সাজ্জাদ আলী : মিতু জোরদার তর্ক জুড়ে দিলো। পরনে শাড়ি থাকলে মনে হয় মাজায় আঁচল পেঁচিয়ে নিতো। হার মানবার লোক না সে। বলে কি না, গ্রাম সে ঢের চেনে! ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই ওরা নানীর বাড়িতে চলে যেতো। কোনো কোনো বছর নাকি একটানা ১০ দিনও থেকেছে। নানার পুকুরে মাছ ধরা দেখেছে। খেজুর গাছের রস খেয়েছে। আমের বোল ছিঁড়েছে। সরষে ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ফটো তুলেছে। এমন আরো কত কিছু বলেই চলেছে…। মোট কথা গ্রাম্য জীবনটা সে নাকি খুব ভালই বোঝে। সব শেষে মুখের চোয়াল শক্ত করে বললো, এ বিষয়ে আমি যেন তাকে জ্ঞান না দেই।
জ্ঞান দিতে যাবো কোন দুঃখে! ওর ফ্ল্যাটে এসেছি রাতটি আনন্দে কাটাবো বলে। মিতু পাগলাটে টাইপের মানুষ। সারাটা জীবন একা থেকে কেমন যেন রগচটা হয়ে গেছে। আমার কিন্তু ওর ওই চটা-মেজাজটাই ভাল লাগে। তেজী ঘোড়াকে বশে আনতে পারার আলাদা একটা উন্মাদনা আছে। মিতুর সাথে আমার আনন্দ অনেকটা সেই রকম। পরম আহ্লাদে ওর গাল টিপে ধরে দুটো বাদামের কোয়া মুখে পুরে দিলাম। সে আরো এক ঢোক হুইক্সি গিললো। মদে আমার আসক্তি নেই। সেজন্য মিতু প্রায়ই আমাকে ‘গেঁয়ো’ বলে ডাকে। ওর আশ্চর্য রকমের মদ-সহন ক্ষমতা আছে। পেট ভরে খেলেও এতটুকু মাতাল হয় না। উপরন্তু যত বেশি খায় ততই সে রোমান্টিক হয়ে ওঠে।
মুখোমুখি দুখানা সিঙ্গেল সোফায় বসেছি আমরা। নিচু স্বরে কথা বলছি। এ কথা থেকে সে কথা চলছে। কী এক কথার পিঠে আমি বলে ফেলেছি যে তুমি তো শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ। গ্রাম্য সমাজ তো দেখো নি। আর যাই কোথা, মুহুর্তেই চটে গেল। সে যে গ্রাম চেনে, ঝাঁঝালো গলায় তা বুঝিয়ে ছাড়লো। তার বয়ান শুনে আমি তো মনে মনে হেসেই মরি! আসলে গ্রামের ব্যপারে সে যে “কী বোঝে না, তাও বোঝে না”। তবুও তার বোঝার কতই না দম্ভ!
একবারে পুরোটা গøাসে বø্যাক-লেভেল ঢেলে নিয়েছে। সাথে জলটল কিছু মেশায় নি। একটু একটু করে খাচ্ছে। এ ভাবেই আরো ঘন্টাখানেক খেতে থাকবে পাগলিটা। তারপর এক সময় আমার সোফার হাতলে এসে বসবে। আমি সেই সুখ-ক্ষণের অপেক্ষায় আছি।
সে শহরে বেড়ে উঠেছে। গ্রাম দেখেছে ট্রেনের জানালা দিয়ে। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ গুনেছে। গ্রাম্য সমাজের বাসিন্দা সে কোনো কালেই ছিলো না। সেখানকার জীবনধারার খুঁটিনাটি কিছুই জানে না। অথচ সেই স্বল্প জ্ঞান নিয়ে তার কতই না গর্ব। হঠাৎ ইচ্ছা হলো মিতুর গ্রাম-জ্ঞান নিয়ে একটু কৌতুক করা যাক। একটা শুকনো খেজুর গালে পুরে প্রেমময় গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, সখি, নানার বাড়িতে যেয়ে কখনও শালুক তুলেছো?
না তো, শালুক যেন কী? হাঁ করে চেয়ে রইলো আমার দিকে। গালে মাছি ঢোকার অবস্থা!
আচ্ছা ঠিক আছে, শালুক না চিনলেও ক্ষতি নেই। বলোতো, কখনও তোমার পায়ে বা গায়ে জোক লেগেছে? ওই, যে সব জোকে রক্ত চুষে খায়?
