ঋতু মীর : “Imperfect but still lovable!”
১।
দেয়ালে টাঙ্গানো রবীন্দ্রনাথের মাটির তৈরি মুখটা অসাবধানে পড়ে মুহূর্তে দুই টুকরা হয়ে যায়। নীরব কষ্টে শুন্য দেয়ালে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে সত্যবতী। দেয়ালের পেরেক ঠোকা গর্তটা একটা দুষ্ট ক্ষতের জ্বালা তৈরি করে। পছন্দের প্রিয় জিনিষটা এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ায় তার স্বামীর মুখটাও পাংশু দেখায়। নির্বাসিত এক দ্বীপের নীরবতায় দু’জনেই বসে থাকে চুপচাপ। ভাঙ্গা দুই খণ্ড কুড়িয়ে যতœ করে তুলে রাখে সত্যবতী। শান্তিনিকেতনের একটা ছোট্ট দোকানে এই মুখ দেখে মুগ্ধ হয়ে কিনেছিল। আনমনে, অবসরে, চকিতে চেয়ে দেখা রবীন্দ্রনাথ! তীব্র অবসন্নতায় ঘরের চারপাশে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। কত কি যে চোখে পড়ে। ফেলতে পারেনি, অথচ রেখে দেয়ারও কোন যুক্তি নেই । এই যে বোনের স্মৃতি জড়ানো মুক্তার ব্রেসলেটটা! কালো রোগা হাতে ঢলঢলে, অথচ কি অদ্ভুত দ্যুতি ছড়ানো! অনেকবার সত্যবতীকে দিতে চেয়েছে, নেয়নি। বলেছে- ধুর! মুক্তায় আমাকে মোটেই যায় না, তোমার হাতেই বড় সুন্দর! বোনের মৃত্যুর পর আগ্রাসী বুভুক্ষায় ব্রেসলেটটা নিজের কাছে রাখে সত্যবতী। বোনের জ্বলজ্বলে স্মৃতির চাদরে আদরে জড়ানো এমন জিনিষ যে ভীষণ মুল্যবান! সেদিন হাতে দিতেই কেমন ধুম করে ছিঁড়ে ঘরময় ছড়িয়ে গেল। এক, দুই, তিন টুপটাপ শব্দ! যেন প্রাণের উপর ধসমস করে গড়িয়ে যাওয়া। আর পুরানো ধাঁচের নক্সায় ব্রোঞ্জ টাচে অক্সিডাইস কানের দুলটা জোড়া হারিয়ে আজ অসম্পূর্ণ। কি সস্তা আর সুন্দর! সে কি দামাদামি গাউসিয়া মার্কেট ফেরিওয়ালার সাথে। কয়টা লাগবো, নেননা-মাত্র দুইশ টাকা! মজা লুটে সত্যবতী ঝপ করে বলে- একশো! সাদরে দিয়ে দেয়। দেশের ফুটপাথ ছাড়া এমন কি আর কোথাও মেলে? সেই যে অস্ট্রেলিয়া থেকে কেনা হলুদ রঙ ইলেকট্রিক কেটলি ব্যবহারের শুরুতেই অসাবধানে কেমন জ্বলে অকেজো হয়ে যায়। এমন কচকচে সর্ষে হলুদ কেটলি যেন সত্যবতীর ছাড়া পৃথিবীর আর কারোও ছিল না। প্রাণহীন সব জিনিষ অথচ কি প্রাণ জোড়ানো। জীবন থেমে যাওয়ার মত কিছু নয় তবুও কি মূল্যবান এই স্মৃতি, এই অনুভূতি-ফেলা যায় না! ফেলতে পারে না সত্যবতী!
২।
অতিমাত্রায় ঘরমুখী সত্যবতী। নিজের ঘর যেন তার কাছে নিরাপদ এক স্বর্গ, নিজস্ব এক জগত। একছত্র আধিপত্যের ব্যাখাহীন সুখে, স্বঘোষিত সম্রাজ্ঞীর অর্বাচীন আনন্দে সে ঘরের এধার ওধার ঘুরে ফিরে বেড়ায়। মনের মাধুরীতে তা সাজায়, পরিবর্তন আনে। একইসাথে কল্পনাপ্রবণ এবং পরম বাস্তববাদী সত্যবতীর কল্পনার ঘোড়াটা মাঝে মাঝেই বল্গাহীন ছোটে। অনেক উঁচুতে আকাশের ঠিকানায় থাকা নয়, মাটির কাছাকাছি ছোট্ট কোন বাসস্থানে থাকবে সে। কোলাহল থেকে অনেক দূরে নির্বাসিত কোন দ্বীপ নয় মোটেই, শুধু ইচ্ছামত নীরব নির্জনতায় হাঁপ ছাড়ার একটু অবকাশ চাই। ইচ্ছে হলেই যাওয়া যায় এমন একচিলতে উঠান। কৃষ্ণচূড়া অথবা জারুল গাছের শাখায় ঝুলন্ত দোলনা। মসৃণ, পেলব, ধোঁয়া, মোছা আর পায়ে পায়ে এদিক ওদিক নির্বিঘ্নে হাঁটার মত প্রশস্ত মেঝে। ছাই সাদায় মেশা পাথর রঙ দেয়াল। দেয়ালে শুধুই হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষের ছবি, অনিন্দ্য সুন্দর ভাস্কর্য, শৈল্পিক কোন পেইন্টিং কিংবা মিষ্টি শব্দে সময় জানান দেয়া পুরনো মডেলের পেন্ডুলাম ঘড়ি। দক্ষিণ ভারতীয় কারুকাজে নজর কাড়া ছোট্ট টেবিলে স্মৃতি জাগানীয়া সুভ্যেনীর, শৌখিন