ঋতু মীর : “You cannot force someone to respect you but you can refuse to be disrespected”
কমিউনিটির গ্রোসারী সপে ঢুকেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে যায় সত্যবতীর। সল্প পরিসরের ঘুপচি মার্কা দোকানটায় নিজ ভাষী চেনা অচেনা মানুষের গাদাগাদি ভিড়। দরজা দিয়ে ঢুকতেই কাউন্টার ধরে লম্বা লাইনটা একটা বিশাল ব্যারিকেডের মত জায়গা ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে । জিনিষ নেয়ার জন্য সেলফের কাছে সরাসরি পৌঁছে যাওয়ার কোন উপায় নেই। নিজস্ব ট্রলিটা রাখার কোন ব্যবস্থা নজরে পড়ে না। অগ্যতা দোকানের নির্ধারিত ট্রলি না নিয়ে নিজের ব্যাগ বন্ধ ট্রলিতেই বাজার করতে উদ্যত হয় সত্যবতী। আজকের গোটা দিনটাই যেন এক ধাক্কা লাগা ধকলের সময়। কাজের জায়গায় নিঃশ্বাস বন্ধ করা ‘টাইম বাউন্ড ‘কিছু কাজ তুলে দিয়ে এই অবেলায় গ্রোসারীতে এসেছে সে। সচরাচর উইক এন্ডে ভিড় থাকে, আজ তবে এত তুমুল ভিড় কেন? তবে কি অন্যরাও তার মত বাজারের জন্য উইকডের এই সময়টাই বেঁছে নিয়েছে? দিনের এই প্রান্তে শরীর মন দুইই বড় পরিশ্রান্ত। জরুরি বাজার ঠেলে নিয়ে বাসে করে বাসায় পৌঁছানোর এক ধুকপুকে তাড়া মনের মধ্যে। তারপর ধোয়া, মোছা, গোছানো, রান্না, খাওয়া, পরের দিনের কাজের প্রস্তুতি সহ সংসারের যাবতীয় অন্য অনেক কাজ পড়ে আছে। দোকানের পরিস্থিতিতে ক্লান্তি যেন কয়েকগুণ বেড়ে পেঁচিয়ে ধরে সত্যবতীকে। পজিটিভ মটিভেসনে মনকে এঙ্গেলে ঘুড়িয়ে আনার চেষ্টা করে সে। আশেপাশে হাই ষ্টণণ্ডার্ড সুপার স্টোর অনেক আছে, তারপরও কিছু কিছু জিনিষ কেনার ক্ষেত্রে এই এলাকার কম্যুনিটি ভিত্তিক দোকানের দেশী দেশি আমেজের ভাবটা এক দুর্নিবার ইচ্ছায় এখানে টেনে নিয়ে আসে। ভিড়ে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে ট্রলিতে ট্রলিতে ধাক্কাধাক্কি করে সরু প্যাসেজ ধরে এগুতে থাকে সত্যবতী। সামনে ঝুড়িতে রাখা কচি সবুজ রঙ তাজা পটল এবং দেশি কচুর লতি দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। ইলিশ মাছে পটল এবং কচুর লতিতে চিংড়ী দারুণ জমে! আজ একটা ইলিশও দেখবে যদি দাম এবং অন্য সব ঠিকঠাক মিলে যায়। কয়েকজন ক্রেতা প্রায় হুমড়ি খেয়ে পটলের ঝুড়ি ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত। সিজেনের নতুন সবজী বলে দামটাও নেহায়েত কম নয়। বেঁছে বেঁছে ভালোটা ব্যাগে তোলার প্রতিযোগীতা সবার চেহারায়। ঝুড়ি প্রায় তলানিতে পৌঁছে গেছে! পটল কেনার উদ্যম দমে যায় সত্যবতীর। পচে গলে যাওয়া ঝুড়ির তলানির পটলের অংশ আঙ্গুলের ডগায় লেগে যাওয়াতে আগের বিরক্তিটা আবার জেঁকে ধরতে চায় সত্যবতীকে। ঝুড়িতে নতুন ভাবে আরও পটল রাখা হবে কিনা তা জানতে উত্সাহী হয় সে। এই প্রসঙ্গের উত্তরে না গিয়ে কাস্টমার