সাজ্জাদ আলী : নিরাপত্তা কর্মীর জেরার জবাব দিয়ে তবেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢোকা গেল। কত নম্বর ফ্লাটে যাবেন, কতক্ষণ থাকবেন, ইত্যাদি সব প্রশ্ন। এই “কতক্ষণ থাকবেন” প্রশ্নটিতে আমি বিরক্ত হয়েছি। কারণ জবাবটা ঠিকঠাক জানা নেই। দুঘণ্টা বা চারঘণ্টা হতে পারে, আবার রাতটুকু সেখানে থেকেও যেতে পারি। সেটা নির্ভর করে মিতুর আগ্রহের ওপরে। কারণ খেলাটা তো তার, আমি তো নিমিত্ত মাত্র।
প্রায় ছ’ফুট লম্বা মোটাতাজা এক রেড ইন্ডিয়ান মহিলা সিরিউরিটির দায়িত্বে। তার প্রশ্ন করার ধরনে আদব এবং বিনয়ের কোনো ঘাটতি নেই। বললাম, কতক্ষণ থাকবো, সে তো এখনও জানি না। কিন্তু তা নিয়ে আপনার উদ্বেগের কারণ কী? সে বললো, আমার কনসার্ন আপনি না, আপনার গাড়িখানা। কতক্ষণ থাকবেন সেটা বুঝে আপনার জন্য পার্কিং স্পট ঠিক করতে হবে।
সন্ধ্যা সাতটায় আমার নিমন্ত্রণ। বহুদিনের পরিচয় আমাদের। তবে দেখা হয়েছে মাত্র কদিন হলো, এই তো গেল সপ্তাহে। এতদিন ফোন আর টেক্সটে কথা চলছিলো। আজ সকালে “নিমন্ত্রণ” কনফার্ম করতে সে ফোন করেছিলো। বললাম মিতু, তুমি নিমন্ত্রণ করছো, নাকি আমন্ত্রণ?
সে বলে, তার মানে কী? ও দুটো কথা একই না?
বললাম, এক হতে যাবে কেন? আমন্ত্রণ হলো, দেখা হওয়া, কথাবার্তা বলা/শোনা, বড়জোর চা-শিঙ্গাড়া খাওয়া পর্যন্ত। আর নিমন্ত্রণ ব্যপারটা আরো গভীর! এর সাথে ভোজন জড়িত। আবার কানাডিয়ানদের কাছে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ আর ডিনারের নিমন্ত্রণেরও অর্থ ভিন্ন। দুজন নারী-পুরুষ বন্ধু হলে, ডিনারের পরে তারা নিভৃতে অন্তরঙ্গভাবে দুএকঘণ্টা সময়ও কাটায়। ধুর, তোমাকে এগুলো বলছিই বা কেন? এ তো তোমার অজানা নয়, মিতু?
আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে, বুঝেছি। নিমন্ত্রণের যুৎসই ব্যাখ্যাই দাঁড় করিয়েছো। সাতটায় চলে এসো। আজ তাহলে তোমার নিমন্ত্রণই রইলো, বলে মিতু ফোন রাখলো।
ভবনের লিফ্টগুলো বিশাল লবির মাঝামাঝিতে। ৩২ তলার বোতামটি চেপে দিলাম। মিতুর ফ্লাটটি একেবারে দক্ষিণ কোণায়। কড়িডোর পুরু কার্পেটে মোড়া। দেখে মনে হয় যেন ছয় তারকা মানের হোটেল এটি। দরজায় ক্যামেরাযুক্ত অত্যাধুনিক কলিং বেল লাগানো। চেপে দিতেই মিনি স্পীকারে মিতুর গলা শোনা গেল। বললো, দরজা খোলা আছে। বসার ঘরে গিয়ে বসো। অনেক দিন বাদে একটু গানের ঘরে ঢুকেছি। আরো কিছু মিনিট থাকবো এখানে। চাইলে তুমি এ ঘরে এসেও বসতে পারো।
ওর বসার ঘরটি দুর্দান্ত। বিশাল সাইজ এবং খোলামেলা। রুমটি ওপেন কনসেপ্টের। কিচেন, ডাইনিং এন্ড ড্রইয়িং, সব এক সাথে। দক্ষিণ দিকের দেয়ালটি মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরু কাঁচের তৈরী। লেক অন্টারিওর অথৈ জলরাশির পুরোটাই চোখের সামনে। মনে হয় যেন কাঁচ না থাকলে জলের ঝাপটা মুখে এসে লাগতো। বেলা তখন ডুবি ডুবি করছে। লেকের জলে পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে তা ছিটকে এসে মিতুর ঘরে ঢুকছে। সে আলোর ¯িœগ্ধতা মিতুর মতই মনকাড়া।
