শিখা আখতারি আহমাদ : টরন্টোর শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার পঞ্চদশ আসরটি হয়ে গেল গত ১৭ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, এগলিন্টন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে। কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এবারের আসরে আলোচিত হয় মান্না দে’র সঙ্গীতবিষয়ক আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন- ‘জীবনের জলসাঘরে।’ আলোচনা করেন সঙ্গীত শিক্ষক, সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব জনাব ইখতিয়ার ওমর।
শুরুতেই বইটির ওপর সামগ্রিকভাবে আলোকপাত করা হয়। ‘জীবনের জলসাঘরে’ বইটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। ৩৬৮ পাতার এই বইটির অনুলেখক- গৌতম রায়। বইটি বের হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমোরিজ কাম এলাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়।
মান্নাদের ভাষ্যে বইটিতে আমরা পাই কৈশোর থেকে শুরু হয়ে একেবারে পরিণত বয়স পর্যন্ত তাঁর সঙ্গীত জীবনের বর্ণনা। পারিবারিক সাঙ্গীতিক আবহে, প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছোটো কাকা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে গানের হাতেখড়ি, কাকার অপত্য স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠা ও গান শেখা, মুম্বাইয়ে নিজেকে শিল্পী হিসেবে দাঁড় করানোর প্রাণান্ত সংগ্রাম, প্রবোধ চন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে ওঠা এবং একসময় মুম্বাই, কোলকাতাসহ সারা বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের হৃদয়ে গান দিয়ে আসীন হওয়ার গল্প। বাংলা আধুনিক গানের জগতে কিংবদন্তীতূল্য সম্রাটের আসনে আসীন হওয়ার গল্প।
সর্বভারতীয় ভার্সেটাইল শিল্পী মান্না দে বাংলা, হিন্দিসহ গেয়েছেন তামিল, মালয়ালাম, গুজরাটি মারাঠি, ভোজপুরি, অসমিয়া, ওড়িয়া, তেলেগু ভাষায় নানা স্বাদের গান। রেকর্ডকৃত আছে তাঁর সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান। পেয়েছেন পদ্মশ্রী (১৯৭১), পদ্মবিভূষণ (২০০৫) দাদাসাহেব ফালকে (২০০৭) ও বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা। সুদীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় মান্না দে তাঁর সঙ্গীত সাধনাকে অব্যাহত রেখেছেন অপরিসীম নিষ্ঠায়। সময়টা অনেকটা দীর্ঘ, আর তাই বই জুড়ে এসেছে অসংখ্য সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, সঙ্গীত শিল্পী, অ্যারেঞ্জার, যন্ত্রী, অভিনেতাসহ প্রাসঙ্গিক আরো মানুষের গল্প। এসেছে গানের পেছনের না-বলা গল্প। এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত ও সঙ্গীত জীবনের বড়ো আশ্রয়- মা, স্ত্রীর কথা। বিচ্ছিন্নভাবে তিনি এসবের কিছুটা কখনো সখনো লিখেছেন বটে, কিন্তু ‘জীবনের জলসাঘরে’ই তাঁর পূর্ণাঙ্গ আত্মকথা। এখানে সঙ্গীত জীবনের পাশাপাশি, ব্যক্তিজীবনের অন্দরমহলও তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন নিঃসংকোচে। অনুলেখনের কারণে, লেখায় একটা বৈঠকী ভাব আছে। ফলে সবসময় বর্ণনায় স্থান-কাল-পাত্রের ধারাবাহিকতা সেভাবে রক্ষিত হয়নি। তবে সাবলীলভাবেই এসেছে শিল্পী মান্না দে’র সঙ্গীতের দীর্ঘ জীবনের টুকরো টুকরো গল্প। বইটি জুড়ে কিছুটা আত্মপ্রেমী শিল্পী মান্না দে ধরা দিলেও, অর্ধশতাব্দী ধরে সঙ্গীত জগতে নিজের প্রবল ছাপ রেখে যাওয়া, লক্ষ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত শিল্পীর কিছুটা আত্মশ্লাঘা যথার্থই মনে হয়। পায়ের নিচে একফোঁটা মাটি খুঁজে পাওয়ার জন্য মুম্বাইয়ে বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, সময় সময় হতোদ্যম হয়ে পড়া, অপমানিত-বঞ্চিত মান্না দেও একই সাথে ধরা দেন আমাদের কাছে। বইয়ের শেষে পরিশিষ্টে আছে মান্না দে’র গাওয়া গানের একটি তালিকা। নানা ভাষায়, নানা স্বাদের ১২৩ পাতা জুড়ে বিস্তৃত এই কয়েক হাজার গানের এই তালিকা সাক্ষী দেয় তাঁর গানের সুবিশাল পরিসর, গানের ব্যাপ্তি। এতে শুধুমাত্র আধুনিক বাংলা গানই আছে ৩২১টা, বাংলা চলচ্চিত্রের গান ৬০০টা এবং হিন্দী চলচ্চিত্রের গান ১৪০০টা। মূল আলোচনার শুরুতেই ইখতিয়ার ওমর তুলে ধরেন, সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গীত জীবন ও মান্না দে’র শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অপরিসীম ভূমিকার কথা। ইখতিয়ার বলেন, কে সি দে (মান্না দে ডাকতেন বাবু কাকা বলে) আসলে জন্মান্ধ ছিলেন না। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান ১৩ বছর বয়সে। মা তাঁর মধ্যে সঙ্গীতের সহজাত প্রতিভা দেখতে পেয়ে ওস্তাদ হরেন্দ্রনাথ শীলের কাছে নিয়ে যান। কে সি দে দবির খান, বাদল খানদের মতো অনেক বড়ো বড়ো ওস্তাদদের কাছে তালিম নেন। ১৮ বছর বয়সেই তিনি অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে নাম করেন। গাইতেন খেয়াল, ধ্রæপদ, ধামার, ঠুমরি, কীর্তন, এমনকি হামদ, নাতও। তিনি বিচিত্র ধরনের গান শিখতে ও শুনতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন। আর এর প্রভাব পরবর্তীতে মান্না দে’রএ ওপরও প্রবলভাবে পড়ে।