চমকে উঠে মিতু সোফার ওপরে পা তুলে বসলো। ঝাঁকি লেগে গøাস থেকে খানিকটা হুইস্কি কার্পেটে পড়লো। বললো, জোকের ছবি দেখেছি। কী কুৎসিৎ দেখতে রে বাবা!
আমি বললাম, ভয়ঙ্করও বটে। বিলের জলে মাছ ধরতে যেয়ে বহুবার পায়ে জোক লেগেছে। ওরা আমার পা থেকে রক্ত চুষে চুষে খেয়েছে। যখন দেখতে পেয়েছি, তখন জোকটিকে ছাড়িয়ে নিয়েছি। এরপর দুহাতে ওটিকে ধরে টেনে ছিঁড়েছি। ওর পেটের সব রক্ত টপ টপ করে পড়ে জল রাঙা করেছে। বলোতো, আমার রক্ত ওকে হজম করতে দেবো কেন?
এসব শুনে মিতু সত্যিই ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। বলে, এমন বিভৎস কাজ তুমি করতে পারলে? থামাও তোমার কথা, শুনে ভয় লাগছে।
ঠিক আছে, তবে ভিন্ন কথা বলি। আচ্ছা মিতু বলোতো, নানা বাড়িতে গিয়ে হিজল ফুল দেখেছো? ওই যে লাল ও গোলাপী রঙের শতশত ফুলগুলি গাছ তলায় পড়ে থাকে। সে ফুলের মালা গেঁথেছো কখনও?
না তো, হিজল ফুলটা যেন কী রকমের দেখতে? তুমি আমাকে ওই ফুলের একটা ছবি দেখাতে পারবে?
আচ্ছা, ঠিক আছে বন্ধু, এক সময় ইন্টারনেট ঘেঁটে তোমাকে হিজল ফুলের ছবি দেখাবো। এবার বলোতো নানার গ্রামে মধু-মাছির চাক দেখেছো? চাকওয়ালা গাছে চড়ে আলতো করে মৌমাছি সরিয়ে চাক ভেঙ্গে মধু খেয়েছো?
অ্যাই তোমার বকবকানি থামাও তো এবার, হাসতে হাসতে বললো মিতু। মিথ্যা বলারও তো একটা সীমা থাকা চাই! তুমি মৌমাছি সরিয়ে চাক ভেঙ্গে মধু খেলে, আর মাছিরা তোমাকে আস্ত রাখলো? হুল ফোটালো না? যত্ত সব ফালতু গল্প!
প্রিয়ে, মধু তো চাক ভেঙ্গেই খেতে হয়। আর তা ভাঙ্গার কৌশল গাঁয়ের লোকেরাই জানে, বললাম আমি।
মিতুর এপার্টমেন্ট ডাউন টাউনের লেক অন্টারিওর পাড়ে। বসার ঘরের দক্ষিণ দিকটা ফ্লোর থেকে ছাদ অব্দি কাঁচের দেয়াল। সে উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। চাঁদের আলো লেকের জলে পড়ে তা চারিদিকে ছিটকে পড়ছে। কী যে শোভা সে আলোকচ্ছটার! তবে মিতুর মুখশ্রী সে চাঁদের আলো ¤øান করার জন্য যথেষ্ট। আবার আমার মুখোমুখি এসে বসলো সে। বললো, তুমি গ্রামের কথা বলছিলে, আরো বলো শুনি।
আমরা যেটা যত কম বুঝি, সেটা তত বেশি বোঝার ভান করি। মিতুর বেলায় তা শতভাগ খাটে। তবুও ওকে খুশি রাখতে বললাম, মিতু, গ্রামের কথা তো তোমার সবই জানা। সে সব থাক। তার থেকে তুমি যে ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলো ঘুরে এলে, সেই কথা বলো শুনি।
বলবোনে পরে, আজকের রাতটুকু কথা বলে কাটাবো আমরা। আগে তুমি গাঁয়ের কথা শেষ করো, বললো মিতু।
আমি জানি সে আর বেশিক্ষণ কথা শুনবে না। হাতের গøাস প্রায় খালি করে এনেছে। একটু বাদেই তার মনোযোগ ফিরবে আমার দিকে। তবে আরো কিছুটা সময় পার করা দরকার। বললাম, আমি তো গেঁয়ো, দাদীর বাড়িতে কৈশোর অব্দি বড় হয়েছি। সেই সময়ের কথা দুএকটা বলি তবে,
একদিন বিকালে উঠানে দৌঁড়াদৌড়ি করছি। বয়সে কিছুটা বড়ো, আমার দুই ফুফাতো বোন এক কোণে দাঁড়িয়ে গালগল্প করছিলো। ওদের কথা কানে এলো। বলছিলো, ওই লাল গাইটা দুই একদিনের মধ্যে বিয়াবে। দৌঁড় থামিয়ে জানতে চাইলাম, রিনা আপা, গাই বিয়ানো কী? সে হেসে বললো, গাইয়ের বাচ্চা হবে।
পরদিন ভোরে ছিপারা পড়তে কাচারী ঘরের দিকে যাচ্ছি। দেখি, উঠোনে একটা বাছুর দৌঁড়াদৌড়ি করছে। আর গোয়ালঘরে চাকর গোমস্তাদের জটলা। সেখানে দাদীও আছেন। দাদীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই বাছুরডা কার?