কাঁচের দেয়াল ঘেঁষা সোফাখানায় গিয়ে বসলাম। গানের ঘর থেকে সুর ভেসে আসছে। সন্ধ্যাবেলার রাগ গাইছে সে। ইমন রাগই হবে, আবার হংসধ্বনিও হতে পারে। গান শুনে ঠিকঠিক রাগের নাম বলে দেবো, অতোটা পন্ডিত নই আমি। সামনের নিচু টেবিলখানায় একটা বাটিতে বাদাম, আর মদের গ্লাস ও বোতল রাখা। কিন্তু ওতে আমার আগ্রহ নেই। বন্ধুদের সাথে আমি মদ খাই না।
জলের দিকে চোখ রেখে, আর গানের দিকে কান পেতে বসে আছি। অপেক্ষায় আছি কতক্ষণে মিতুকে দেখবো। হঠাৎ টেবিলের উপরে রাখা নোটপ্যাডটির ্ওপরে চোখ পড়লো। গোটাগোটা হাতে বাংলায় কী যেন লেখা। কৌতুহল বসে ওটি হাতে নিয়ে পড়লাম। ওমা, একি বিস্ময়? মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দশা! এটা কী করে সম্ভব হলো? কাজগটিতে লেখা, “তুমি আজ নীল রঙের প্যান্ট আর মেরুণ রঙের জ্যাকেট পরে আসবে”। অবাক চোখে একবার জ্যাকেটের দিকে চাইলাম। ডান পা খানিকটা উঁচিয়ে দেখলাম, প্যান্টের রঙ তো নীলই বটে! এ নারী কি তবে গণক নাকি? আবার আন্দাজ করেও বলতে পারে! কিন্তু মানুষের আন্দাজশক্তি এতটা প্রখর হয় কী করে?
এমন অলৌকিক ক্ষমতাধর নারী আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তবে এটুকু বেশ বুঝতে পারছি যে আমাকে অবাক করে দেবার জন্যই সে ওই নোটটুকু লিখে টেবিলে রেখেছে। অবাক আমি হয়েছি বটে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তো সে যাই হোক, ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম, ব্যপারটায় “আমি যে অবাক হয়েছি” তা প্রকাশ করবো না। এ নিয়ে মিতুর সাথে কোনো কথাই বলবো না। দেখি সে নিজে থেকে কিছু বলে কিনা? নোটপ্যাডের ওই পাতাটি ছিড়ে ভাঁজ করে পকেটে পুরলাম।
২০/২৫ মিনিট বাদে মিতু একখানা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি এসে বসলো। বললো, এখনই তোমার পাশে বসছি না, সে না হয় পরে হবে। কী জান, তোমাকে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। গত চার বছর আমার ফ্লাটে কেউ আসেনি।
আচ্ছা মিতু, একাকিত্ব তোমার কেমন লাগে, জানতে চাইলাম আমি।
দেরি করলো না মোটেই, জবাব যেন তার ঠোঁটের আগায় ছিলো। বললো, আমি তো একা নই। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা অব্দি তো অফিস, মিটিং, সেমিনার করে দিন কাটে।
তারপর এই যে দেখো এতক্ষণ গানের সাথে থাকলাম। তুমি এসে পৌঁছুলে, তবুও তো গান ফেলে উঠিনি। দেয়ালের ওদিকটায় দেখো, সেলফ জুড়ে কত্ত বই। একেক দিন ওদের নও তোমাকে আমার বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হয় তো দেখবে, ওই ঘরে ব্যায়াম করার দুটো মেশিন আছে। ওরা আমার জীবনের অঙ্গ। আরো দেখবে, আমার থেকেও লম্বা, ঠিক তোমার সাইজের একটা কোল বালিস আছে বিছানায়। সেটি সারা রাত আমাকে সঙ্গ দেয়। একাকিত্ব অনুভবের কোনো সুযোগই তো পাই না।
রাত ৮টার মধ্যে ডিনার করাটা আমার অভ্যাস। ক্ষুধা লাগলে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। সে অবস্থায় কোনো কিছুতে মনোসংযোগ করতে পারি না। তখন ৮টার বেশি বাজে, মিতুকে বললাম, কী রেঁধেছো?