কে সি দে মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের নামকরা অভিনেতাও ছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় গাইবার জন্য সেই ভাষা শেখার প্রতি তিনি গুরুত্ব দিতেন, যাতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অন্য ভাষায় গান উপস্থাপন করা যায়। তিনি ঘনিষ্ট সাহচর্যে আসেন উস্তাদ জমিরুদ্দিন খান, রামপুর ঘরাণার দবির খান, বাদল খান, আবদুল করিম খান, ফাইয়াজ খান, রাইচাঁদ বড়াল, বেগম আখতারের। শচীন দেব বর্মন কিছুকাল তাঁর কাছে গান শেখেন। এঁরা মান্না দে’দের বাড়িতে আসতেন। কাকা অন্ধ ছিলেন বলে বাড়িতেই তালিম নিতেন। আর কাকার সুবাদে এই সমস্ত গুণীজনদের সান্নিধ্যধন্য হন মান্না দে নিজেও।
কে সি দে বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত অনুভব করে শেখার বিষয়। শিক্ষক কেবল ছাত্রকে সেই পথটুকু বাতলে দেবেন। এই কে সি দে, স্বভাবজাত স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষণপদ্ধতির মধ্য দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলেন মান্না দে’কে। ওস্তাদরা এলে তিনি মান্না দেকে ডেকে বসিয়ে কখনো হারমোনিয়াম, কখনো তানপুরা ধরিয়ে দিতেন। এভাবেই এই দুই যন্ত্রে দক্ষ হয়ে ওঠেন মান্না দে। মান্না দে’র সাথে তখন তাঁর অন্য ভাইরাও কাকার কাছে শিখতেন। আসলে কাকা যখন ওস্তাদদের কাছে শিখতেন, তখন খাতা পেন্সিল নিয়ে কাওকে না কাওকে বসতে হতো নোট নিতে কিংবা কোনো রাগের আরোহন অবরোহন লিখতে। এইসব করে করে খুব ছোটোবেলা থেকেই মান্না দে’র গান শেখার পর্ব শুরু হয়ে যায়।
কৃষ্ণচন্দ্র দে বলতেন, সঙ্গীত সাধনাই ঈশ্বর সাধনা। মান্না দে’ও ব্যক্তিগত জীবনে একেবারেই ধর্মকর্মের ধারেকাছে ঘেঁষতেন না এবং তিনিও সারাজীবন সঙ্গীতকেই ঈশ্বর জ্ঞান করেছেন।
এ পর্যায়ে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কণ্ঠে, ১৯৪০ সালের রেকর্ডকৃত অত্যন্ত বিখ্যাত গান- ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক তা মিছেই কল্পনা’র কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয়। গানটি পরবর্তীতে মান্না দে’ও রেকর্ড করেন। কোলকাতায় তাঁর গানের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবেও তিনি এই গানটি গেয়েছিলেন।
ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসা, ছাদের পাঁচিল টপকে অন্যের বাড়ির আচার চুরি করে খাওয়া শৈশব, কৈশোরের দুরন্ত মান্না দে’র গল্প বলতে গিয়ে ইখতিয়ার বলেন, মান্না দে কুস্তি ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বনামধন্য কুস্তিগীর যতীন্দ্রচরণ গুহ’র (গোবরবাবু) কাছে কুস্তি শেখেন তিনি। তিনি আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ী হন এবং অল বেঙল রেসলিং প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অবতীর্ণ হন। কিন্তু স্কটিশ চার্চ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন তাকে চশমা নিতে হয় এবং চশমা পড়ে কুস্তি চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সঙ্গীতশিল্পী হবেন না কুস্তিগির- এই পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রথম প্রেম সঙ্গীতকেই বেছে নেন। কুস্তিগীর হতে গিয়ে প্রবোধচন্দ্র দে হয়ে গেলেন সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে।
ইখতিয়ার বলেন, স্কটিশ চার্চ কলেজ ছিল মান্না দে’র জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। কলেজের প্রিন্সিপাল আরকুহার্টের উৎসাহে তিনি আন্তঃকলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে অংশ নেন। তিনি ধ্রæপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, ঠুমরি ও আধুনিক গানের প্রত্যেকটিতে প্রথম হন এবং পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৩৭ সালে অল বেঙল মিউজিক কম্পিটিশনে সব বিভাগে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। উল্লেখ্য এখানে পড়বার সময়ই তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং পরবর্তীতে নিজের সুরারোপিত কিছু বাংলা আধুনিক গানে এর সার্থক প্রয়োগ করেন।
এর মধ্যেই আসে মেজোকাকা হেমচন্দ্র দে’র ফরমান – মান্না দে’কে ওকালতি পড়তে হবে, কিছুতেই গানের শিল্পী হওয়া যাবে না। মান্না দে’র ভাইরা কেও ডাক্তারি, কেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন আর তিনি পড়ে আছেন দিনরাত গান নিয়ে। মেজোকাকা বলেন, গানে ডিসিপ্লিন নেই, অর্থকড়ি নেই, সেইরকম সামাজিক সম্মানও নেই। কিন্তু মান্না দে গোঁ ধরে থাকেন। মায়ের নীরব সম্মতি ছিল এতে। আর বাবুকাকাই, মেজোকাকাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মান্না দে’কে শেষমেষ উদ্ধার করেন। এ সময় মান্না দে বিদ্যাসাগর কলেজে বিএ পড়ছিলেন।
