ঋতু মীর : “Personal space referes to an area with invisible boundaries”

১।
টবে রাখা গাছগুলোর দিকে একটু বিশেষ মনোযোগে তাকায় সত্যবতী। ঠিক আগের মত তরতাজা লকলকে সবুজ ভাবটা যেন আর নেই। সামান্য স্পর্শেই এদিক ওদিক পাতা খসে প্রায় ন্যাড়া হওয়ার পথে। ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে হাতে গোনা কয়েকটি টব সৌখিনতার পারিপাট্যে সত্যবতীর ঘরের শোভা বর্ধন করছে বহুদিন। সংসারের অন্যান্য অনেক কাজের মত গাছের যত্ন নেয়াকে একটা অবশ্যকরণীয় কাজ বলে মনে করে সত্যবতী। প্রতিটা গাছই যেন তার সংসারের এক মূল্যবান সদস্য। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে নিজ নিজ স্থানে স্ব-মহিমায় সৌন্দর্য বিলিয়ে টিকে আছে। প্রতিটা গাছের ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ যত্ন, পরিচর্চা এবং যথার্থ মনোযোগ দিতে একান্ত চেষ্টা করে সত্যবতী। দাম কম বা বেশি, দুষ্প্রাপ্য বা সহজলভ্য, নজর কাড়া বা নিস্প্রভ- গাছের যত্নে এই মানদণ্ড কখনোই সত্যবতীর বিবেচনায় থাকে না। যত্নের প্রশ্নে কেবলমাত্র গাছের ধরণ এবং গ্রহণ ক্ষমতার মাত্রাটা মাথায় রেখে কোন কোন গাছের বাড়তি যত্ন নেয় সে। বাসার বাইরে একচিলতে বাগানে প্রতিবেশীর বিস্ময় বা ঈর্ষার মত কোন গাছ এখনও লাগিয়ে উঠতে পারেনি সত্যবতী। শুধু ছোট ছোট ঝাউগাছ দিয়ে বাগানে একটা ন্যাচারাল সীমানা তৈরির চেষ্টা করেছে। সামারের গণগণে রোদ উপেক্ষা করে ট্রামে বাসে ঘুরে খুঁজে খুঁজে কমদামে গাছ সংগ্রহ করে নিজ হাতে গাছ লাগানোর কঠিন শ্রমে ব্রতী হয়েছে সত্যবতী। অল্প আয়াসে সাধ্যমত ঘাসের বীজ লাগিয়ে বাগানে তৈরি করেছে ঘন সবুজ কার্পেট। নার্সারিতে ঢুঁ মেরে ফেলে দেয়া টিউলিপ বাল্ব, পেরেনিয়াল ফুলের চারা সংগ্রহ করে পরম যত্নে মাটিতে লাগিয়েছে। গত এক বছরে গাছ, ঘাস, ফুল মাটিতে বসে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। স্বতঃ প্রণোদিত উদ্যম এবং শ্রমের ফলাফলের এইটুকু প্রাপ্তিতেই আনন্দে বিভোর সত্যবতী। জানালা সম্বল করে নিজের প্রিয় জায়গায় বসে একমনে বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। প্রলম্বিত এক শীত যেন চিরস্থায়ী কোন বন্দোবস্তে জেঁকে বসেছে শহরে। যাই যাই করেও যাওয়ার নামটি নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পেজা তুলার মত বরফের স্তূপ ঠেলেঠূলে ছোট্ট ঝাউ গাছগুলোর চিরল বিরল পাতা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ‘আছি’ বলে জানান দিচ্ছে। উঠানের কোন বরাবর ম্যাপেলের বিশাল গাছটা প্রকৃতির উষ্ম আলিঙ্গনের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত। বিবর্ণ ডালে নতুন পাতার কুঁড়ি ফুঁটি ফুঁটি করেও আবহাওয়ার প্রকোপে দমে আছে। জীর্ণ প্রকৃতি আবার নতুন পাতা বা ফুলের কুঁড়িতে রঙে রঙে সেজে উঠবে, নতুন প্রানের ছন্দে বাঁচার আনন্দে হেসে উঠবে কোনদিন- ব্যাপারটা ভাবতে এই মুহূর্তে একরকম অবিশ্বাস্য লাগে সত্যবতীর। ঘরের কোনে টবের বাগানটাই যেন প্রকৃতি ছোঁয়া আনন্দের একমাত্র অবলম্বন, আরামদায়ক স্নিগ্ধ ছোঁয়্যা শরীর মনের এক নির্মল বিশ্রাম। অথচ আজ টবের প্রায় প্রতিটা গাছ বাইরের প্রকৃতির মতই ম্রিয়মাণ। কি এক অভিমানেই যেন নিজের চারপাশে অস্পষ্ট কুয়াশার দুর্ভেদ্য বলয় তৈরি করে জবুথুবু দাঁড়িয়ে আছে। পাতার সাথে পাতার সেই অদৃশ্য কাঁপন, জানালার কাঁচ গলিয়ে আসা সূর্যের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে রঙবদল, পাতায় ডালে একসাথে জড়াজড়ি থাকার উদ্বেল আনন্দ- এর কোন কিছুই আজ সত্যবতীর সন্ধানী চোখে ধরা পড়ে না। গাছের যত্নে তাহলে কি কোথাও ত্রুটি বা ভুল হয়েছে তার? খারাপ লাগা অনুভবে মনটা গুমোট হয় সত্যবতীর।