সে বললো, ধুরু, আমি রাঁধতে জানি না। ও আমাকে দিয়ে হয়নি কখনও। সে নিজের গøাসে বøাক লেভেল ঢালতে ঢালতে আমাকেও নিতে ইঙ্গিত করলো।
আমি দুটো বাদামের কোয়া মুখে পুরে চিবুতে লাগলাম, তাতে যদি ক্ষুধা কিছুটা দমে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম, মিতু তোমার সাজানো গোছনো ঘর দেখে মনে হয় তুমি অনেক বড় ঘরণী হতে পারতে। আচ্ছা, বলোতো বিয়ে করলে না কেন?
খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো, তাহলে তুমি বলতে চাইছো যে আমার ঘরে একজন পুরুষ নেই বলে আমি ঘরণী না? আচ্ছা, তোমাদের সমস্যাটা কি?
আমি ঢোক গিলে মনে মনে ভাবলাম, এই রে সেরেছে! এই মিতুটাও আবার নারীবাদী কিনা কে জানে? আজকাল চারপাশে এক শ্রেণীর নারী দেখি, তারা পুরুষদের বিরুদ্ধাচরণ করার মধ্যেই নারীমুক্তি খুঁজে ফেরে। আর ঘরের মধ্যে যারা স্বামীদের দিয়ে “ইয়েস ম্যডাম” বলাতে পারছে, তাদের হাবভাব তো নারীনেত্রী গোছের। আর যাদের স্বামীকে ত্যাগ করার সামর্থ আছে, নারীবাদীদের কাছে তাদের মর্যাদা তো জাতির পিতাতুল্য। ভয়ে ভয়ে বললাম, কোন সমস্যাটার কথা বলছো, মিতু?
ওই যে “ঘরণী হতে পারতে” কথাটা যে বললে! তার নেপথ্যে তোমার বিশেষ একটা মনস্তত্ব আছে। তোমার অবচেতন মন বলে যে পুরুষের ঘরে, নারী হবে ঘরণী। অর্থাৎ ঘরখানা পুরুষদের। শোনো সখা, আজকাল ব্যপারটা আর মোটেই তা না। তোমাদের মানসিকতা বদলাও। চেয়ে দেখো আমার ঘরের চারিদিকে, পুরুষ ছাড়াই আমি এ ঘর সাজিয়েছি। এ ঘরের মালিকও আমি, ঘরণীও আমি।
দোষ স্বীকারে আমি কৃপণ নই। বললাম, ভুল হয়েছে, ক্ষমা করো। তোমার ঘরে তুমি অনেক বড় ঘরণী বটে। আমার বিনম্র শ্রদ্ধা নাও, মিতু।
হাসতে হাসতে সে বলে, শুধুই শ্রদ্ধা? আমি তো ভেবেছিলাম ভালোবাসাও বলবে!
ভালোবাসি তো, বললে আবার ক্ষেপে যাও কি না, তাই বলি না, মিনমিনিয়ে বললাম আমি।
আরে মুখ ফুটে বলে ফেল, নিরাশ হবে না, বললো মিতু।
এদিকে ক্ষুধায় আমার পেট চি চি করছে। বললাম, মিতু চলো তো আগে খেয়ে নিই। ওঠো, একসাথে টেবিলে খাবার বাড়বো।
ধুত্তরিকা, বসো তো চুপচাপ, সেই তখন থেকে শুধু খাই খাই করছো। এই বয়সে তোমার ওজন কত, সে খেয়াল আছে? চেয়ে দেখ আমার দিকে, এই ৪৪ এ এসেও কতটা ফিট আমি। আরো খানিকক্ষণ কথা বলি, তারপরে খাওয়া যাবে কিছু একটা। তুমি আমার প্রিয় মানুষ, খুব ভাল লাগছে তোমার কথা।
আচ্ছা, তাই হোক। তাহলে এবার বলো তো, বিয়ে করলে না কেন?