জিনিষ, উত্তরাধিকার, পরম্পরায় পাওয়া দুর্লভ সব তৈজসপত্র। গাড় মেহগনি রঙ আসবাবে লুকানো আভিজাত্য, আয়েশি আরাম, উষ্ণ আতিথেয়তা, আপ্যায়নে মুখোমুখি, কাছাকাছি বসে গল্প করার মত এক ছিমছাম গৃহকোণ। ধবধবে সাদা বিছানায় অতিথির যাত্রার সব ক্লান্তি হরণ – এটাই কল্পনা! এটুকুই স্বপ্ন! কল্পনার মন আকাশ ছোঁয়, বাস্তববোধ তার লাগাম টেনে ধরে। কল্পনার কিছু বাস্তবের সাথে মিলে যায়, কিছুটা মেলে না। শুধু ফিরে পাওয়া যায় না সেই বট বৃক্ষ বাবা, সাদা শাড়ির মা, মায়ের বিকল্প সেই মায়াবতী বোন, আজিমপুর গলির পলেস্তারা খসা পুরনো দোতলা বাড়ি, উত্তর দক্ষিণের বিশাল চওড়া বারান্দা, নিম পাতার ভেজা সোঁদা গন্ধ, ছাঁদের রেলিঙ ছুঁয়ে বোগেনভেলিয়া, জানালায় আদরে লেপটে থাকা স্বর্ণচাঁপা অথবা আত্মার নিগুরতম অভিব্যক্তি, আনন্দ, বেদনায় মিশে থাকা দেয়ালের সেই রবীন্দ্রনাথ! মনটাকে প্রবোধ দেয় সত্যবতী- ‘Imperfection is perfection to a beautiful perspective’-যতটুকু যেভাবে আছে সেগুলোই শরীর মন ছুঁয়ে আছে। পরম যতেœ তাই আগলে রাখে সত্যবতী। দিনের পর দিন।
৩।
পাঠ শুরুর আগে ব্রেইন স্টর্মিং করে সত্যবতী- Imperfect but still lovable। এমন কিছু যা এখন ঠিক আগের মত নেই, কিন্তু এখনও আছে, ফেলতে পারোনি এবং এখনও ভালোবাসো। যথার্থ উদাহরণে শিখন সবসময়েই অর্থবোধক এবং স্থায়ী হয়। কবিগুরুর ভাঙ্গা মূর্তি মুখের ছবি দেখায় সে, ব্যাখা করে। অপাপবিদ্ধ মুখগুলো কৌতূহলে ঝুঁকে পড়ে, দেখে। আড়চোখে লেসন প্ল্যানটা দেখে সত্যবতী। বাহ! লার্নিং ‘এক্সপেকটেশন’ এবং ‘আউটকাম’ কাক্সিক্ষত সমান্তরালেই চলছে! শুনছে, বলছে, ঝুঁকে পরে লিখছে অথবা আঁকছে। হাত ভাঙ্গা পুতুল, চাকা বিহিন গাড়ি, চলতে না পারা রোবট, ছিঁড়ে যাওয়া বই কোনটাই ফেলতে পারেনি। অজানা মমতায় বাসার কোথাও ফেলে রেখেছে, ভুলেও গেছে হয়তো। একতাল কাঁদার মত মনগুলোকে ‘সহজ থেকে জটিল’ (Simple to complex), মূর্ত থেকে বিমূর্ত’ (Concrete to abstract) এর ধারনায় পৌঁছে দিতে থাকে সত্যবতী। টিচিং এর সেই বেদবাক্য স্মরন করে সে- learning must be differentiated to be effective! সত্যবতীর জহুরী চোখ ঘুরপাক খায় ক্লাসময়- অনেকগুলো মুখ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বা এক সাথে। শেখার ধরণ বা স্টাইলে, জ্ঞানের লেভেল বা ধাপের ভিন্নতায়, গ্রহণ ক্ষমতায়, আগ্রহের মাত্রায় কেউ কারও মত নয়, সবাই সতন্ত্র এক সত্ত্বা। কেউ বলায় অপারগ তাই লিখছে, লিখতে পারছে না শুনছে, অথবা বলা, শোনা, লেখা কোনটাই করছে না বা পারছে না, শুধু আঁকছে। বিস্ময়ে আলোকিত চোখ সত্যবতীর, সার্থক পাঠদানের তৃপ্তিতে মনটা ভরপুর। মনে মনে আবারও বলে সে- learning must be differentiated…! গভীর ক্লান্তি আর কষ্টের এক নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে থাকে সত্যবতীর-এমন অনেক কিছু! ফেলতে পারেনি! ফেলা যায় না! বস্তুগত জিনিষ বা কিছু কিছু সম্পর্কের মত-গোপন বা প্রকাশ্য, পূরানো বা নতুন, বিচ্ছিন্ন, নিরুত্তাপ, আছোঁয়া, বিমূর্ত। জীবনের নিস্তরঙ্গ নদীতে যা হটাত ঢেউ তোলে, স্মৃতির দুরন্ত ছায়া ফেলে, কষ্ট দেয়, ভাবায়, কাঁদায়- তবু থাকে, আছে, মনের গভীরে, নিভৃতে, নিঃশব্দে। এবার র্যাপ-আপ, উপসংহার পর্ব। প্রচণ্ড এক অন্যমনস্কতায় লেসন রিপিট করে সত্যবতী- শোনো! লিখো! মন থেকে একটা ছবিও আঁকতে পারো এবার — Something imperfect but still loveable…!
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto (ritu.mir9@gmail.com)