ঋতু মীর : Listen without judgment. This is the most precious gift you can offer to someone.
১।
ধুরধার গতিতে ক্লাশে ঢুকে শ্রীমান! অসহিস্নু অভিযোগে ক্ষুব্ধ অবয়ব। সিনা টানটান দুর্বিনীত ভঙ্গিতে সত্যবতীর মুখোমুখি দাড়ায়। দ্যাখো! আমি এই ক্লাশের ছাত্র। এখানে, এই ক্লাসে থাকা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। তুমি আমাকে প্রতিদিন রিসোর্স রুমে কাজের জন্য পাঠাতে পারোনা কিছুতেই। আমি আজ এই ক্লাসেই থাকছি! থাকছি কিন্তু! সত্যবতীর সমর্থন পাওয়ার চেষ্টায় জোড়ালো দাবী ছেলেটার কন্ঠে। আচরণে ঔদ্ধত্য এবং প্রশ্নের সাথে সাথে মেঝেতে পা ঠুকে কথা বলার ধরণ দেখে যথার্থ উত্তরে নিজেকে প্রস্তুত করে সত্যবতী।
ক্লাসের শুরুতে ওর এখানে থাকা মানেই পুরো ক্লাসের পরিস্থিতি বদলে যাওয়া। ‘লার্নিং ডিসেবিলিটি’ ধরণের সীমাবদ্ধতা রয়েছে ওর। এটেনসন স্প্যান এত কম যে একপ্রকার নেই বললেই চলে। সেখানে ক্লাসের নানা কর্মকাণ্ডসহ অন্য শিক্ষার্থীরাও ওর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে আচরণে বিপদজনক স্টিমুলাস হিসেবে কাজ করে। নিজে যেমন ক্লাসে মনোযোগী হতে পারেনা, তেমনি ক্লাসে অন্যদের মনোযোগ ব্যাহত করতেও মহাপারদর্শী সে।
Environmental accommodation এর প্রয়োজনেই ওকে রিসোর্স রুমের quiet place এ পাঠানোর ব্যাবস্থা নিয়েছে সত্যবতী। ঠিক! তুমি সত্যিই ‘এই ক্লাশের একজন’। ‘এই’ আর ‘একজন’ এই দুই শব্দে অতিরিক্ত জোর দেয় সত্যবতী। আবেগ আর যুক্তির অপূর্ব মিশ্রণ সত্যবতীর চোখে। আজ তুমি এই ক্লাসেই থাকবে এবং আমার সাথে বসেই কাজ শেষ করবে কেমন! নিজের চেয়ার ওর ডেস্কের খুব কাছে এনে ওকে একপ্রকার বøক করেই বসে সত্যবতী। গুগল ডকের টেবিল ওপেন করে post secondary future program কলামে যাও দেখি এবার! এত্ত এত্ত কাজ দাও যে তোমাকে আর আমি পছন্দ করি না! ছেলেটার বালকসুলভ আচরণ, কণ্ঠস্বর সে মুহূর্তে সত্যবতী বেশ উপভোগ করে সত্যবতী। আমি শুনে আনন্দিত যে এখন না করলেও আগে আমাকে ‘পছন্দ’ করতে তুমি! ধীরে সুস্থে কাজের লক্ষ্যে আগায় সত্যবতী। গুগল স্লাইড কমপক্ষে দশটা হতে হবে কিন্তু! এই ক্ষণে কম্পিউটারে শ্রীমানের অখণ্ড মনোযোগে কিছুটা আশ্চর্য হয় সত্যবতী। স্লাইড শিরোনামে ‘My Future Wife’ দিয়ে গোটা পাঁচ ছয় স্লাইড বিভিন্ন তরুনীর চমত্কার মুখশ্রীর সব ছবিতে ঠাঁসা। গুগল স্লাইডের টেকনিক্যাল চমত্কারিত্বে মুগ্ধ হয় সত্যবতী। স্লাইড এনিমেশন, রঙ, ছবি সহ আই ক্যাচিং হেডিং ব্যাবহারে দুর্দান্ত মুন্সিয়ানার প্রমান রয়েছে। মানে কি? দুষ্ট হাসিতে সিরিয়াস শ্রীমান। তুমি কি আমাকে ফিউচার ওয়াইফ বাছাইয়ে সাহায্য করতে পারো? কি পারি আমি? হতবাক সত্যবতী মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আর শোন! পড়াশুনা শেষ করে উপার্জন না করতে পারলে কিন্তু ফিউচার ওয়াইফ খোঁজা বৃথা- ইঙ্গিতে রেখে ঢেকেই বলে সত্যবতী। নির্বিকার নিশ্চিত হাসি শ্রীমানের- hang-out এ যাব, হেসে খেলে বেড়াবো দু’জনে আর ভালোবাসবো! ভালোবাসবো! সিরিয়াসলি! আমি সিওর যে আমার ফিউচার ওয়াইফ এই সবেই খুব সুখী থাকবে।
হালছাড়া নাবিকের দৃষ্টি সত্যবতীর। post secondary future program এর বদলে ভবিষ্যতের কোন স্বপ্নে মগ্ন বয়ঃসন্ধির এই যুবক? তবুও মনে অন্য এক অনুভূতি ছুঁয়ে যায়- ‘ভালোবাসবো’ শব্দটা উচ্চারণে কি ভীষণ এক প্রত্যয় ছেলেটার কণ্ঠে। অপরিণত মনে ভালোবাসার এক নির্মল ধারা অজানা আনন্দে ধাবমান। স্বপ্ন আর বাস্তবের বিস্তর ফারাকটুকু অজানাই থাক অপরিণত কোমল মনে। আজ ওর সাথে এসাইনমেন্ট নিয়ে আর কথা বাড়াবেনা সত্যবতী।