কী জান, কারণটা ঠিক আটপৌরে না, সবার সাথে মিলবেও না। তবুও বলি শোনো। শুধু বাঙালি সমাজ বলে কথা না। সামান্য কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া এই আমিরিকান সমাজেও বিয়ের পরে পুরুষেরা বউকে নিজের সম্পত্তির মতোই ভাবে। এই যেমন ধরো, তার একটা বাড়ি আছে, দুখানা গাড়ি আছে, একটা বউ আছে, বউটি তার সন্তান জন্ম দেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। কী জান সখা, কারো সম্পত্তি হতে কখনও ইচ্ছা জাগে নি, এটুকু বলে মিতু খানিক্ষণ থামলো।
আমি বললাম, থামলে যে, কথা শেষ করো মিতু?
আচ্ছা, এবার তবে বিবাহিত নারীদের কমন মনস্তত্ব বলি, শোনো। বিয়ে হলো তাদের পরজীবী হবার সার্টিফিকেট। স্বামীদের প্রতি মোটাদাগে তাদের মনোভাব হলো, বিয়ে করছো, ভাত-কাপড় দিবা। গাড়ি দিবা, বাড়ি দিবা, হাত খরচের টাকা দিবা, সামাজিক নিরাপত্তা দিবা, ধমক খাবা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এগুলোর কোনোটার যেদিন কমতি পড়বে, সেই রাতে ওই নারী তার ব্রহ্মাস্ত্রটি ব্যবহার করবে। এ রকম পরজীবী হতে ভালো লাগেনি বলেই বিয়ের পিড়িতে বসিনি, এতটা বলে বেজার মুখে থামলো মিতু।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার বিশ্লেষণটি বেশ লাগলো। তা মিতুরানী, ব্রহ্মাস্ত্র বলতে কী বুঝালে, তা একটু ভেঙ্গে বলো দেখি?
আরে, ওই যে রাগ করে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকার অস্ত্রটি। যাকে বলে নো-সেক্স নাইট। ক’জন পুরুষ তা সইতে পারে বলো? অধিকাংশই ওই অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে দাবী মেনে নেয়। এটুকু বলে মিতু হেসে ফেললো।
তা মিতু “নো-সেক্স নাইট” তুমি সামাল দিচ্ছো কোন যাদু বলে?
মিতু বললো, দেখো, যেনতেন প্রকারে ও কাজে আমার আগ্রহ জাগে না। আগে মনের ক্ষুধা মিটতে হবে, তারপরে শরীরের। কারো সাথে মন না মিশলে, শরীর মেলাই না। কক্ষণো না।
দাঁড়াও সখা, এবারে আমাদের খাবারের ব্যবস্থাটা কওে ফেলি। মিতু ফোন ডায়াল করলো। অপর প্রান্তে সংযোগ পেয়েই বললো, আই নিড অ্যা লার্জ পিৎজা প্লিজ, উইথ ফোর টপিংস, চিকেন, টম্যাটো, চিজ এন্ড অনিয়ন। ওর বাসার ঠিকানা বলে, পাঠাতে কতক্ষণ সময় লাগবে, তা জানতে চাইলো।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, অ্যাই ফাজিল, তুমি আমাকে খেতে ডেকেছো। অথচ কিছু রান্না করোনি? মাথাটা ঠিক আছে তো?
মাথা যে কতটা ঠিক, তা তো নোট প্যাডের লেখাটুকু পড়ে তোমার বুঝে ফেলার কথা বন্ধু, বললো মিতু। আর কে তোমাকে খেতে ডেকেছে? কথা বলবো বলেই আজ বসেছি একসাথে। যদি মনের ক্ষুধা মিটাতে পারো, তো চেয়ার ছেড়ে তোমার পাশে গিয়ে বসবো!
তারপর ক্রমশ্য রাত গভীর হতে থাকলো .. … !
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)