ইখতিয়ার ওমর বলেন, মান্না দে তখন বাবুকাকার সাথে নিয়মিত নিউ থিয়েটার্সে যাওয়া আসা করতেন। নিউ থিয়েটার্স তখন চাঁদের হাট। ওখানে তখন নিয়মিত আসতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, তিমির বরণ, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশরা। কাকার সাথে নিউ থিয়েটার্সে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। গানের টেকনিক্যাল বিষয়াদি হাতে কলমে শেখেন। শেখেন যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার, শেখেন গানের শর্টহ্যান্ড নোটেশন ইত্যাদি। নিউ থিয়েটার্সে যেতে যেতেই একসময় কাকার সহকারী সঙ্গীত পরিচালক (সেকেন্ড অ্যাসিস্টেন্ট) হন মান্না দে। প্রধান সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বিষ্ণু মিত্র। এখান থেকেই মান্না দে’র সুরকার হিসেবে হাতেখড়ি হয়। ততদিনে তিনি রেডিওতে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের তালিকাভুক্ত শিল্পী। মুম্বাই যাওয়ার আগের তিন চার বছর কোলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত খেয়াল, ঠুমরি, লঘু সঙ্গীত গেয়েছেন তিনি।
এরপর ইখতিয়ার বলেন, মান্না দে’র জীবনের আরেক টার্নিং পয়েন্টের কথা। ১৯৪২ সাল। কোলকাতায় জাপানি বোমার আক্রমণ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, উত্তাল কোলকাতা ইত্যাদি মিলিয়ে গান-বাজনা ও ছায়াছবির কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সবাই তখন মুম্বাইগামী। সেই বছরেরই শেষদিকে বাবুকাকার সঙ্গে মুম্বাই যান মান্না দে। কাকার সাথে যাওয়ার কথা ছিল অন্য ভাইয়ের কিন্তু খুব আগ্রহ করে মান্না দে’ই সাথে যান। ত্রিবেদীর আমন্ত্রণে, সিরকো প্রোডাকশন্সের (পরবর্তীতে কার্দার স্টুডিও) ব্যানারে তামান্না ছবির কাজে, নামকরা দলবলসহ কৃষ্ণচন্দ্র দে যান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে।
আলোচক বলেন, মান্না দে’র হিন্দী চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে ব্যাক ১৯৪৩ সালে, কাকার সঙ্গীত পরিচালনায় তামান্না চলচ্চিত্রে। ‘জাগো আঈ ঊষা’ গানটি সুরাইয়ার সাথে দ্বৈতভাবে গান। তামান্নার পরিচালক ছিলেন ফণী মজুমদার। ঐ একই বছরে অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে শঙ্কর রাও ব্যাসের সঙ্গীত পরিচালনায় রামরাজ্য ছবিতে একক প্লে-ব্যাক করেন মান্না দে। গান ‘ভারত কি এক।’ কাকার বদলে অবশ্য তিনি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এ সময়কালে কাকার পরামর্শে মুম্বাইয়ে তালিম নিতে থাকেন মান্না দে। কারণ মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতে তখন তুমুল প্রতিদ্ব›িদ্বতা। কাকা তাঁকে বলেন, আরো তৈরি হতে। মান্না দে প্রথমে শেখেন কিংবদন্তীতূল্য ওস্তাদ আমন আলি খাঁর কাছে (১৯৪৪)। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নানা দিকের সাথে “নুম”ও শেখেন তিনি কয়েক মাস ধরে। নুম হচ্ছে- সুরের মধ্য দিয়ে স্বরবর্ণের সঠিক উচ্চারণ পদ্ধতি। এটি ঠিকঠাকমতো করতে পারলে, গানের চেহারাই পালটে যায়। এরপর শেখেন পাতিয়ালা ঘরানার বিখ্যাত ওস্তাদ আবদুল রহমান খাঁ’র কাছে। আবদুল রহমান খাঁ তাঁকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি অন্যান্য গান গাইতেও উৎসাহ দিতেন। তিনি আরও তালিম নেন ওস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খাঁ’র কাছে। গোলাম মুস্তাফা খাঁ’র কাছে শেখেন গানের সময় কণ্ঠস্বরের পরিধি বাড়ানোর পদ্ধতি।
আলোচনায় জানা যায়, ১৯৪৭ সালে কাকার অসুস্থতার জন্য তাঁকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরতে হয় মান্না দে’কে। পরিবার তাঁকে আর একা মুম্বাই যেতে অনুমতি দিতে চাইছিল না। এ সময় মায়ের দ্বারস্থ হন তিনি। চিত্রপরিচালক ফণী মজুমদারের ফোন পেয়ে সঙ্গীত পরিচালক ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের সহকারী হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্যে আবার পাড়ি জমান মুম্বাইতে।
প্রথমবার মুম্বাই আসার পর থেকে কাকার সহকারী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তালিম নেওয়াও চলছিল। এবং একটানা ৭ টি বছর সঙ্গীতপরিচালক হরিপ্রসন্ন দাস, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ, শ্যামসুন্দর, অনিল বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মন সহ আরো কয়েকজনের সাথে সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন মান্না দে।
অল্প বাজেটের বেশ কয়েকটা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেন তিনি। কিন্তু সেসব ছবি চলেনি। অনিশ্চিত এ সময়টায় গায়ক হিসেবে সুযোগের জন্য, পায়ের নিচের মাটি পাওয়ার জন্য অক্লান্ত লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। এ সময় অনেকরকম অসম্মানজনক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হয় তাঁকে।
ইতিমধ্যে তিনি তখন মুম্বাই রেডিওর লাইট ক্ল্যাসিকেলের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
এ পর্যায়ে আলোচক প্রবোধচন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে ওঠার গল্পটা বলেন। মান্না দে’র পোশাকী নাম প্রবোধচন্দ্র দে। এই নামটা তাঁর মোটেও ভালো লাগত না। আর ডাক নাম ছিল মানা, মান্না না। মুম্বাইতে মানা’কে অবাঙালি উচ্চারণে মান্না ডাকত সবাই। মান্না দে নিজেও চাইছিলেন প্রবোধ চন্দ্র থেকে মুক্তি। তাই মান্না দে নামটাই চালু হয়ে যায়।
ইখতিয়ার ওমর এ পর্যায়ে মান্না দে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকার না হয়ে আধুনিক গানের দিকে চলে গেলেন কেন সেই ব্যাপারে আলোকপাত করেন। মান্না দে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দীর্ঘ বছর ধরে তালিম নিলেও তিনি আসলে শুরু থেকেই কখনো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকার হতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে ভার্সেটাইল শিল্পী হতে, আধুনিক ও লঘু সঙ্গীত গাইতে, গানকে ছড়িয়ে দিতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
