ঋতু মীর : “Let your smile change the world, but don’t let the world change your smile”

১।
কেমন আছো সত্য? বহুদিন এমন গভীরতায় কেউ জানতে চায়নি। সত্যবতীও তাকায় একই গভীরতায়। এইদেশে প্রাথমিক অবস্থার ‘ভ্যাবাচ্যাকা’ খাওয়া সময়ে তার সাথে দেখা সত্যবতীর। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে তারা দু’জনেই অপেক্ষা করছিল। প্রথম পরিচয়ের হাসি বিনিময়ে মুখটার দিকে তাকিয়ে সত্যবতীর কেমন অদ্ভুত মায়া হয়। মানুষকে ‘পড়তে’ ‘বুঝতে’ পারার একটা সহজাত ক্ষমতা, একটা তৃতীয় নয়ন আছে সত্যবতীর। পার্শ্ববর্তিনীর ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির অসীম শুন্যতাটা যে অন্তরের গোপন কষ্টের গহীন বন্দরে নোঙ্গর গাঁথা তা বুঝতে সময় লাগে না তার। চাকরি সূত্রে স্বল্প পরিচয়টা ভাষার ভিন্নতা স্বত্বেও বন্ধুত্বের সম্পর্কে দাঁড়িয়ে যায় একসময়। আজ অনেকদিন পর আবার দেখা হতেই উচ্ছ্বাসে হাসে সত্যবতী। ‘কেমন আছো’ এর উত্তরে রহস্য করে বলে-তৃষ্ণা! তৃষ্ণা! তৃষ্ণা! কিছু না বোঝা মুখটার দিকে অনুসন্ধিৎসায় তাকায় সত্যবতী। নিদারুণ অবহেলা, অপমান, অত্যাচার আহত সেই মুখ! চোখের অতল গহীনে জলের সুক্ষ আভাস, টলটলে দীঘির মত হঠাৎ স্থির। হতাশা, স্ট্রেসের ভয়াবহ স্থবিরতায় তসনস দেহ বাঁক হারিয়ে কিছুটা স্থুল, নিয়ন্ত্রণহীন। একটা চাপা ক্ষোভের যন্ত্রণা যেন শরীর ছিঁড়ে খুড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। পোশাক, চুল, জুয়েলারি দৃষ্টিনন্দন হলেও হতাশার কালচে ছায়ায় মুখটা ভীষণ অনুজ্জল দেখায়। বয়স অনুপাতে যেন আরও বেশি বয়সের ছাপ সারা দেহে। বাহ! সুন্দর তুমি! সহজ আন্তরিকতায় প্রশংসা মুখর হয় সত্যবতী। সময়ে একটা ছোট্ট প্রশংসা মনের পুরো আবহাওয়াটাই বদলে দিতে পারে! জানে সত্যবতী। হঠাৎ খুশীর ঝলকে সেও ঠাট্টায় বলে – তোমার মত অত নয়তো আর! বললে নাতো কেমন যাচ্ছে সব? বাংলাদেশ, তোমাদের প্রপার্টি? জানি মা, বোনসহ অনেক কিছু হারিয়েছো তুমি। আর কে কে আছে তবে? দেশে গিয়েছিলে জানি, কেমন হল সব? কৃত্রিম রহস্যের জালে নিজের কষ্টকে আড়াল করে সত্যবতী। বলে- শুন্য! শুন্য! শুন্য! কি বুঝে হেসে দেয় সে। বলে- কবিতা! জানি তোমার পছন্দ। কপট লাস্যে মুখ ভাসায় সত্যবতী- কবিতা নয় গো শুধু! কবিও যে বড় পছন্দ! মুহূর্তের হাসিতে, ঢলাঢলিতে গড়িয়ে পড়ে দু’জনেই। বিগত কয়েক বছরে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে বলে সত্যবতী। মায়ের মৃত্যু, প্রায় সাথে সাথেই পরিবারের একমাত্র অভিবাবক, মায়ের বিকল্প বোনের অকাল মৃত্যু, বাড়ি ঘর জিনিষপত্র সব চলে যাওয়ার ঘটনাগুলি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বলে যায় সে। গোটা বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেগে থাকা স্মৃতি, প্রিয় মানুষের প্রসঙ্গ এলেই যে এই পোড়া চোখে ঝরঝর বৃষ্টি নামে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটি হয়তো অন্যরকম জাগতিক কষ্ট বুকে নিয়ে যুদ্ধ করছে। সত্যবতীর নিজের একান্ত কষ্টটা আজ নিভৃতেই থাক না হয়! গলার কাছে আঁটকে থাকা কষ্টের দলাটাকে যথাসম্ভব নীচে ঠেলে নামায় সত্যবতী। দ্রæত প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলে-তুমি কেমন আছো? স্বামী আর ঘর নামে নরকটা? সাথীর মুখটা এবার অভিমানী দেখায়। বলে- অবমাননার উপত্যকায় বসবাস আমার। নরক তো বটেই! কিন্তু ছেড়ে আসায় যে অনেক সমস্যা। প্রপার্টি, অর্থ, সন্তানের ভবিষ্যৎ, দায়িত্ব সবকিছুর চুলচেরা সমাধান যে সম্ভব নয়। তাই ‘সংসার’ নামের প্রহসনে এক ছাদের নিচেই পড়ে আছি কামড়ে- আর কোন উপায় নেই বলেই। বলে- দুই ছেলেই এখন উপযুক্ত। ছোটটার কথা মনে নেই তোমার? তোমার স্কুলেই তো ছিল। জানো? আমার অটিস্টিক ছেলেটা এখন কাজ করে, আয় করে। চোখের কোণে একরতি চিকচিকে জল, হঠাৎ জ্বলে ওঠা আশার আলোর মত দপদপে দেখায় দৃষ্টি। ম্লান হাসিতে একটা অবজ্ঞার শ্লেষ ঠোঁটে ঝুলছে। বলে- ভালই আছি সেই অর্থে! I am cool, just like a cucumber! আফটার লাঞ্চ ক্লাস শুরুর মিউজিক বেজে উঠতেই ওর হাত টান দিয়ে নাচতে শুরু করে সত্যবতী। ওয়াসরুমের বেসিনের পাশের খালি জায়গাটায় বাজনার তালে মহা আনন্দে চক্কর খায় দু’জন। আহা! কি হিলিং!