এবারের দৃশ্যে শ্রীমতী! একহারা লম্বা, ছটফটে স্বভাব। বুদ্ধির আভায় ঝকঝকে! ‘respect’ বোধটা ওর পারিবারিক শিক্ষা। প্রথম দিনেই সত্যবতীর নজর কাড়ে। শুরুতে এসাইনমেন্টে ৯০% মার্কস পেয়ে উত্সাহে টগবগে। দেখো মিস! তোমার বিষয়ের এই মার্ক আমি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবোই রাখবো! কিন্তু বছরের শেষে এসে চঞ্চলমতি কারও প্রেমে পড়ে। ক্লাস ফাঁকি, সময়মত কাজ জমা না দেয়ার হার বেড়েই চলে। ঘ্যানঘ্যান বাদ দিয়ে ‘procrastination’ এবং ‘time management skill’ লেসনে brainstorming করে সত্যবতী। যদিও ফলাফল মন্থরই থাকে। ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শিক্ষকতা জীবনের সার্থকতাই যে শুন্য- ভাবে সত্যবতীর। কালমিনেটিং এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার শেষ দিন। ক্লাশের কোনের চেয়ারে শ্রীমতীর অপরাধী বিষণ্ণ বদন দেখে মন হু হু করে ওঠে সত্যবতীর। ইন্ডিপেন্ডেন্টলি কাজ করার চমত্কার স্কিল আছে ওর, সাহায্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বাকির খাতায় যে পরিমান কাজ যোগ হয়েছে তাতে এই যাত্রায় ৯০% মার্ক বহাল থাকবে কি না সেই চিন্তায় কেমন অস্থির লাগে সত্যবতীর। ক্লাসের ব্যাস্ততার ফাঁকে ওর দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখে সত্যবতী। দুশ্চিন্তা, অপরাধবোধে যেন ‘demoralised’ হয়ে না যায়! ক্লাসের ঘণ্টা পড়ার আগে নিজের টেবিলে ছোট্ট একটা চিরকুট পায় সত্যবতী। সম্বোধনহীন! কাকে লিখেছে, কে লিখেছে বুঝতে কিছু সময় লাগে সত্যবতীর। চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী-“এই মুহূর্তে আমি নিজের প্রতি খুব হতাশ। এই বিষয়ে এত খেটেছি অথচ আমার নম্বর খুব দ্রুত নীচে নেমে গেছে। আজ যদি তোমার সাজেশন মত সব ঠিকঠাক করি আমাকে কি ৯০% মার্ক ফেরত দেবে? আমাকে কমপক্ষে ৮০% নম্বর অবশ্যই পেতে হবে।
Grandma প্রমিস করেছে এই নম্বর পেলে ১০০ ডলার দেবে”। শেষ ক্লাশের ঘণ্টা পড়ার মুহূর্তে এই চিরকুট সত্যবতীকে প্রচণ্ড ভাবিয়ে তোলে। একজন শিক্ষক হিসেবে এই মুহূর্তে সিন্ধান্ত গ্রহণে কি ভীষণ টানাপোড়েনে পড়ে যায় সে। কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই মনে পড়ে- দেশে থাকাকালীন শিক্ষকদের খাতা দেখার সময় একটা খাতায় একটা প্রশ্নের উত্তরে লেখা ছিল- ‘প্রিয় আপা/ স্যার! আমার শাশুরী আমাকে অনেক অত্যাচার করেছে বলে পড়তে পারি নাই। আমার প্রতি দয়া করেন প্লিস’। খাতায় কি নম্বর দিয়েছিল এখন যদিও তা মনে নেই তবে মুক্তাক্ষরে হাতের লেখাসহ ঘটনাটা বেশ মনে আছে সত্যবতীর। পুরনো স্মৃতির যোগসূত্র থেকে ছিন্ন করে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে সত্যবতী। স্কুল ইয়ারের সময় প্রায় শেষের পথে। ট্রিলিয়াম এচিভমেন্টে মার্কস এন্ট্রি দিয়ে অফিসে দ্রুত জমা দিতে হবে। teachassist প্রোগ্রাম খুলে মেয়েটার পুরনো এসাইনমেন্টগুলি পুনরায় রিভিউ করে সত্যবতী। এদিক ওদিক এডজাস্ট করে আপ্রাণ চেষ্টায় ৮০% মার্কসে শেষ রক্ষা হয়। রেসাল্ট, রিপোর্ট কার্ড বাসায় পাঠানোর পর্ব শেষে একটা ইমেইল পায় সত্যবতী। সম্বোধনে সুন্দর ভাবে সত্যবতীর লাস্ট নেম উল্লেখ করা- “I got the price from grandma, you are so nice and a great teacher! শুন্য ক্লাসে রিলাক্স মুডে বসে থাকে সত্যবতী। ছাত্রছাত্রীবিহীন হলাহলহীন সময়। পাঠ নেই, প্রিপারেসন নেই, এসাইনমেন্ট নেই, নম্বর নেই, ক্যাচক্যাচ নেই। কেমন শুন্য শুন্য লাগে সবকিছু। সেই সাথে নিজেকে অদ্ভুত ভারমুক্ত এবং হাল্কাও লাগে। মনে মনে জোনাকিকে খোঁজে সত্যবতী। দ্যাখো জোনাকি! মানুষকে লেবেল’ এঁটে বিচার করা এবং তাঁর সম্পর্কে সিন্ধান্ত গ্রহণ অনেক সময়েই যৌক্তিক বা সঠিক হয় না, we need to make a conscious decision to look for what is right and pleasing in others। আনমনে অস্পষ্টে বলে চলে সত্যবতী-turn judgment into blessing!
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com