মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
ত্রিশ.
মিশেল অনেক আগ থেকেই জানতো কানাডার ওমন সব দূর্গম জায়গায় দুঃসাহসিক অভিযান চালাতে গেলে কি ধরনের ঝুঁকি জীবনে আসতে পারে। তার পরও ওমন সব জায়গাকে সে তার পরম ভালোবাসার স্থান বলে মনে করতো। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে বাড়ির টেলিভিশনে ‘এশিয়ার মৃতদের সত্কার’ বিষয়ে সে একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখছিল। ওটা দেখতে দেখতেই সে হঠাত বলে উঠেছিল, ‘আমার যখন মৃত্যু হবে, তখন ওমন কিছু আয়োজন না করে শুধু পাহাড়ের একবারে তলদেশে আমার মৃতদেহটা রেখে আসবে, পাহাড়ের ওমন এক জায়গাটাতেই আমি চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকতে চাই।’
কোকানী লেকটা হচ্ছে পাহাড়ের একেবারে তলদেশে এবং সময়ের কিছুটা আগে হওয়া তুষার ধস তাকে লেকের গভীরের দিকে ধেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সময়টা যদি আরেকটু পরে হতো, তাহলে বরফ জমে থাকতো, তাহলে ও আর ওর বন্ধু সামান্য তুষার ধস হলেই নিরাপদ জায়গা থেকে সবকিছু দেখতে পারতো আর ও ধরনের কোনো বিপদের মধ্যে আর তাদের পড়তে হতো না। তার কথায় শেষ পর্যন্ত ফলে গেলো, তার শেষ স্থান হলো তার পরম প্রত্যাশার জায়গাতেই, পাহাড়ের একেবারে তলদেশে। ডুবুরীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার লাশ খুঁজে পাইনি, এখন পর্যন্ত সে ওখানেই শুয়ে আছে।
মিশেল তার নিজের জীবনের গতিপথ তার নিজের মত করেই সাজিয়েছিল। শাসা আর আমি বাবার পথ ধরে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম আর মিশেল গেলো পূর্ব দিকে, হ্যালিফ্যাক্সের ডালহৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সে মাইক্রোবায়োলজী নিয়ে পড়াশুনা করেছিল। ওখান থেকে সে গিয়েছিল পশ্চিমে, যেখানে সে এমন এক জীবন বেছে নিয়েছিল যে ওটা করতে সবাই সাহস পায় না।
আমি যখন ম্যাকগিল এ তৃতীয় বর্ষে পড়তাম, সে সময় মিশেলের সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য গাড়ী চালিয়ে ডালহৌসী গিয়েছিলাম। ছোট অবস্থায় আমরা ছিলাম একে অপরের হরিহর আত্মা, কিন্তু সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলো, তখন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসা শুরু হলো। হ্যালিফ্যাক্স এ যাওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছিল সে তার বাবা আর ভাইদের প্রভাব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আর তার নিজের মত করে নিজের দল তৈরী করতে সদাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার কাছে গিয়ে আমি যেটা উপলব্ধি করেছিলাম, সে প্রবলভাবে চাইছিল একান্ত নিজের ব্যক্তিসত্ত¡াকে উজ্জীবিত রাখতে।
এখনো তাকে আমার খুব বেশী মনে পড়ে, আসলে তার অভাবটা আমি প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি। আমি জানি, আমার এই অভাবটা কখনো শেষ হবে না। মিশেল যখন মারা গেলো তখন তার বয়স ছিলো মাত্র তেইশ, কিন্তু ঐ বয়সেই সেই তার নিজের শান্ত প্রশান্তির জগত খুঁজে পেয়েছিল। তার সেই জায়গাটা ছিল এমন এক নিজস্ব ভালোবাসার জায়গা যা আমাদের অনেককেই সারাজীবন হাতছানি দিয়ে ডাকবে। মিশেল যদি আজ বেঁচে থাকতো, আমার বিশ্বাস সে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বাবা হতো আর সোফি, আমি আর আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতি বড়দিনে তার ওখানে বেড়াতে যেতাম। আমার এটাও মনে হয়, হয়তো সে বেঁচে থাকলে সে স্কি আর পর্যটন মিশিয়ে কোনো একটা ব্যবসা চালু করতো। কারণ ঐ স্কি’টাকে সে খুব ভালোবাসতো আর ব্যবসার প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ ছিল। মিশেল তার অবসর সময়টা কাটাতো লেখালেখি আর ছবি আঁকাতে। যখনই সে কিছু একটা করতো, আমি জানতাম সে সেটা খবু ভালোবেসেই করতো। ঐ যে ভালোলাগা বা ভালোবাসার বিষয় নিয়ে গভীরভাবে কাজ করার যে ক্ষমতা, তাই ছিল জন্মগতভাবে তার জীবনের এক পরম পুরস্কার।