২।
স্কুলে অফ পিরিয়ডে ফোনটা বেজে ওঠে। ওপাশে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছে সেই cool cucumber! আহা! অনেকদিন ওর কোন খবরই রাখা হয়নি! অভিমান, অপমানে বিধ্বস্ত কণ্ঠ। সামাল দেয়ার সুযোগ পায় না সত্যবতী, শুধু বলে- কেঁদো না! শক্ত হও! যে স্বামী এভাবে তোমাকে অদ্ভুত ছলে, নিষ্ঠুর অবহেলায় ফেলে চলে গেছে তাঁর জন্য কেন কাঁদছো? ফোনের অন্য প্রান্তে আর্তনাদের কণ্ঠটা কানে আছড়ে পরে সত্যবতীর। জানো সত্য! নিজেকে খুব ‘পরিত্যাক্ত’ মনে হচ্ছে! নতুন বাসার চাবি বুঝে পেয়ে পাষণ্ড সরাসরি চলে গেছে, নিজের জিনিষ পত্র পর্যন্ত নিতে আসেনি, পাছে আমি বাসা চিনে যাই, যেতে চাই তাঁর সাথে! শুনতে শুনতে এপাশে সত্যবতীর চোখ ভিজে যায়। ‘পরিত্যাক্ত’ শব্দটা তার নারীত্বের অহমিকায় অন্যরকম অপমানের জন্ম দেয়। কেন তাঁকে আগে বলেনি ছেড়ে চলে আসো অবমাননার নরক! কেন তাঁকে বলেছিল- সহ্য কর! ভালোবাসো! জয় হবেই! ওপাশ থেকে আচমকা প্রশ্ন করে- আচ্ছা সত্য? তোমার দাম্পত্য আমার মত নয় যদিও, তবুও যদি কখনো এমন হয়? কিভাবে সইতে হয় আমাকে শেখাবে? গভীর এক দীর্ঘশ্বাস চাপে সত্যবতী- দাম্পত্যের প্রশ্নে ঠিক তাঁর মত হয়তো নয়, তবু এর বাইরেও অন্য সম্পর্কে, বন্ধুত্বে এই মন কারণে অকারণে কত অনাকাক্সিক্ষত, কত কিছুতেই, কত শত বার অবহেলিত, দমিত, নির্যাতিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে পরিত্যাক্তও হয়েছে। হয়েছে বৈকি! বিশ্বাসবোধের বলিষ্ঠ সজীবতা সত্যবতীর কণ্ঠে, বলে- ক্ষমা কর বন্ধু! ক্ষমার চেয়ে মহৎ আর কিছু নেই। ক্ষমাহীনতা যে বিষের আগুন! ক্ষমা করে নিজেকে এই বন্দিত্ব থেকে মুক্ত কর। তবে জীবনের তিক্ততা থেকে পাওয়া শিক্ষাটা ভুলো না যেন। ভালোবাসো নিঃশর্তে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিকে না ছুঁয়ে। ফোনের এ প্রান্ত থেকেই তাকে ‘হাগ’ দেয় সত্যবতী। বলে- তোমার জন্য ছোট্ট ক্রিসমাস উপহার আছে। বন্ধু! তুমি কিন্তু একা নও! বিশাল এই পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ ঠিক ঠিক আছে তোমার জন্য!

জRitu Mir- Teacher, Toronto District School Board, Toronto. (ritu.mir9@gmail.com)