২।
আচ্ছা জোনাকি! গাছেদের প্রাণ আছে জানি, গাছ ব্যথা পায়, অসুস্থ হয়। কিন্তু অভিমান? ধরা ছোঁয়া যায় না মনের এমন বসত কি গাছের মধ্যেও আছে? মানুষের মত সেও কি অবহ কষ্টে, দুঃসহ অভিমানে আহত হয়? কাউচে হেলান দিয়ে আবোল তাবোল ভাবনায় এলোমেলো হয় সত্যবতী। এবার লম্বা সময় দেশের বাইরে যাওয়ার আগে টবের গাছ প্রতিবেশীর কাছে রেখে গিয়েছিল সে। গাছ ফেরত দেয়ার সময় গাছের দিকে তাকিয়ে স্বস্নেহ হাসিতে গাছ পাগল মানুষটা বলে -তাকিয়ে দ্যাখ সত্য! গাছগুলো তোমাকে দেখে কত খুশি! আর জানোতো! গাছেরও কিন্তু মানুষের মত ভাষা আছে। সেই ভাষা মানুষের মত শব্দে কথায় স্পষ্ট নয় যদিও, কিন্তু একটু গভীরভাবে অনুভব করলেই গাছের সেই ভাষা, প্রাণের সেই ছন্দ, হিল্লোলের অভূতপূর্ব আন্দোলন তুমি ঠিক বুঝতে পারবে। উপযুক্ত যত্ন, মনোযোগ না পেলে গাছ কিন্তু মানুষের মতই অভিমানী হয়। আর শোন! গাছেরা কিন্তু নিজের জায়গায় অনড় থাকতে চায়, স্থান বদল একদম পছন্দ করেনা। অনেক সময়ে জায়গা বদলের সামান্য পরিবর্তনেও গাছ বিমর্ষ হয়, মরেও যায়। ধরে নাও গাছও মানুষের মতই নিজের ‘Comfort zone’ এ থাকতে চায়। যদি মানুষকে বুঝতে পারো তাহলে গাছকে বুঝতেও অসুবিধা হবে না সত্য! কি দারুন তথ্য! মন্ত্রমুগ্ধতায়ভাবে সত্যবতী। এভাবেতো ভেবে দেখেনি বিষয়টা। গাছের প্রকৃত মর্ম বোঝা ওই মানুষটা যে অন্যরকম দার্শনিক চিন্তার সুত্রে তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।

জোনাকি! শোন! মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কি ঠিক গাছেরই মত পরিচর্যা, যত্ন, মনোযোগের মত বিষয়গুলোই প্রযোজ্য নয়? জীবনে প্রতিটা সম্পর্কই যে ভীষণ মুল্যবান, সমান গুরুত্ববহ। প্রতিটা মানুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের কাছ থেকে সমান মনোযোগ, পরিচর্যা, যত্ন প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশা করে সম্মান, ভালোবাসা, মর্যাদা।
অথচ আমরা প্রায়শই নিজের অজান্তেই অলিখিত সেই নিয়ম ভঙ্গ করি। সম্পর্কের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত এক নক্ষত্রের মত ছিটকে পড়ি অজায়গায়, ভেঙ্গেচুরে যাই, বিছিন্ন হই। ভেঙ্গে যায় সম্পর্ক, হারিয়ে ফেলি মানুষ! সম্পর্কের প্রশ্নে গাছের যোগসূত্রটা কিন্তু আমাকেও ভাবনায় ফেলে দিল সত্য! এতক্ষনে মুখ খুলে জোনাকি। আমার মনে হয়- একজন মানুষের পার্সোনাল স্পেসের ইনভিসিবল বাউন্ডারীটা আমরা অতিক্রম করে যাই অবলীলায়। সমস্যার উত্পত্তি কিন্তু সেখান থেকেই। আমাদের চারপাশের অনেক মানুষই- just don’t grapes the concept of personal space. দ্যাখো সত্য! ‘Everyone needs to be able to have their own space in which to be themselves’। ধৈর্য, সহনশীলতায় মানুষকে তার নিজস্ব বৈশিষ্টে থাকতে দিতে হয়, গ্রহণও করতে হয় অপার ক্ষমায়, মানুষের নিজস্ব অবস্থানের প্রেক্ষাপটেই। সম্পর্ক টিকে থাকার মূলমন্ত্রও এই সুত্রেই নিহিত। মহাকালের আবর্তনে এই ডিভাইন রুল মেনে চলার ইচ্ছাটাই উপহার দিতে পারে সুস্থ সুন্দর সম্পর্কে ঘেরা এক বাসযোগ্য পৃথিবী। (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com