যেদিন মিশেলের হারিয়ে যাওয়ার সংবাদটা পেয়েছিলাম, সেদিন বিকেলেই মন্ট্রিয়লে ছুটে
গিয়েছিলাম। বাবার বাড়ীতে ঢুকার সময়ই তাঁকে সামনে পেয়েছিলাম। তারপর কোনো কিছু না
ভেবেই তাঁকে একেবারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমাদের মধ্যে দু’একটা কথা না হতেই
টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল। বাবা টেলিফোন ধরার জন্য এগুতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি তাঁকে
থামিয়ে দিয়ে শুধু বলেছিলাম, ‘না বাবা, আমি এসে গেছি, এই কাজগুলো আমাকেই করতে
দিন।’
মিশেলের মৃত্যু সংবাদটা জানানোর পর মুহূর্তের মধ্য সেটা সারা কানাডায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বাবার এই চরম কষ্টের সময় তাঁকে একান্ত নিজের মত থাকতে দিয়ে, সেদিন সারা সন্ধ্যায় আমিই আমাদের পরিবারের বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের টেলিফোন ধরে ও তাদের টেলিফোনের উত্তর দিয়ে কাটিয়েছিলাম। কয়েক দিন ধরে মিশেলের মৃত্যুর সান্তনার কথা আমাকে টেলিফোনে শুনতে হয়েছে। যাদের টেলিফোন আমি ধরেছিলাম, তাদের সবার কথায় এক বেদনাবোধ ছিল আর তাদের সেই সান্তনা বাক্য আমাকে আমার বেদনা প্রশমিত করতে অনেক সাহায্য করেছিল। তবে আমার এখন কিছুটা ভালো লাগে যে, ঐ চরম খারাপ সময়ে আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে কিছুটা ভালো রাখার চেষ্টা করেছিলাম এবং সেই সাথে আমি যে ধরনের দায়িত্ব পালন করছিলাম, তাতে সেই কঠিন কষ্টের মুহূর্তে আমি কিছুটা হালকা হয়েছিলাম। শাসা যখন মিশেলের সংবাদটা পায় তখন সে আর্কটিকে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত ছিল। সে তখনই ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় গিয়ে কোকানী লেকে মিশেলের লাশ উদ্ধারের জন্য যারা কাজ করছিল, তাদের সাথে ছিল এবং সে সবাইকে আমাদের পরিবারে পক্ষ থেকে তাদের কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। সন্তানের মৃত্যু সংবাদে মা তখন বিধ্বস্ত অবস্থায় অটোয়ায় তার বাড়ীতে ছিলেন, ফ্রেড, কাইল আর এলী তাঁকে যথাসম্ভব ভালো রাখার চেষ্টা করছিল।
আমি বাবার সাথে মন্ট্রিয়লেই ছিলাম, তাঁর সাথে থেকে আউটারমন্ট এর এগলাইস সেন্ট ভায়াতেউর গীর্জায় মিশেলের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করার কাজ করছিলাম। ওই কাজগুলো আমাকে কয়েকদিনের জন্য খুবই ব্যস্ত রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবিকভাবে আমি মিশেলকে হারানোর বেদনা কখনো ভুলতে পারি নি। মিশেলের মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠানে তার আত্মার শান্তির জন্য আমার যে ভালোবাসার শোকগাথা উচ্চারণ করার কথা ছিল, আমি অনেক ভেবেছিলাম অদ্ভুত সুন্দর হৃদয় বিদারক এক শোকগাথা আমি তার জন্য লিখবো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মস্তিস্ক থেকে কিছুই বের হয় নি। অবশেষে মিশেল পছন্দ করতো, এমন এক আদিবাসী প্রার্থনা স্তোত্র আমি তার পারলৌকিক অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলাম।
তারপর মাউন্ট রয়েল ক্লাবে মিশেলের বন্ধুরা তার স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা জানানোর জন্য এক ভিডিও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রথম প্রথম মন্ট্রিয়লের এমন এক অভিজাত ক্লাবে মিশেলের মত এমন একজনের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজনে আমার খটকা লেগেছিল। আমার বারবার মনে হয়েছিল, মিশেলের মত একজন যে কি না ঐ ধরনের নিয়ম নীতির পরিবেশ কখনও পছন্দ করতো না, তার স্মরণে এমন এক জায়গায় অনুষ্ঠান করা ঠিক হলো না। কিন্তু সেদিন সেই ক্লাবের সব কক্ষগুলো মিশেলের বন্ধুদের উপস্থিতিতে ভরে গিয়েছিল। সাধারণত মাউন্ট রয়েল