কেরালার মেয়ে সুলোচনার কুমারনের সাথে মান্না দে’র পরিচয়, প্রণয়, বিয়ে, সংসার, মান্না দে’র সঙ্গীত জীবনে সুলোচনার প্রভাব ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, সুলোচনার সাথে পরিচয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূত্র ধরেই। ১৯৪৮ সালের মে মাসে। মুম্বাইয়ের এক সাংস্কৃতিক আয়োজনে মান্না দে ও সুলোচনা দ্বৈতকণ্ঠে গান- “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।” সেই পরিচয় গড়ায় প্রণয়ে, প্রণয় থেকে বিয়েতে। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে। এই বিয়েতে মান্না দে’র পরিবারের ঘোর আপত্তি ছিল। মা’কে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে, পরিবারের বাকিদের অসম্মতিতেই সুলোচনাকে বিয়ে করেন মান্না দে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক সুলোচনা মান্না দে’র জীবনে অনিবার্য ভূমিকা পালন করেন। মান্না দে’র সঙ্গীত জগতে উত্তরণের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন সুলোচনা।
মান্না দে শচীন দেব বর্মনের আক্ষরিক অর্থেই সহকারী ছিলেন। সাথে সাথে থাকতেন সবসময়? শচীন দেব বর্মন ছিলেন খুব রসিক মানুষ। বইতে সেরকম কয়েকটি মজার স্মৃতিও আছে মান্না দে’র। শচীন দেব বর্মন এবং অন্যান্যদের সহকারী হিসেবে কাজ করলেও মান্না দে’র কাজ মূলত ছিল গানের নোটেশন করা, সুরটা তোলা এবং শিল্পীকে তুলে দেওয়া। অনেক অভিমান ছিল তাঁর এটা নিয়ে। বিশেষ করে তাঁর শচীন দা’র ওপর। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এমনি গড়ায়। অবশেষে ৭ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শচীন দেব বর্মনের সুরে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গাওয়ার মাধ্যমে একটা বড়ো ব্রেক পান। এই গান দিয়েই মান্না দে’র জয়যাত্রার সূচনা। শচীন দেব বর্মনের কাছে মান্না দে’র সঙ্গীত জীবনের ঋণ অসীম। শচীন দেব বর্মনের সুরে, পরিচালনায় পরবর্তীতে অনেকগুলো জনপ্রিয় প্লেব্যাক করেন মান্না দে। এর মধ্যে আহীর ভৈরব রাগে, মেরি সুরত তেরি আঁখে ফিল্মের ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে’ গানটির কিছু অংশের ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয় পাঠশালার শ্রোতাদের।
মান্না দে’র প্লেব্যাক ক্যারিয়ারে প্রবাদপ্রতিম সুরকার জুটি- শঙ্কর-জয়কিষাণের কথা বলেন ইখতিয়ার। এই জুটির সাথে কাজ করতে গিয়েই মান্না দে অন্য পরিচালকদের নজরে আসেন। এঁদের হাত ধরেই মান্না দে’র শিল্পীসত্ত¡ার পুরোপুরি বিকাশ ঘটে। সেসময়টা ছিল মান্না দে’র স্বর্ণযুগ। এ পর্যায়ে, শঙ্কর-জয়কিষাণের সুরে শ্রী ৪২০ ফিল্মের অতি জনপ্রিয় গান ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। গানটি মান্না দে লতার সাথে ডুয়েট করেছিলেন। উল্লেখ্য, লতার সাথে মান্না দে’র ডুয়েট গানের সংখ্যা ১৭০ টির মতো।
শঙ্কর-জয়কিষাণের কথা বলতে গিয়ে আলোচিত হয় হিন্দি সিনেমার জগতের কিংবদন্তী রাজকাপুর প্রসঙ্গ। ১৯৫১ সালে ‘আওয়ারা’ চলচ্চিত্র থেকে মান্না দে’র সাথে রাজকাপুরের সখ্য গড়ে ওঠে। ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমার গানের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে মান্না দে তাঁর আন্তরিকতা, লেগে থাকার গল্প তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালে, সুরকার শঙ্কর-জয়কিষাণের সঙ্গীত পরিচালনায়, মেরা নাম জোকার সিনেমায় রাজ কাপুরের লিপে ‘এ ভাই জারা দেখকে চলো’ গানটি গেয়ে মান্না দে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়কের জাতীয় পুরষ্কার ও পদ্মশ্রী খেতাব পান।
শচীন, শঙ্কর-জয়কিষাণ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন নামী সুরকার-সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেন মান্না দে। এঁদের মধ্যে সলিল চৌধুরী, অনিল বিশ্বাস, নওশাদ, মদন-মোহন, লক্ষ্ণীকান্ত-প্যারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, রবীন্দ্র জৈন উল্লেখযোগ্য। এদের সুরের কথা, সুরের বৈচিত্রের কথা বিশদভাবে বলেছেন মান্না দে বইটিতে। কল্যাণজি-আনন্দজি’র ‘জঞ্জির’ ফিল্মের ‘ইয়ারি হ্যায়’ গানটা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছিল। রবিজি’র ওয়াক্ত ছবির ‘আয়া মেরি যোহরা জবী’ গানটি এখনও জনপ্রিয়। লক্ষ্ণীকান্ত প্যারালালের সঙ্গীত পরিচালনায়, রাজকাপুরের ‘ববি’ সিনেমায়, শৈলেন্দ্র সিঙের সুরে ‘না চাহু সোনা চান্দি’ গানটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল। রৌশনজি’র সঙ্গীত পরিচালনায়, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছায়ায়, ১৯৫৩ সালের ‘দিল হি তো হ্যায়’ ছবির ‘লাগা চুনরিমে দাগ’ গানটি রীতিমতো অমরত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। এসব সুরকার-সঙ্গীত পরিচালকের পাশাপাশি মান্না দে উল্লেখ করেছেন গীতিকার মজরু সুলতানপুরী, শৈলেন্দ্রজি, শাহির লুধিয়ানভি, হসরত জয়পুরী, ভরত ব্যাসজির কথা।
ইখতিয়ার ওমর বলেন, সলিল চৌধুরী প্রসঙ্গ খুব গুরুত্বের সাথে, উচ্ছ¡সিতভাবে এসেছে বইটিতে। বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ এ গান গাওয়ার সুবাদে সলিল চৌধুরীর সাথে মান্না দে’র পরিচয় ১৯৫৩ সালে। সলিল ছিলেন প্রতিষ্ঠানসম, অসাধারণ সাঙ্গীতিক প্রতিভা ছিল তাঁর, ছিল কাজ করার স্বতন্ত্র ধারা। তিনি গান নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতেন। সব মিলিয়ে বিশাল ব্যাপ্তি ছিল তাঁর। তাঁর গান সবার থেকে আলাদা। তিনি বোম্বে ইয়ুথ কয়ার তৈরি করলে, মান্না দে সেখানেও যুক্ত হন। সলিলের সুরে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমায় গান গেয়েছেন মান্না দে। এর মধ্যে মধুমতি, কাবুলিওয়ালা, আনন্দ উল্লেখযোগ্য। এ পর্যায়ে সলিল চৌধুরীর সুরে মান্না দে’র গাওয়া দুটি গানের ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শিত হয়। প্রথমটি আনন্দ চলচ্চিত্রের, জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দেওয়া গান- ‘জিন্দেগি ক্যায়সা হ্যায় পেহলি’ আর দ্বিতীয়টা- মালয়ালাম ‘চেস্মিন’ সিনেমার গান গান ‘মানস মইনেবরু, মধুরাম নুল্লি তেরু।’ ১৯৬৫ সালে এই গানটির জন্য সলিল চৌধুরী ও মান্না দে কেরল সরকারের শ্রেষ্ঠ সুরকার ও শ্রেষ্ঠ গায়ক নির্বাচিত হন।
হিন্দি সিনেমার প্লেব্যাকের একদম শেষ পর্যায়ে মান্না দে, শচীন দা’র ছেলে পঞ্চমের সুরেও গান করেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সমন্বয়ে সুর করায় রাহুল দেব বর্মনের জুড়ি ছিল না। শুধু হিন্দি না, পুরো ভারতীয় লঘু সঙ্গীতের জগতের সর্বপ্রথম র্যাপ করেন পঞ্চম । ভূত বাংলা সিনেমায়। চাবি চেকার এর ‘লেটস টুইস্ট এগেইন’ এর আদলে ‘আও টুইস্ট করে গা’ গানটি গান মান্না দে। পঞ্চমের সঙ্গীত পরিচালনায় মান্না দে’র গাওয়া অনেকগুলো ছবির গান অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। এর মধ্যে, মান্না ও কিশোরের দ্বৈতকণ্ঠে ‘পড়োশন’ সিনেমার ‘এক চতুর নার’ এবং শোলের ‘ইয়ে দোস্তি হাম না তোড়েঙ্গে’ উল্লেখযোগ্য। ‘এক চতুর নারে’র ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়।
আলোচক বলেন, ফিউশনের ব্যাপারে মান্না দে’র ছিল ঘোর আপত্তি। তিনি ফিউশনের নামে গানের আদি রূপ বদলে দেওয়ার মোটেও পক্ষপাতী ছিলেন না এবং এই ব্যাপারে অন্যদেরকেও নিরুৎসাহিত করতেন।
মুম্বাই প্লেব্যাক জগতে তখন দাপটে বেড়াচ্ছেন মোহাম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মুকেশ, জি এম দুরানিরা। একটা পরীক্ষিত ফর্মুলার ব্যাপার ছিল তখন। প্রেমের গান মানেই তালাত, দুঃখের গান মানে মুকেশ, নাচানাচি বা লম্ফ ঝম্ফের গান মানে রফি, পরে কিশোর। এটাই ছিল ফর্মুলা। এই ফর্মুলা থেকে মান্না দে বৃত্তের ভেতর গেলেন কেমন করে, এই প্রসঙ্গে ইখতিয়ার বলেন, এক্ষেত্রেও মূলত কাজ করেছে তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মজবুত ভিত, আবার একইসঙ্গে প্লেব্যাক গাইবার বিশেষ দক্ষতা।
আবার ওদিকে ছিল গায়ক-নায়ক জুটি। মুকেশ-রাজকাপুর। অভিনেতা মেহমুদ মান্না দে’কে পছন্দ করতেন গায়ক হিসেবে। মেহমুদের অনুরোধেই ‘পড়োশন’ ছবিতে ‘এক চতুর নার’ গাওয়ার সুযোগ ঘটে মান্না দে’র। এ গানের গল্পে মান্না দে অকুণ্ঠ চিত্তে কিশোর কুমারের খোলা গলার গায়কীর প্রশংসা করেন। পরে অবশ্য রাজকাপুরের লিপে অনেক হিট গান গেয়েছেন তিনি।
মান্না দে’র গান সাধারণের গান না, এই প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, মান্না দে যেই ধরনের গান গেয়েছেন, তাতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে চর্চিত কণ্ঠের প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় বড় রেঞ্জের, নমনীয় গলার। তাই, তাঁর গান অসম্ভব লোকপ্রিয় হলেও, ঐ অর্থে তাঁর গান সাধারণের গান না।
আলোচক বলেন, বইতে মান্না দে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তবলাবাদক রাধাকান্ত নন্দী, বাঁশিতে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া ও সন্তুরে পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার কথা।
ইখতিয়ার বলেন, পুরো বই জুড়ে অসংখ্য হাসির গল্প সাক্ষ্য দেয় মান্না দে’র রসিক সত্ত¡ার কথা।
এ পর্যায়ে মান্না দে’র বাংলা গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, একে তো মুম্বাইতে মান্না দে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তার ওপর জনপ্রিয় হতে গেলে জনপ্রিয় গায়কের লিপে গান করা ছাড়া উপায় নেই। কোলকাতায় তখন মহানায়ক উত্তম কুমার-মহাগায়ক হেমন্ত মুখার্জী। এটাই ছিল ফর্মুলা। তাই মান্না দে’কে একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল।
বাংলা গানের জগতে আসার পেছনে মান্না দে’র মায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি মান্না দে’কে মুম্বাই ছেড়ে বাংলা গানের জগতে আসতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। মান্না দে’ও মায়ের এই ভূমিকার কথা খুব গুরুত্বের সাথে লিখেছেন বইটিতে।
এদিকে ১৯৫২ সালে মান্না দে একটা উল্লেখযোগ্য ব্রেক পান। সঙ্গীত নির্ভর চলচ্চিত্র ‘অমর ভূপালী’তে ‘ঘনশ্যাম সুন্দর’ গানটি লতার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়ে তিনি বেশ আলোচিত হন। এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বসন্ত দেশাই। বাংলা ও মারাঠি ভার্সনে সিনেমাটি হয়েছিল। বাংলা ভার্সনে গেয়েছিলেন তিনি। গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
১৯৫৩ সালে মান্না দে’র প্রথম বাংলা রেকর্ড বের হয়। তাঁর নিজের সুরে ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ এবং ‘হায় হায় গো’ গান দুটো লতার গাওয়ার কথা থাকলেও ঘটনাচক্রে তিনি নিজেই গান। কুনি ফ্রান্সিসের ‘আই এম ওয়ালসিং টু দ্য টেনেসি ওয়ালস’ গানের সুরে ‘হায় হায় গো’ লিখেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এই বেসিক বাংলা গানটি গেয়েই বাংলা গানের যাত্রা শুরু হয়েছিল মান্না দে’র। প্রথম দিকের গানগুলোর সুরে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৭ সালে রেকর্ডকৃত ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ গানটি জিম রিভসের ‘ওহ্ ড্যানি বয়’ গানের আদলে, শ্যামল গুপ্তের কথায়, ভাই প্রভাস দে’র সুরে। এই গানের একাংশ বাজিয়ে শোনানো হয়।
মান্না দে’র কোলকাতার সঙ্গীত জীবনে অসম্ভব প্রতিভাবান সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তের প্রভাব প্রসঙ্গে ইখতিয়ার বলেন, ১৯৫৮ সালে মুম্বাইতে পরিচয় হয় সুধীন দাসগুপ্তের সাথে মান্না দে’র। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্ররূপ ‘ডাক হরকরা’ সিনেমায়, সুধীন মান্না দে’কে দিয়ে প্লেব্যাক করান। গীতিকার তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় নিজেই। চারটে গান করেন তিনি। এর মধ্যে শান্তিদেব ঘোষের লিপে ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ গানটি সর্বকালের সংবেদনশীল গানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। এই গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
এই ‘ডাক হরকরা’র পরে সুধীন দাশগুপ্তই ১৯৬৬ সালে ‘শঙ্খবেলা’ চলচ্চিত্রে মান্না দে’কে দিয়ে গান গাওয়ান। প্রথম উত্তম কুমারের লিপে মান্না দে গান ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ লতার সাথে দ্বৈতকণ্ঠে।
পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায়। কেউ রাজি ছিলেন না মান্না দে’র ব্যাপারে, উত্তম কুমারও না। সুধীন দাশগুপ্তের কারণেই মান্না দে’র সুযোগ পাওয়া এবং বাংলা প্লেব্যাক জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সুধীন দাশগুপ্তের কাছে মান্না দে অপরিসীম ঋণী বলে উল্লেখ করেছেন বইতে। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়।
সুধীন দাশগুপ্তের পরিচালনায় এরপর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে গান করেন মান্না দে। ‘তিন ভুবনের পারে’ সিনেমায় সৌমিত্রের লিপে গান ‘হয়তো তোমারই জন্য।’ পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রাইজেশনের এ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়।
মান্না দে বেসিক আধুনিক গানও গান সুধীন দাশগুপ্তের সুরে। এর মধ্যে আছে- একই অঙ্গে এতো রূপ দেখিনি তো আগে, আমি তার ঠিকানা রাখিনি, কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায় ইত্যাদি। পাশ্চাত্যের সুর আর দেশী সুরের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটাতেন সুধীন দাশগুপ্ত। তিনি খুব কম বয়সেই মারা যান ক্যান্সারে।
আলোচক বলেন, সলিল চৌধুরীর সুরে, কথায়, সঙ্গীত পরিচালনায় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন মান্না দে। ‘একদিন রাত্রে’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাসের লিপে জনপ্রিয় গান ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ এর ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। ‘গঙ্গা’ সিনেমায় (১৯৬১) গান লোকগীতি ‘উথালি পাথালি।’ ‘হারানের নাতজামাই’ ফিল্মে গান ‘হেই সামালো ধান।’ মর্জিনা-আবদুল্লা ছবিতে গান রাগাশ্রয়ী ‘বাজে গো বীণা।’ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়? ওদিকে সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে মুম্বাইয়ের আইপিটিএতে যুক্ত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালে রেকর্ড করেন ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা,’ ‘মানব না এ বন্ধনে’ ও আলোর পথযাত্রী’র মতো চমৎকার সব গান। আলোচক বলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ১৯৫৯ সালে মান্না দে প্লেব্যাক করেন ‘দীপ জ্বলে যাই’ ছবিতে। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গান ‘এমন বন্ধু আর কে আছে।’ গানের ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। হেমন্তের সুরে আরো অনেক সিনেমায় প্লেব্যাক করেন তিনি। হেমন্তের কণ্ঠের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন মান্না দে বইয়ে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতে সমন্বয়ের জন্য খ্যাত আরেক দিকপাল সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুরে ও সঙ্গীত পরিচালনায় মান্না দে অনেক প্লেব্যাক করেন। নচিকেতা ঘোষ একটা ছোটো খাতা রাখতেন সাথে সবসময়, গানের কথা টুকে প্রায়ই গীতিকারদেরকে মুখড়া ধরিয়ে দিতেন। নচিকেতা ঘোষ আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একই ক্লাসের বন্ধু। নচিবাবুর বাসার ছাদে গানের রিহার্সাল হতো। সেখানে আসত শিল্পী জগতের গুণীজনরা। নচিবাবুর সঙ্গে মান্না দে’র পরিচয় মুম্বাইয়ে, ‘ছোটা সা সাওয়াল’ ছবির গান করতে গিয়ে। নচিবাবুর সুরে প্রথম প্লেব্যাক করেন তিনি ‘চিরদিনের’ (১৯৬৯) ছবিতে। গীতিকার ছিলেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। নচিবাবুর সুরে বেশ কয়েকটি সিনেমায় গান করেন মান্না দে। এর মধ্যে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ও ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমায়, উত্তম কুমারের লিপে ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’ এবং ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’ গানদুটোর ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। ‘আজ রাতে আর’ গানটির জন্য ১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় পুরষ্কার পান মান্না দে। গানটি আসলে গাওয়ার কথা ছিল শচীন দেব বর্মনের।
নচিকেতা ঘোষের সুরে বেশ কয়েকটি আধুনিক গানও গেয়েছেন মান্না দে। প্রায় প্রতিটি গানই চিরকালীন জনপ্রিয় গানের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে। ক ফোঁটা চোখের জল (১৯৭১), তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার, যদি কাগজে লেখো নাম, ওগো বরষা তুমি ঝোরো না গো, আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে এসব গান এখনো মুখে মুখে ফেরে। এ পর্যায়ে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘ক ফোঁটা চোখের জল’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক অনিল বাগচীর সুরে, উত্তমের লিপে ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি’ চলচ্চিত্রে ১৯৬৭ সালে প্লেব্যাক করে অত্যন্ত সুনাম কুড়ান মান্না দে। সিনেমার গানগুলিতে ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছোঁয়া। বেশ কঠিন এই গানগুলো নিখুঁতভাবে লিপে তুলতে উত্তম কুমারও কতটা আন্তরিক ছিলেন, সেই গল্প উঠে এসেছে বইয়ে। এই ছবিতে গান গেয়ে বাংলা ছায়াছবির জগতে চিরকালীন আসন পেয়ে যান মান্না দে। অনিল বাগচী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুরকে লঘু সঙ্গীতে দারুণ প্রয়োগ করতেন। এই সিনেমার গানগুলো—আমি যে জলসাঘরের, আমি যামিনী তুমি শশী হে, চম্পা চামেলী গোলাপের বাগে ইত্যাদি। ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। অনিল বাগচীর ছেলে অধীর বাগচীর সুরেও মান্না দে গান গেয়েছেন। এর মধ্যে পুলক বন্দোপাধ্যয়ের কথায়, ‘দুই পুরুষ’ চলচ্চিত্রে ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়।
ইখতিয়ার বলেন, এ ছাড়াও আরো অনেক গুণী সঙ্গীত পরিচালকের সুরে গান গেয়েছেন তিনি। মান্না দে নিজে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, হিন্দি, বাংলা দুটোতেই। তবে খুব একটা সফল হননি। বাংলা যাত্রাপালাতেও সুর করেছেন তিনি।
১৯৫৬ থেকেই বেসিক গান গাওয়া শুরু মান্না দে’র। সেই সময় পুজোর গানের দিকে ছিল মানুষের ঝোঁক। মান্না দে প্রচুর বাংলা গানে সুর করেছেন। ১৯৪০ সালে সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। তাঁর সুরে, শৈলেন রায়ের কথায় ‘বালুকা বেলায়’ গানটি রেকর্ড করেন সুপ্রীতি ঘোষ। আর ১৯৫৩ সালে জীবনের প্রথম আধুনিক বাংলা গান তিনি নিজেরই সুরে গানÑ কতো দূরে আর নিয়ে যাবে বলো এবং হায় হায় গো রাত যায় গো। ১৯৫৬ সালে তুমি আর ডেকো না, তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়। ১৯৫৭ সালে ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা।’ ১৯৫৮ সালে ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম,’ ‘এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি,’ ‘এ জীবনে যতো ব্যথা পেয়েছি,’ ‘আমি সাগরের বেলা,’ ১৯৫৯ সালে ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে,’ ‘আমি নিরালায় বসে,’ ১৯৬০ এর পূজোয়, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায়, আমার না যদি থাকে সুর, জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই এরকম আরো অসংখ্য গান। এ পর্যায়ে অনিল বিশ্বাসের কথায়, ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
মান্না দে’র সুরে অনেকে গেয়েছেন। আশা, হৈমন্তী শুক্লা, সন্ধ্যা, সুমন কল্যাণপুর, হৈমন্তী এদের মধ্যে অন্যতম। হৈমন্তীর বিখ্যাত গান “আমার বলার কিছু ছিল না” (১৯৭৮) মান্না দে’র সুরে ও পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায়।
অন্যান্য সুরকারদের কথাও বলেছেন মান্না দে। রতু মুখোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়, মৃণাল বন্দোপাধ্যায়- এঁদের কথা। মান্না দে অনেক গেয়েছেন রতুর সুরে। ১৯৬৪ সালে তাঁর সুরে, মান্না দে’র গাওয়া ‘আবার হবে তো দেখা’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ, খোকার সুরে মান্না দে অনেক গেয়েছেন। খোকা ছিলেন রাহুল দেব বর্মনের ভক্ত। পাশ্চাত্যের বিটসে আগ্রহী এ সুরকারের সুরে, পুলক বাবুর কথায় ব্যলাডধর্মী গান ‘সে আমার ছোটো বোন’ গান মান্না দে। আর আয়ারল্যান্ডের লোকগীতির ছায়ায় সুর করা ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ তো বাংলা গানের জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ বাজিয়ে শোনানো হয় এই পর্যায়ে। আলোচক ইখতিয়ার ওমর মান্না দে ও পুলক বন্দোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় জুটির নানামাত্রিক সম্পর্ক ও এই জুটির সৃষ্টি বেশ কিছু গানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ১৯৬০ এ পূজোয় ‘আমার না যদি থাকে সুর,’ ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’—এ দুটো গান দিয়েই মান্না-পুলক কালজয়ী জুটির যাত্রা শুরু। এই জুটির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান হচ্ছে- ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল না, ও কেন এতো সুন্দরী হলো, চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি; সুলোচনার সাথে মান্না দে’র প্রেম, মান-অভিমানে জন্ম নেওয়া ৩ টি গান- আমার একদিকে শুধু তুমি, তুমি অনেক যত্ন করে, যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে, এতো রাগ নয় এ যে অভিমান, দরদী গো কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম, সুন্দরী গো দোহাই, জড়োয়ার ঝুমকো থেকে, আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেলো, এ নদী এমন নদী, তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন ইত্যাদি। এগুলোর মধ্য থেকে ললিতা গো, তুমি অনেক যত্ন করে, ও চাঁদ সামলে রেখো, সুন্দরী গো দোহাই দোহাই এই গানগুলো সৃষ্টির গল্প বলা হয় এবং বাজিয়ে শোনানো হয়।
মান্না দে’র গান নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা প্রসঙ্গে ইখতিয়ার ওমর রতু মুখার্জির সুরে ‘অভিমানে চলে যেওনা,’ মান্না দে’র সুরে, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায়, ভাটিয়ার রাগের ওপর ‘একি অপুর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়’ গানগুলো সৃষ্টির গল্প তুলে ধরেন? ‘অভিমানে চলে যেও না’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
আলোচক এরপর মান্না দে’কে কেন্দ্র করে গৌরী-পুলক মান-অভিমানে জন্ম নেওয়া ৪ টা অবিস্মরণীয় গানের পেছনের গল্প তুলে ধরেন। মান্না দে একটানা ১২/১৩ বছর পুলক বাবুর সুরে গাইবার পর গোরীপ্রসন্ন মজুমদারের অভিমান হয়। তবে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের আগেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গাইতেন মান্না দে। প্রথম আধুনিক গান- কতদূরে আর, হায় হায় গো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা। প্রথম বাংলা ছবি অমর ভূপালীতেও গৌরীবাবুর লেখা গান গেয়েছেন মান্না দে। দীর্ঘদিন পর গৌরী বাবু মান্না দে’র জন্য লিখেন- ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো। পুলক বাবু এর জবাবে লিখেন- তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার। গৌরী বাবু লিখেন- যদি কাগজে লেখো নাম। তার জবাবে পুলক লিখেন- আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে। এই চারটা গানই নচিকেতা ঘোষের সুরে। এর মধ্য থেকে ‘ওগো বর্ষা তুমি’ ও ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু’ গান দুটো বাজিয়ে শোনানো হয়। এই দুই গীতিকারেরই মৃত্যু অল্প বয়সে। রাধাকান্ত নন্দী, সুধীন দাশগুপ্ত, রাধাকান্ত নন্দী, রাহুল দেব বর্মনও অল্প বয়সে মারা যান।
আলোচক বলেন, মান্না দে বাণীর ওপর খুব জোর দিতেন। এবং এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গ এনেছেন। বাণী পছন্দ না হলে সুরও করতেন না তিনি। একবার অনেক বলে কয়ে পুলক বন্দোপাধ্যায়কে দিয়ে ছয় ঋতুর ছয়টি বাণীপ্রধান গান লেখান। সুর করেন মান্না দে’র ভাই প্রভাস দে, ভেলু। সরোদের বাজনায় গান ঠিকমতো ফোটানোর জন্য মান্না দে দলবল নিয়ে মুম্বাই গিয়ে ১৯৭৮ সালে রেকর্ড করেন গানগুলো। এই গানগুলোর মধ্যে দীপক রাগাশ্রয়ী গান ‘প্রখর দারুণ অতি’ বাজিয়ে শোনানো হয়।
ইখতিয়ার ওমর এ পর্যায়ে সমসাময়িক সঙ্গীত নিয়ে মান্না দে’র হতাশার কথা আলোচনা করেন। মান্না দে’র ভাষ্যে- গান মানে শুধু কিছু বাদ্যযন্ত্রের বেপরোয়া আওয়াজ কিছু নয়। গান মানে একটা পরিপূর্ণ গান। ভালো কথায়, ভালো সুরে যত্ন করে গাওয়া একটি গান। একটি গানকে শ্বাশত গান হয়ে উঠতে গেলে ভালো বাণী, সুরের সাথে কঠোর পরিশ্রম দরকার। মান্না দে বইটি শেষ করেছেন এই বলে — পুনর্জন্ম হলে তিনি আবার বাংলাতেই জন্মাতে চান, বাংলাতেই থাকতে চান, বাংলাতেই গান গাইতে চান। সলিল চৌধুরীর কথায়, সুরে মান্না দে’র গাওয়া ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’ বাজিয়ে আলোচনার ইতি টানেন সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ইখতিয়ার ওমর।
দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সঙ্গীত জীবন কাটিয়ে দেহান্তরিত মান্না দে’র জন্মশতবর্ষে, মান্না দে’র নিজের লেখনী থেকেই এক সর্বভারতীয়, ভার্সেটাইল শিল্পী হিসেবে মান্না দে’কে যথেষ্ট আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করেন আলোচক ডঃ ইখতিয়ার ওমর। আর এই বিস্তৃত আলোচনা মাত্রিক হয়ে ওঠে পাঠশালায় আগত গ্রন্থ ও সঙ্গীতপ্রেমীদের সাগ্রহ উপস্থিতিতে। আসরের সঞ্চালনা ও মডারেশনে ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।