নজরদারীতে থাকা টানটান পুলিসী ভঙ্গীতে দাঁড়ানো ব্যাক্তি ‘চুরি’ ‘চোর ধরা’ জাতীয় মনোভাব চেহারায় এঁটে সরাসরি সত্যবতীর দিকে তাকায়। পটল প্রসঙ্গে না গিয়ে গম্ভীর মুখে বলে –দোকানের ট্রলি ছাড়া নিজের ট্রলিতে বাজার করার প্রবণতা কিন্তু একদম ঠিক নয়, এমনকি এই দোকানে সেটা এলাউডও নয় । ভ্যাবাচ্যাকা খায় সত্যবতী। যদিও এই পর্যন্ত নিজের ব্যাগ-ট্রলিতে কিছু তোলার সুযোগই সে পায়নি, তবুও লোকটার এই উক্তিতে অপমানে ভিতরটা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। ক্রেতার নিজস্ব ট্রলি রাখার ব্যবস্থা এবং দোকানের নিজস্ব ট্রলি নেয়ার নোটিশ কোথায় এখানে? মেজাজের পারদটা ধুম করে উচ্চ মাত্রায় উঠছে তা টের পায় সত্যবতী। ব্যাক্তিগত ইগোকে ঢোক গিলে ভিতরে চালান করে লোকটাকে কিছুটা ইগনোর করে সত্যবতী। বিষয়টা পার্সোনালি নেবেনা সে! দোকানের পলিসি সব ক্রেতার জন্যই প্রযোজ্য। তারও সেটা মেনে চলাই উচিত।
২।
পটল কেনা স্থগিত রেখে মাছ মাংসের কাউণ্টারের দিকে দ্রুত হাঁটে সত্যবতী। ভীড়ের মাত্রা এখানেও কম নয়। কাউন্টারের প্যারালাল হয়ে সারি ধরা লোকজন । ঝুঁকে পড়ে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বিক্রেতাকে নিজের প্রয়োজন বোঝাতে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। কাঁচের সেলফ কাউন্টারের অন্য পাশে মাছ, মাংস কাটাকুটি এবং ওজন মেপে বিক্রীরত লোকটা কি নেবেন, কোনটা নেবেন এইটা দিয়ে দেই, ওইটা ফ্রেস, এইমাত্র আসছে… এই টুকরাটা নেন, নিলে পুরাটা নিতে হবে… কেটে বিক্রী হবেনা, ইত্যাদি নানা কথোপকথনে মহাব্যস্ত।
দোকানের ভেতরে দম বন্ধ লাগে সত্যবতীর। প্রত্যেকের প্রয়োজন যে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমন গড়পড়তা নিয়ম কেন দোকানে? না লাগলেও কেন তাকে অতখানি মাংস কিনে নিয়ে যেতে হবে? আর তলানীর পচা পটলের মত এমন ফ্যাকাশে রঙ বাসি মাংসের ছোট্ট টুকরাটাই বা কেন পয়সা দিয়ে কিনতে বাধ্য হবে সে? পরিমান অল্প বা বেশি- প্রত্যেক ক্রেতাকেই দাম মিটিয়েই প্রয়োজনের জিনিষ কিনতে হবে। তাহলে কাউকে ‘ফেভার’ করছি এমন ভাব কেন বিক্রেতার কথায়, চোখে মুখে? এবারেও বিরক্তিটা সযতনে চেপে রাখে সত্যবতী। ‘বড় অর্ডার কিন্তু এক্সট্রা মনোযোগ দিয়ে রেডি রাখো, কাস্টমার নিতে আসলে দাড় করিয়ে রাখবা না’- কথাটা শুনে ঘুরে তাকায় সত্যবতী। দুরের টেবিলে প্রায় আস্ত খাসি এবং গরুর বিশাল কয়েক খণ্ড মাংস দেখে বুঝে নেয় নির্দিষ্ট কোন ক্রেতা এই দোকানের একজন মহা সম্মানিত গ্রাহক। ভাগ্যবান সেই ক্রেতার জন্য উপরের অদৃশ্য এক অঙ্গুলি হেলনেই বুঝি সবকিছু হুকুম মত আয়াশে ঘটে যাচ্ছে। একটু আগে ট্রলির ঘটনায় মনে এক বিব্রতকর অস্বস্তি সত্যবতীর সারা অবয়বে। নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে সেই মুহূর্তে এক ইনফেরিওর কমপ্লেক্সে ভুগে সত্যবতী। আবার চকিতেই আনমনা ভাব কাটিয়ে নড়ে চড়ে ওঠে সে। এভাবে ভাবনায়, পর্যবেক্ষণে ডুবে গেলে সময়মত বাড়ী ফেরাই অসম্ভব হবে আজ। বড়সর একটা রুই মাছ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আত্মপ্রসাদে দুই হাতে চেপে ধরে। বাহ! দামে পড়তা একটা ভালো মাছই খুঁজে পেয়ে গেছে সে। দুই তিন সপ্তাহ আর এদিকে পা না মাড়ালেও চলবে। শিক্ষকসুলভ স্বভাবে মাছ কাটার নির্দেশ দিতে গিয়ে হতাশ হয় সত্যবতী। পেট পিঠ মিলিয়ে বিশাল বিশাল আকৃতির টুকরায় মাছ কাটা প্রায় শেষ। টুকরাগুলো এত বড় যে এই মাছ রান্নার জন্য বিশাল কড়াই কিনে তবেই বাড়ী ফিরতে হবে- ভাবে সত্যবতী! ‘এভাবে কাটলে যে লবন মশলা কিছুই মাছে ঢুকবে না ‘বলতে গিয়েও নিজেকে কস্টে দমন করে সত্যবতী। ছোট সাইজের মুরগী কিনে নিয়েই এখান থেকে পালাবে সে। কিন্তু আজ যে সেটাও নজরে পড়ছে না। বিশাল সাইজের মুরগী ওজন দেয়ার যন্ত্রে তুলতে দেখে আতংকিত হয় সত্যবতী। ‘বড় মুরগীতে প্রচণ্ড ফ্যাট এবং গন্ধ আছে, খেতে পারি না’ কথাটা একটু জোরের সাথেই কণ্ঠ্য ঠেলে বের হয়ে আসে। কাউণ্টারের মানুষটার চোখে অন্যরকম ইঙ্গিত, মুখে কথা লুফে নেয়া অসহ্য এক পিছলা হাসি। ‘খেতে পারেননা ক্যান ভাবী?’
ডাক্তার দেখান! আর ভাই কই? আসে নাই আজ? গনগনে রাগে তপ্ত হয়ে ওঠে সত্যবতী। মুখটা যেন আগুনের আঁচে পোড়া ছাই রঙ মাটি। অশোভন ঠাট্টা আর ইঙ্গিতের অনধিকার চর্চা করে এই লোকটা অবলীলায় কাস্টমার সার্ভিসের অন্যতম শর্ত ‘প্রফেসনালিসম’ কে ভঙ্গ করছে। সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে এবার দাঁত বের করা ক্যাবলা হাসি লোকটার- রাগ করলেন নাকি ভাবী? চলতে গিয়েও ঘুরে দাড়ায় সত্যবতী- শ্লেষ মাখা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তার- কি মনে হয়? এখানে আসা সকল মহিলা মানেই তারা আপনার ভাবী? আর পৃথিবীর তাবত ভাবীদের সাথে আপনার অদ্ভুত ঠাট্টার সম্পর্ক?
এই দেশে দোকানপাটে কাজ করার আগে ‘কাস্টমার সার্ভিস’ কোর্সে প্রশিক্ষণ নেয়াটা আপনার জন্য খুব জরুরী কিন্তু! চাঁছাছোলা বিদ্রুপের উপদেশ দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটে সত্যবতী। সমস্ত শরীরে ক্লান্তির বদলে এখন অসহ্য এক আগুনের তাপ। মানুষের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গী, এবং আচরণে পরিমিতি অপরিমিতির সুক্ষ বিষয়গুলো মাথায় ভন ভন করে ঘুরে চলে। বাসের জানালা গলিয়ে দৃষ্টি সুদূরের শুন্যে ভাসমান। ‘The gap between our processes values and our practiced values is the gap between us and our happiness”- মনিষীর দেয়া মুল্যবান উক্তিটা বিড়বিড় করে বলে চলে সত্যবতী। (চলবে…)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com