এ ঢুকতে গেলে স্যুট ও ইটালিয়ান সিল্ক টাই’য়ের যে বিশেষ পোষাক পরতে হয়, সেদিনের জন্য সেই নিয়মটা শিথিল করা হয়েছিল। মিশেলের যে সব বন্ধুরা ডাল, ক্যাম্প আহমেক এবং পশ্চিম থেকে যে পোষাক পড়ে এসেছিল, সেগুলো পরেই তারা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেনি। একটা বেদনার শব্দ আর এক ধরনের সুগন্ধিতে ছেয়ে ছিল সারা জায়গাটা। মিশেলকে সত্যিকারের ভালোবাসে এমন অসংখ্যজনের এমন অনুভূতি কাছ থেকে দেখে আমার হৃদয় তোলপাড় করা কষ্টটাকে আমি কিছুটা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিতে পেরেছিলাম।
ভ্যাংকুভারে আমার শিক্ষকতা চাকুরীতে ফিরে আসার পরের বেশ কয়েক সপ্তাহ শাসা’ই বাবার পাশে ছিল, বাবার সেই চরম দূর্দিনে সেই ছিল বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, এই কষ্ট থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু বড়দিন আসতে না আসতেই আরেকটা খারাপ সংবাদ শুনতে হয়েছিল, সংবাদটা হচ্ছে, বাবা এক কঠিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডাক্তারী বিদ্যায় বাবার এমনই রোগের কথা বলে হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি বাবার কি হয়েছিল। আসলে, মিশেল মারা যাবার পর বাবার প্রাণের সব আলো আর তেজ ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে শুরু করেছিল। তিনি কয়েক সপ্তাহ পরেই নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠেছিলেন, এমনকি একটু আধটু চলাফেরাও করতেন। কিন্তু যেদিন আমরা মিশেল’কে বিদায় জানিয়েছিলাম এবং তার পরের যে দু’বছর বাবা বেঁচে ছিলেন, সে সময়গুলোতে বাবা একেবারে অন্য এক মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন।
ছেলেকে হারানোর কষ্টটা মায়ের জীবনেও ভয়ানক কঠিনভাবে প্রভাব ফেলে। আগে থেকেই তাঁর মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না, মিশেলের মৃত্যু সেটাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায়। মিশেলের মৃত্যুর পরের পাঁচ ছয় বছর তাঁকে চরম খারাপ সময় কাটাতে হয়। সেই সময় তাঁর গোটা পরিবার তাঁর পাশে এসে সর্বাত্মকভাবে তাঁকে সহযোগিতার চেষ্টা করেছে।
মিশেলের মৃত্যু আমার বাবা-মা’র জীবনে যেভাবে প্রভাব ফেলে সেটা কিন্তু আমাকে খুবই গভীরভাবে ভাবিয়েছিল। দিনের পর দিন আমি গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতাম আর রাতের পর রাত আমি নিজের সাথে বুঝাপড়া করেছি কিভাবে মিশেলকে হারানোর ব্যাথাটা সামলে নিবো, বা কিভাবে মা যে মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছেন তা থেকে তাঁকে মুক্ত করবো। আর কঠিন মনোবলের অদম্য সাহসী এবং কোনো পরিস্থিতিতেই ভেংগে না পড়া বাবা যেভাবে দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন তা থেকে তাঁকে কিভাবে আবার তাঁর পূর্বের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। আমি তখন নিজের ঐ কঠিন অবস্থা থেকে নিজের একটা পথ বের করার জন্য বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়েছি, এমনকি মন প্রশান্তির থ্যারাপীও গ্রহণ করেছি এবং আমার চমত্কার সুন্দর মনের সব বন্ধুদের সাহায্য নিয়েছি। আমি সেই সময়ই আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি, বন্ধুরা শুধু মাত্র ভালো সময় বা হৈ চৈ করার সময়ই থাকে না, বরং চরম খারাপ ও নিঃসংগ সময়েও বন্ধুরা তাদের ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় যার মূল্য কখনও কোনো কিছু দিয়ে শোধ করা যায় না। আমার সেই কালো অন্ধকার সময়ে আমি যেটা বুঝতে পেরেছিলাম, অসাধারণ কিছু ব্যক্তি আমার চার পাশে থাকে যাদেরকে আমি বন্ধু হিসেবে ভাবি, আমার প্রাণের উপলব্ধিতে এটাও এসেছে, তাদের পরম আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ করেছে। (চলবে)
মনিস রফিক ঃ চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা