জালাল কবির : বোকার স্বর্গে তারাই তো বসবাস করে, যারা প্রকাশ্যে বার বার বলে বেড়ায় মানুষ কোনও বুঝা নয়, মানুষ হচ্ছে একটি জাতির সম্পদ। যেখানে মানুষ সেখানেই ব্যবসা, যেখানে মানুষ সেখানেই আয় উন্নতি। অতএব মানুষই সম্পদ। যখন মানুষ মানুষকে শোষণ করার ক‚ট-কৌশল উদ্ভাবন করেছে, লোভ ও বিলাসিতাকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে বুঝাতে পেরেছে এটাই জীবনের সুখ, এটাই জীবনের স্বার্থকতা। মানুষ তখনই বুঝতে পেরেছে হ্যাঁ ঠিক তো মানুষই সম্পদ। আদিম যুগের পর থেকে মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জীবন যাপন করে লোকবলে ও দৈহিক বলে অন্যের সম্পদ [যেমন: ভূমি, বৃক্ষ, ফসল, পশু এমন কি শিশু ও নারী] ছিনিয়ে আনতে পেরেছে সে তখনই বুঝতে সক্ষম হয়েছে মানুষই সম্পদ। কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষ দ্বারা অঢেল শ্রমের বিনিময়ে সে যখন সম্পদ তৈরি করা শিখেছে কিংবা আহরন করতে পেরেছে সে তখন থেকে বুঝে নিয়েছে মানুষই সম্পদ। এক মায়ের দশ ছেলে যখন দশ দিক থেকে শ্রমের বিনিময়ে কিংবা অন্য অসৎ উপায়ে বাড়তি রোজগার করতে পেরেছে সে তখনই বুঝে নিয়েছে মানুষই সম্পদ।

এভাবে যুগকাল এবং শতাব্দীর দাপটে মানুষের সংখ্যা যতই বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে ‘মানুষ নামের সম্পদ’ ততই বাড়তে লাগলো। মানুষ যেখানে যায় বসবাস করে সেখানেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। তারা বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে বসতি গড়ে তুলে, সেইসাথে আবর্জনাও তৈরি করে। তাদের দাপটে অদৃশ্য জিন-ভূতও পলায়ন করে।

কিন্তু আমার বিবেচনায় মানুষ কোনও সম্পদ নয়। সম্পদ হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তা যা কিছু সৃষ্টি করে আমাদের জীবন নির্বাহের বুদ্ধি ও পথ দেখিয়েছেন সেগুলোই হচ্ছে সম্পদ। মাটি বা ভূমি, তারপর বায়ু পানি আলো আগুন এবং মাটির নীচে যে খনিজ পদার্থ রয়েছে ওগুলাই হচ্ছে ইশ^র প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এরপর পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষলতা, ফলমুল শাক-সবজি শস্যদানা ও সকল প্রকার পশুপাখি হলো মূল সম্পদ। এই সম্পদ না থাকলে আমরা পৃথিবীতে কিছুতেই টিকে থাকতে পারতাম না। অতএব অতীত কালের ধ্যান-ধারণায় আমরা মানুষকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করেছি যা মারাত্বক ভুল। মানুষ সম্পদ নয়, মানুষ হচ্ছে সম্পদ ধ্বংসাকারী, সম্পদ বিনাশকারী এক প্রাণী। যাদের আছে বুদ্ধি,ভাষা ও স্মরন শক্তির ক্ষমতা। পৃথিবীর বহু প্রজাতির প্রাণীরা এই পৃথিবীতে টিকে থাকার ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তারা চাষাবাদ করে না, খাদ্য সংরক্ষণ করে না। তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করা লাগে না, ডাক্তার লাগে না, স্কুল লাগে না, যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণ লাগে না। পোষাক বা কাপড়চোপড় লাগে না। গাড়ি ও সহস্র প্রকার মেশিন লাগে না। শতজাত খাদ্য দ্রব্য লাগে না, তেল মশাল্লা বা রান্নার আয়োজন লাগে না। ঘুমের জন্য খাট-পালংক, বালিশ কিংবা বিছানাপত্র লাগে না। ধর্মের প্রয়োজন হয় না, রাজনীতি কিংবা মিটিং মিছিল লাগে না, সিংহাসনও লাগে না।

পৃথিবীতে এত প্রজাতির প্রাণী বিচরণ করা সত্তে¡ও পৃথিবীর কোনও সম্পদ তারা ধ্বংস করে না। কিন্তু এই মানুষ নামের প্রাণীগুলো প্রতিদিন ধ্বংসলীলায় মত্ত। তাদের পায়ের জুতোর নীচে যেমন একটি ক্ষুদ্র পিপড়ে পিষে মরে তদ্রæপ তাদের হাতের পিস্তলের গুলিতে হাতীর মত বৃহৎ প্রাণী ধূলিস্যাৎ হয়। এই জানোয়ারগুলোর দাপটে কোনও প্রাণী কোনকালে নিরাপদ ছিল না, আজো নেই। ভূমি বন-জঙ্গল পাহাড় পর্বত, নদী সাগর, সাগরের তলদেশ, মাটির নীচ, মুক্ত বাতাস কিছুই তারা তছনছ করতে বাকি রাখেনি। সবকিছুই এরা খায়, সাবাড় করে, নাহয় ব্যবহার করে উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেয়। এদের মূল চরিত্র ডাকাতি তথা দুর্ধষ দস্যুবৃত্তি। যেমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে, তেমন সকল নিরীহ প্রাণী ও দুর্বল মানুষের বিরুদ্ধে। এরা অস্ত্রও বোমা তৈরি করে তাবৎ পৃথিবীর জন্য যখন তখন এক বিশাল হুমকি। অথচ তাদের বাইরের খোলস হলো সভ্যতার গুণ-কীর্তন, ধর্ম ও মানবতার গুণ-কীর্তন। কেবলমাত্র লোভ অহংকার বিলাসিতা ও অন্যের উপর ডাণ্ডা ঘুরানোর জন্য পৃথিবীর জঘন্যতম ও নিষ্ঠুরতম আচরণ করতে এদের গুর্ধা কাঁপেনা, রক্তেও শীতলতা আসে না। অতএব মনে রাখা উচিত পৃথিবীর, সমাজে, সংসারে, এই জাতির সংখ্যা যতই বাড়বে পৃথিবীর সম্পদ ততই কমবে। কমতে কমতে শেষ অবধি সামান্য বিষয় বা সম্পদের জন্য তারা ক্ষুধার্ত কুকুর ও হায়েনার মত উন্মত্ত হয়ে উঠবে। অনুমান করছি এরাই ধর্মীয় পুস্তকে বর্ণিত ইয়াজুজ মাজুজের দল। পাহাড়ের গুহায় তাদের বন্ধি জীবনের কোনও প্রয়োজন নেই, তারা এখন উন্মুক্ত, উদ্দাম পাগলা মঙ্গলীয় ঘোড়া। সারা পৃথিবীতে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পৃথিবীতে এদের সংখ্যা এবং বিচরণ যত কম, ততই মঙ্গল, ততই শান্তি।