ড: বাহারুল হক : আমরা বলি মা। এমন মধুর করে, এমন সহজ করে আর কেউ বলে না। অন্যদের মুখে শুনা যায় আম্মা, আম্মী, মা’জী, মিমি, মিতেঁরা, মামি, মামিকা, মাজকা, আনাইয়া, মাম্মী, টিনা, আন্নি , মাতিনা, মাতকা, মারি, নিনি, মামিংকা, আইতি, মামান, মাম্মা, এনাইয়া, মতিনা, মাতাজি, মাইকা, ইত্যাদি। সব দেখে কেউ হয়তো বলবে- “তোমরা বড় সংক্ষেপ করে ডাক”। আমি বলবো- হতে পারে; তবে মনে রাখবে, আমাদের মা ডাক হলো সব থেকে ওজনদার ডাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে ভাব ধার করে বলতে হয় ছোট একটা বইতে যেমন ভাষা চুপ করে আছে, মানুষের মনের সকল কথা যেমন কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজে বাঁধা পড়ে আছে তেমনি মা এই ছোট শব্দটির মধ্যে বাঁধা আছে আমাদের মায়ের মুখ নয় শুধু, বাঁধা আছে মায়ের ভাষা, মায়ের ভূমি। মায়ের মুখ, মাতৃভুমি আর মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের মা। আমাদের কাছে মাতৃভুমি, মাতৃভাষা মায়ের মত প্রিয়। আমরা মায়ের মত ভালোবাসি মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে। সে জন্য আমরা জীবন যেমন দিতে পারি মায়ের জন্য তেমন জীবন দিতে পারি মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির জন্য। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি।
আমরা বাংলায় ডাক পারি- মা, মা, মা।
মা আমাদের প্রাণের ডাক।
মা আমাদের হৃদয়-হৃদপিন্ড।
মা আমাদের বুক সাগরের অথৈ দোল।
মা আমাদের নয়নে আলোর বান।
মা আমাদের সতেজ মস্তিস্কে অবিনাসী উদ্দীপণ।
১৯৫২ সনে, ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের বাঙালিরা জীবন দিয়েছে, মাতৃভূমির জন্য বাংলাদেশের বাঙালিরা জীবন দিয়েছে ১৯৭১ সনে। ২১শে ফেব্রুয়ারি তাই আমাদের কাছে ভাষা দিবস, শহীদ দিবস। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। বিশ্বসমাজ মাতৃভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগকে অত্যান্ত মহৎ দৃষ্টিতে দেখে এই আত্মত্যাগের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্বের সব দেশে সব ভাষার মানুষ তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি অপার ভালোভাষায় উদ্বোধ্য হয়ে এখন ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার শহীদদের স্মরণ করে।
আমাদের শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছি মাতৃভাষা মায়ের মত প্রিয়। মায়ের জন্য নয় শুধু মাতৃভাষার জন্যও প্রয়োজনে জীবন দিতে হয়; জীবন দিয়ে হলেও মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করতে হয়।
১৯৫২ সন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রæয়ারি দিনটি বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের দ্বারা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে ভাবগম্ভীর পরিবেশে মহান শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৯৯ সন; দীর্ঘ একটা সময়। এই দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব আমাদের দেখেছে, আমাদের বুঝেছে। মাতৃভাষার জন্য আমাদের প্রাণ দেয়ার ঘটনাকে অশেষ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করেছে। পৃথিবীর যেখানে যে মা আছে সে মায়ের মুখের ভাষাকে বাঁচানোর তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। অতপর বিশ্বের ১৯৩টা দেশ নিয়ে জাতি সঙ্ঘের যে বিরাট সংস্থা, ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুক্যাশনাল সাইন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গ্যানাইজেশন (ইউনেসকো), সে সংস্থা ১৯৯৯ সনে নড়েচড়ে বসলো।
ইউনেসকো ১৯৯৯ সনে ২১ ফেব্রæয়ারী দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করলো। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সন থেকে বিশ্বের সব দেশ পালন করে আসছে এই দিনটি- ২১ ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পরে জাতি সঙ্ঘের সাধারণ সভায় এ বিষয়ে বিল উত্থাপিত হলে তা সর্ব সম্মতি ক্রমে পাস হয়। বাঙালী সন্তানরা ১৯৫২ সনে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে হাসি ফুটিয়ে ছিল বাঙালী মা-দের মুখে কিন্তু সেদিন হাসি মুখে শহীদ হওয়া বীর বাঙালী সন্তানরা জানতো না যে তাদের সে আত্মত্যাগ একদিন পৃথিবীর সব মা-দের মুখে হাসি ফুটাবে। আজ এই শহীদ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি সব ভাষা শহীদদের। কামনা করছি তাদের আত্মার পূর্ণ শান্তি।