী চলছিল বস্তিতে। একচোখে তার নাতীদের জন্য কষ্ট, অন্য চোখে খেলাপী আম্মার লেফট-রাইটের কষ্ট। দু’চোখে একই রঙের পানি। দেখে বোঝা যায় না কোন পানি কিসের জন্য।

নানীকে আমি যেতে বারণ করলাম। বললাম, ‘আমরা বকা খাবো না তো খাবে কে, দু’কোটি টাকার ঋণ খেলাপী’? তাকে বুঝালাম আজ এ বাড়িতে পোলাও কোরমা রান্না হবে। মেহমানদের ফেলে দেয়া খাবার দিয়ে তোমার পাঁচ ছয়দিন চলে যাবে। প্রথম দিন তোমার নাতীরা খাবে টাটকা পোলাও। পরের দিনগুলো খাবে পোলাওয়ের পান্তা ভাত। তাকে চোখ মুছে ভেতরে যেতে বললাম। গুঁজা নানী আমাকে খুব স্নেহ করে। আমার কথায় চোখের পানি মুছে ফেললো। আঁচলের নিচের শুকনা থালাটা আঁচল দিয়েই মুছতে লাগল। আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললো, ‘ তুমি ঠিকই বলছো দারোয়ানভাই। বস্তিতে গেলি না খাওয়া মুখের দিকে চাতি পারবোনারে। আহারে, মানুষের সাওয়াল পাওয়াল নাতো, মনে হয় কতগুলো কবুতরের বাচ্চা। বউটারও এখন-তখন অবস্থা, আজ কাইলকার মধ্যি আবারো সাওয়াল পাওয়াল হোতি পারে। ওগো বাঁচাতে হবি না’?

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মহান বৈজ্ঞানিকদের মত কি যেন চিন্তা করে গুঁজা নানী ভিতরে যেতে শুরু করল। কিন্তু গেল না। ভেতরে না গিয়ে ফিরে আসতে লাগল। তার চেহারা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল একটা জটিল অঙ্ক সে মেলাতে পারছিল না। নানীর ফিরে আসার দৃশ্য দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো গুঁজা নানী একা নয়, তার পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ মিছিল। মিছিলের সবাই গুঁজা, কারোর পেটে যেন পিলার নেই। তাদের দেখে মনে হলো সদ্য কবর থেকে উঠে আসা গুঁজো কঙ্কাল। বিশেষ কোন প্রশ্নের উত্তর পেতে এগিয়ে আসছে তারা। মনে হয় কান গরম করার মত প্রশ্ন।

‘এ বাড়িতে আজ কিসের বার্ষিকী তাতো কলানা’। গুঁজা নানীর প্রশ্নে অবচেতন ভাবটা কেটে গেল। আমার কান দিয়ে আগুন তো বের হলোই না বরং হাসি পেল। গুঁজা নানী কিছু বোঝে না। খুবই সহজ সরল। একদম আগের দিনের মানুষের মত। আমি বললাম, ‘নানী গো, বড়লোকেরা কি শুধু বার্ষিকীতে লোকজন দাওয়াত করে। তাদের কতরকম অনুষ্ঠান হয় তা জানো’?

গুঁজা নানী ঠোঁট উল্টিয়ে বললো, সে জানবে কেমন করে?
আমি তার মাথার উপর হাত রেখে সাদা চুলগুলো এলোমেলো করে বললাম, চুন্নু খেলাপীর বড়ো নাতীর জন্য আজকের অনুষ্ঠান।
গুঁজা নানী বললো, ‘ও আমার আল্লাহতালা। সাহেবের নাতী হতি না হতি তারও বার্ষিকী হয়ে গেল’!
‘নাগো নানী, ঐ ছেলের বার্ষিকী হতে এখনো পাঁচছমাস বাকি’।
‘তয়, এতটুকু সাওয়ালের আবার কিসের উৎসব’?
‘মুখে ভাত’।
‘মুখে ভাত? ওইটা আবার কী’?
গুঁজা নানীকে বললাম, ক্ষুধা যাদের জন্মশত্রæ নয়, তাদের ভাত খাওয়াটাও একটা উৎসব। এরা লোক ডেকে সাক্ষী রেখে সন্তানের মুখে প্রথম ভাতটা তুলে দেয়। চুন্নু খেলাপীর নাতী যখন মুখের মধ্যে ভাত নেবে তখন তার ফটো তোলা হবে। ভিডিও হবে। এই উপলক্ষে যারা নূতন শাড়ি গহনা কিনেছে তারা হাততালি দিয়ে নাচতে থাকবে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও পুলিশ, মেলেটারী, বিদেশী গেস্টরা যে উপহার আনবে সেগুলো বাচ্চাটাকে দেবে। রাতের বেলায়ই তুমি সব দেখতে পারবে।

আমার কথা শুনে গুঁজা নানীর মুখ শুকিয়ে এল। মনে হলো তার বুকের উপর দিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক উড়ে গেল। উড়ে যাওয়া ট্রাক থেকে উড়ে আসা ধূলিঝড়ে গুঁজা নানীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাকে মৃত্যুর রিহার্সাল দিতে দেখা গেল। রিহার্সাল শেষ করে সে আবারো জিজ্ঞেস করলো, কিসের উৎসব বললা যেন?
গুঁজা নানীর বয়স তালগাছের চেয়ে কম না অথচ মুখটা দেখতে লাউয়ের ডগার মত হয়ে গেল। একটুতেই যেন ভেঙ্গে যাবে। অপরাধীর মত গলা শুকিয়ে আবারো বললাম, ‘মুখে ভাত’।
কথাটা শুনে গুঁজা নানী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মৃত্যুর যে রিহার্সালটা কিছুক্ষণ আগে দেয়া হয়েছিল তার মঞ্চায়ন হলো। তিনি মারা গেলেন।

মৃত্যুকালে গুঁজা নানীর বয়স কত ছিল কেউ জানে না। তিনি এক পুত্র, পুত্রবধূ, চারজন নাতী এবং অসংখ্য প্রশ্ন রেখে গেছেন। মৃত্যুর মাত্র একঘণ্টা আগে কলা চুরির দায়ে তাকে গালমন্দ খেতে হয়েছিল। একটা কলার জন্য সহকর্মীদের সামনে লেডিজ স্যান্ডেলের তিনটি আঘাতও তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। এতকিছু সহ্য করার পরও কোন নরম বিছানা কিংবা হাসপাতালের বেডে তার মৃত্যু হলো না। তার কপালে চুন্নু খেলাপীর লোহার গেটের বাইরে মৃত্যু লেখা ছিল। তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
অতএব একটি গুঁজা লাশ আমাদের হাত দিয়ে মাটিতে মিশে গেল।