দাদী বললেন, মনে করো ওইডার মালিক তুমি। ওই যে দেহো আমাগে লাল গাইডা শুইয়া আছে, সে ওই বাইচ্চাডা এট্টু আগে বিয়াইছে।
আমি দাদীকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে আশ্চর্য হয়ে বললাম, এট্টু আগে বিয়াইয়া, এহনই দৌঁড়ায় ক্যাম্বায়? আমাগে মিলন হইছে কত্তদিন হইয়া গেল, সে তো বসতিও পারে না!
আস্তে আস্তে আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাদী বললেন, তার কারণ আছে। তুমারে পরে বুঝাইয়া কবানে। এহন তুমি ছিপারা পড়তি যাও ভাই।
মিতু বিস্ময়ে হতবাক! গাভীর সন্তানেরা যে জন্মের পরপরই দৌঁড় শুরু করে, এ কথা সে এই প্রথম জানলো। আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বসলো। আরো শোনার অপেক্ষায় সে।
আমি বলে চললাম। মাছদের কথা একটু বলি শোনো। আষাঢ় মাসের ঘন বৃষ্টিতে গাঁয়ের পুকুরগুলো কানায় কানায় ভরে যায়। এ সময়ে অধিকাংশ মাছের পেট ভর্তি ডিম থাকে। কৈ মাছের গায়ে এক ধরনের পিচ্ছিল লালার আভরণ তৈরী হয়। মেঘের ডাকের সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে ওই আভরণ কৈ মাছের জন্য খুব অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। তখন তারা জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে আসে। নিজেদের শরীর আঁকাবাঁকা করে ঘাসের ওপর দিয়ে দ্রæত চলাচল করে। ঘাসের সাথে শরীরের ঘষায় পিচ্ছিল আভরণ কেটে যায়। ঠিক ওই সময়ে ডাঙ্গা থেকেই কৈ মাছগুলোকে ধরা যায়।
তুমি কখনও ওই ডাঙ্গার কৈ ধরেছো, জানতে চাইলো মিতু।
বহু, বহুবার। কৈ মাছের কাঁটার আঘাতে হাত ফুটো হয়ে পাথারের চিরচিরে জল আমার রক্তে লাল হয়েছে।
আচ্ছা মিতু, টাকি মাছ চেনো তো? আষাঢ় শ্রাবণ মাসের নতুন জলে টাকি, শোল ও গজার মাছের ডিম ফুটে পোনা বের হয়। এক জোড়া দম্পতির শ’খানেক পোনা ফোটে। প্রতিটি মা মাছের নেতৃত্বে এই পোনাগুলো ঝাঁক বেঁধে চলে। অগভীর ও স্বচ্ছ জলের ধানক্ষেত পোনাদের প্রিয় চলাচলের জায়গা। বাহারি রঙ ওদের। টাকি মাছের বাচ্চাগুলো সোনালী রঙের। শোলের পোনারা টকটকে লাল। আর গজারের ছানারা কালো রঙের।
বাবা মাছটি খানিকটা দূরে থেকে তার পরিবারের পিছু নেয়। মা মাছটি এ সময় খুবই মারমুখি আচরণ করে। ওর পোনার ঝাঁকের কাছাকাছি অন্য কোনো মাছ বা মানুষ গেলে ও আক্রমণ করে। জলের ভেতরে মানুষের পায়ে মা মাছেরা মাথা দিয়ে গুতা দেয়।
এই মাছের কথা শুনতে শুনতে মিতু এসে আমার সোফার হাতলে বসলো। এবার আমার কাঁধে ওর কনুইয়ের গুতা লাগলো। খানিকটা লজ্জামাখা হাসি হেসে সে বললো, তোমার চেনা গ্রাম, আর আমার দেখা গ্রাম একেবারেই আলাদা। আরো বলো, বলে যাও তুমি।
কিন্তু আমার যে আর কথা আসছে না! ওর স্পর্শে ক্রমেই আমি কাতর হয়ে পড়ছি।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)